জন্মভূমি রিপোর্ট
গত প্রায় ১০ মাস আগে কয়রা উপজেলার বাগালী ইউনিয়নের বামিয়া গ্রামে সংঘটিত লোমহর্ষক ট্রিপল হত্যাকাÐের তদন্তে প্রকৃত মোটিভকে পুলিশ আড়াল করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। নিহতের পরিবারের সদস্যরা রোববার খুলনা প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে এ অভিযোগ উত্থাপনের পাশাপাশি বলেন, পূর্বে তদন্ত কর্মকর্তা হত্যাকাÐের আলামত হিসেবে যে ধাঁরালো অস্ত্র জব্দ দেখিয়েছিল, সেগুলো তিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষার কথা বলে স্থানীয় কয়েকটি বাড়ি থেকে সংগ্রহ করেছিলেন। ভিকটিম পরিবার বলছেন, মামলার তদন্ত কাজ থমকে আছে। হত্যাকাÐের প্রকৃত রহস্য উদঘাটন ও ঘাতকদের বিচারের মুখোমুখি করার দাবিতে তারা মামলার তদন্তভার সিআইডি অথবা পিবিআই কর্তৃপক্ষের উপর অর্পণের জন্য আদালতে আবেদন করেছেন।
গত ২০২১ সালের ২৫ অক্টোবর রাতে বামিয়া গ্রামের দিনমজুর হাবিবুল্লাহ গাজী (৩৩), তার স্ত্রী বিউটি খাতুন (২৫) ও মেয়ে হাবিবা খাতুন টুনি (১২) কে ঘাতকেরা নির্মমভাবে খুন করে। পরদিন সকালে নিহতদের বসতভিটা সংলগ্ন একটি পুকুর হতে ওই তিন জনের মরদেহ উদ্ধার হয়। হাবিবুল্লাহ এবং তার স্কুল পড়–য়া মেয়ে টুনির মরদেহে দুই-তিনটি করে ধাঁরালো অস্ত্রের জখমের চিহ্ন ছিল। বিউটির শরীরে কোনো জখমের চিহ্ন ছিল না। এ ঘটনায় ২৬ অক্টোবর নিহত হাবিবুল্লাহর মা কোহিনুর খানম অজ্ঞাত আসামিদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেন।
সংবাদ সম্মেলনে নিহত হাবিবুল্লাহর মায়ের পক্ষে আরেক ছেলে মফিজুল ইসলাম লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন। তিনি বলেন, সীমানা পিলার ও তক্ষক সাপের অবৈধ কারবার সংক্রান্ত ঘটনাকে কেন্দ্র করে পরিবারের তিন সদস্যকে খুন করা হয়েছে বলে বার-বার দাবি করা হলেও পুলিশি তদন্তে বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে না। আসামি আব্দুর রশিদ ওই কারবারে সরাসরি জড়িত ছিল। নিহত বিউটির মা এবং বোনের বক্তব্য অনুযায়ী খুন হওয়া হাবিবুল্লাহও তক্ষক ও সীমানা পিলার কারবারী চক্রে জড়িয়ে পড়েছিলেন। আসামি বেল্লাল আদালতে দেয়া স্বীকারোক্তি মূলক জবানবন্দীতে বলেছে-হত্যাকাÐের একদিন আগেও ভিকটিম হাবিবুল্লাহর সাথে সাপ কেনা-বেঁচা নিয়ে তার কথা হয়েছিল। রজব আলী নামে চক্রের আরেক সদস্যের সাথেও নিহতের কথা হয়েছিল। রজব তার হেফাজতে থাকা তক্ষকটি বেল্লালের কাছে বিক্রি করতে রাজি হচ্ছিল না। এর পরই হত্যাকাÐের ঘটনা ঘটে।
গত ২৭ জুলাই পাইকগাছায় সীমানা পিলার, তক্ষক সাপ ও প্রাইভেট কারসহ পাঁচ জন গ্রেফতার হয়েছিল। তাদের মধ্যে সাকিল ওরফে জুয়েল এবং বাবু ওরফে বাদশা বিভিন্ন সময় হাবিবুল্লাহর বাড়িতে আসত। ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা ধারণা করছেন- উদ্ধার হওয়া সীমানা পিলার ও তক্ষক সাপকে কেন্দ্র করেই আঁততায়ীরা তিন জনকে খুন করে। তাদেরকে পুলিশ হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে হত্যাকাÐের রহস্য উদঘাটন হতে পারে। যদিও দুর্বৃত্ব চক্রের ওই দুই সদস্যকে পুলিশ এই ট্রিপল হত্যা মামলায় শ্যোন এরেস্টের অনুমতি চেয়ে আদালতে আবেদন করেন নি। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে নিহতদের পরিবারের সদস্যরা জানান, পাইকগাছায় গ্রেফতারকৃত সীমানা পিলার বেঁচা-কেনা চক্রের সদস্য জুয়েল ও বাদশা হত্যাকাÐের আগে তারা নিহত হাবিবুল্লাহ গাজীর বাড়িতে মাঝে মধ্যে আসত। যা পরিবারের অন্য সদস্যরা ও এলাকাবাসী দেখেছে। তখন তারা সাকিল ও বাবু নামে পরিচিত ছিল। যাদের নাম হত্যাকাÐের পুলিশকে বললেও পুলিশ ভিন্ন নাম থাকায় গ্রেফতার করতে পারেনি। তবে পাইকগাছায় গ্রেফতার হওয়ার পর নিহতের পরিবারের সদস্যরা সোস্যাল মিডিয়ার তাদের ছবি দেখে চিনতে পারে, যে জুয়েল ও বাদশাই ছদ্ম নামধারী সাকিল ও বাবু।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, হত্যাযজ্ঞের কিছুদিন আগে আসামি আব্দুর রশিদ হাবিবুল্লাহর শশুর বাড়িতে যায়। সেখানে সে আলাপচারিতার এক পর্যায়ে বলেছিল- তাদের কথা না শুনলে মাল ও জীবন দুটোই যেতে পারে। তাকে পুনরায় পুলিশ হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি চেয়ে আদালতে আবেদন করার ব্যাপারে ভিকটিম পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি জানানো হয়েছে।
সেখানে লিখিত বক্তৃতা পাঠকালে বলা হয়, হত্যাকাÐের পর পুলিশ কয়েকজন সন্দিগ্ধ আসামিকে গ্রেফতার করে। এরপর প্রেস ব্রিফিং করে বলেন- বিকৃত যৌন লালশা, প্রতারণামূলক আর্থিক লেনদেন ও পরকীয়া সম্পর্কের টানাপোড়েনের জেরে ওই তিন জন খুন হয়েছেন। তদন্ত কর্মকর্তা জেলা ডিবি’র তৎকালীন ইনচার্জ ইন্সপেক্টর উজ্জল কুমার দত্ত জিয়াউর রহমানের বাড়ি থেকে কাঠের কুড়ালের আছাড়ি, আব্দুল ওহাবের বাড়ি থেকে কাঠের হাতল যুক্ত দা এবং রাজিয়া সুলতানার বাড়ি থেকে আরেকটি দা আলামত হিসেবে উদ্ধার করে জব্দ তালিকা তৈরি করেন। কিন্তু, তিনি সাংসারিক কাজে ব্যবহৃত ওই দুইটি দা এবং কুড়ালের আছাড়ি বাড়ি-বাড়ি যেয়ে সংগ্রহ করেন। গ্রামের কয়েকজন মোবাইল ফোনে ওই ঘটনার ভিডিও চিত্র ধারণ করেছিলেন। ইন্সরেপক্টর উজ্জল এলাকায় আতঙ্ক সৃষ্টি করে রেখেছিলেন। তার ভয়ে কেউ মুখ খোলার সাহস পেতেন না। কেউ হত্যাযজ্ঞের ব্যাপারে কথা বলতে চাইলেই তাকে তুলে নিয়ে যাবার হুমকি দিতেন।
পুলিশ জানায়, হত্যা মামলায় গ্রেফতার হওয়া ১৪ জন আসামির মধ্যে নয় জন কারাগারে আছেন। বাকীরা জামিনে মুক্ত হয়েছেন। হত্যার দায় স্বীকার করে তিন আসামি আদালতে জবানবন্দী দিয়েছে।