
সাতক্ষীরা প্রতিনিধি : ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ, শিক্ষা সংস্কারক ও সমাজহিতৈষী খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা। তিনি একজন উচ্চ স্তরের আউলিয়া ছিলেন। খানবাহাদুর আহছানউল্লা (র.) বাঙালি মুসলমানদের অহংকার এবং তাঁর কালের আলোকিত একজন মানুষ। তিনি দীর্ঘ আয়ুষ্কাল পেয়েছিলেন। তাঁর বিস্তৃত কর্মময় জীবন এখন ইতিহাসের অন্তর্গত। এই ক্ষণজন্মা মহাত্মন তাঁর জীবনের প্রায় পুরোটা সময় অনগ্রসর মুসলমানদের উন্নয়নের জন্য ব্যয় করেছেন। সেবা ছিল তাঁর জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য দিক। এই দেশ এবং জাতি খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লার (র.) এঁর কাছে নানাভাবে ঋণী। যাদের প্রচেষ্টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় তিনি ছিলেন তার অন্যতম। খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা তাঁর সমগ্র জীবনকালে যেমন নানা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছেন, তেমনি কলকাতার বিখ্যাত বেকার হোস্টেলসহ কলকাতা ও কলকাতার বাইরে অনেক ছাত্র-হোস্টেল স্থাপনেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। ১৮৭৩ সালের ২৭ ডিসেম্বর সুফী সাধক খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা সাতক্ষীরা জেলার কালিগঞ্জের নলতা মোবারকনগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। এটা তাঁর ১৫১তম জন্মবার্ষিকী। তাঁর জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে লায়ন্স ক্লাব অব ঢাকা ওয়েসিস’র সহযোগিতায় ও ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন স্বাস্থ্য সেক্টরের উদ্যোগে ঢাকার সাভারের বিরুলিয়ায় আজ ২৮ ডিসেম্বর মায়ের হাসি জেনারেল হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে দিনব্যাপী ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্পের আয়োজন করা হয়েছে।
খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লার পিতা মুন্সী মোহাম্মদ মুফিজ উদ্দীন একজন ধার্মিক, ঐশ্বর্যবান ও দানশীল ব্যক্তি ছিলেন। তার মায়ের নাম মোছা. আমিনা বেগম। তাঁর সমগ্র জীবন ছিল দৃষ্টান্তমূলক। পাঁচ বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার পূর্বে পাঠশালার গন্ডিতে প্রবেশের মাধ্যমে শিক্ষাজীবনে পদার্পণ করে নলতা মধ্য ইংরেজি বিদ্যালয়, টাকী গভর্নমেন্ট হাইস্কুল, কলিকাতার এল.এম.এস ইনস্টিটিউশনে পড়াশুনা করে ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে কৃতিত্বের সাথে বর্তমান এস.এস.সি সমমানের তৎকালীন এনট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরবর্তীতে তিনি হুগলী কলেজ থেকে ১৮৯২ সালে বর্তমানে এইচ.এস.সি সমমানের তৎকালীন এফ.এ এবং কলিকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৮৯৪ সালে বি.এ পাস করেন। এরপর ১৮৯৫ সালে তিনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন শাস্ত্রে এম.এ পাস করেন। কর্মজীবনে ১৮৯৬ সালে রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলে সুপারনিউমারি টিচার হিসেবে সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করেন। অল্প কিছুকালের মধ্যেই তিনি উচ্চতর বেতনে ফরিদপুরের অতিরিক্ত ডেপুটি ইন্সপেক্টর হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। ১৮৯৮ সালের ১ এপ্রিল খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.) বাকেরগঞ্জের ডেপুটি ইন্সপেক্টর পদে নিয়োগ পান। পরবর্তীতে তিনিই সর্বপ্রথম ইন্সপেক্টিং লাইন থেকে টিচিং লাইন-এর প্রভিন্সিয়াল সার্ভিসে অন্তর্ভুক্ত হয়ে ১৯০৪ সালে রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের হেড মাস্টার পদে নিযুক্ত হন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় তাঁর কর্মদক্ষতার স্বীকৃতি হিসেবে ১৯০৭ সালে চট্টগ্রাম বিভাগের ডিভিশনাল ইন্সপেক্টর পদে উন্নীত হয়ে দীর্ঘ ১৭ বছর যাবৎ চট্টগ্রাম অঞ্চলে শিক্ষার প্রভূত উন্নতি সাধন করেন। চট্টগ্রাম বিভাগে কর্মরত থাকাকালীন তিনি ইন্ডিয়ান এডুকেশন সার্ভিসে (আই.ই.এস) অন্তর্ভুক্ত হন। এরপর ‘বঙ্গদেশের মোছলেম শিক্ষার সহকারী ডিরেক্টর’ হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন এবং ৫ বছর এ পদে সুষ্ঠুভাবে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে কলকাতায় স্থানান্তরিত হওয়ার পর নিজ দায়িত্বের অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে তিনি কিছুদিন অবিভক্ত বাংলা ও আসামের শিক্ষা বিভাগের ডিরেক্টর পদে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯২৯ সালে ৫৫ বছর বয়সে সরকারি চাকরি থেকে তিনি অবসর গ্রহণ করেন।
খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.) এর শিক্ষা বিভাগের সহকারী পরিচালক হিসেবে নিয়োগ প্রাপ্তি বাংলার মুসলিম ইতিহাসে এক নতুন মাইল ফলক। এই দায়িত্ব প্রাপ্তির মধ্য দিয়ে মুসলিম শিক্ষার উন্নতি ও প্রসারের গুরু দায়িত্ব তাঁর উপর অর্পিত হয়। তিনিও তাঁর মেধা, বুদ্ধিমত্তা ও নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। মুসলিম শিক্ষার প্রতিবন্ধকতা ও অনাগ্রহ দূরীকরণে এবং অগ্রগতি সাধনের অনুকূলে উচ্চ পর্যায়ে নীতি নির্ধারণে তাঁর ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। নতুন দায়িত্বে যোগদানের পরপরই তিনি দীর্ঘদিন ধরে স্থগিত স্কিমসমূহ বাস্তবায়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। কলকাতার মুসলিম ছাত্রদের জন্য একটি স্বতন্ত্র কলেজ প্রতিষ্ঠার দাবি ছিল দীর্ঘদিনের। খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা দায়িত্ব গ্রহণের এক মাসের মধ্যেই মুসলমানদের জন্য একটি স্বতন্ত্র কলেজ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলেই প্রতিষ্ঠিত হয় ইসলামিয়া কলেজ। ইসলামিয়া কলেজ ছাড়াও তিনি বহু স্কুল, কলেজ ও হোস্টেল প্রতিষ্ঠা এবং উন্নয়নের সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তাঁরই উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় চট্টগ্রাম মুসলিম হাইস্কুল। ১৯২৮ সালে মোছলেম অ্যাংলো ওরিয়েন্টাল গার্লস কলেজ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান প্রশংসনীয়। এছাড়াও তাঁর প্রতিষ্ঠিত স্কুলগুলোর মধ্যে রয়েছে মুসলিম হাইস্কুল, চট্টগ্রাম (১৯০৯), মাধবপুর শেখ হাই স্কুল, কুমিল্লা (১৯১১), রায়পুর কে.সি হাই স্কুল (১৯১২), চান্দিনা পাইলট হাই স্কুল, কুমিল্লা (১৯১৬), কুটি অটল বিহারী হাই স্কুল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া (১৯২০), চন্দনা কে.বি হাই স্কুল, কুমিল্লা (১৯২০), চৌদ্দগ্রাম এইচ.জে পাইলট হাই স্কুল (১৯২১) উল্লেখযোগ্য। দীর্ঘ কর্মজীবনে শিক্ষা সংস্কারে অবদান রেখে অবসর গ্রহণের পর স্বদেশবাসীর ‘রূহানী খেদমত’ এবং সমাজসেবার ব্রত নিয়ে খানবাহাদুর আহছানউল্লা ১৯৩৫ সালের ১৫ মার্চ আহ্ছানিয়া মিশন নামে একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন, যার প্রধান কার্যালয় তাঁর জন্মভূমি সাতক্ষীরার কালিগঞ্জের নলতায় অবস্থিত। আহ্ছানিয়া মিশন মূলত খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.)-এঁর বিশ^াস, আদর্শ এবং অন্তর্গত সৌন্দর্যের বহিঃপ্রকাশ। তিনি মিশনের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য স্থির করেনÑ ‘¯্রষ্টার ইবাদত ও সৃষ্টের সেবা’।
খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা বাংলা ভাষা ও সাহিত্য, আত্মজীবনী, ধর্ম ও সৃষ্টিতত্ত্ব, রাসুলের (স.) জীবনী এবং পাঠ্যপুস্তকসহ ৭৯টি গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর রচিত আমার জীবনধারা (১৯৪৬) বাংলা ভাষায় আত্মজৈবনিক রচনাসমূহের মধ্ উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। তাঁর ভাষা প্রাঞ্জল ও হৃদয়গ্রাহী
খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা তাঁর কর্মক্ষেত্রে দক্ষতার স্বীকৃতি অল্প সময়ের মধ্যেই অর্জন করেন। ১৯১১ সালে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক তাঁকে ‘খানবাহাদুর’ উপাধি প্রদান করা হয়। তিনি চাকরিতে প্রবেশের মাত্র ১৫ বছরের মধ্যে এই সাফল্য অর্জন করেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মুসলিম সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্য ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এক দশকেরও বেশি সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কোটের (বর্তমান সিনেট) মেম্বার ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রস্তুতি লগ্নে ড. নাথান সাহেবের অধীনে টিচিং কমিটির মেম্বার ছিলেন। বাংলা সাহিত্যে বিশিষ্ট ও বহুমুখী অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ বাংলা একাডেমি তাঁকে ১৯৬০ সালে সম্মানসূচক ফেলোশিপ প্রদান করে। সমাজ সেবা ও সমাজ সংস্কৃতিতে বিশেষ করে দীন প্রচারের কাজে অবদানের জন্য ইসলামী ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ তাঁকে ১৪০৪ হিজরীতে মরণোত্তর পুরস্কারে ভূষিত করে।
বাংলার মুসলমানদের আধ্যাত্মিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে তিনি তাঁর জীবনের অধিকাংশ সময় ব্যয় করেছেন। ১৯৬৫ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার সকাল ১০টা ১০ মিনিটে ৯২ বছর বয়সে সাতক্ষীরা জেলার নলতায় তিনি ইন্তেকাল করেন।
হজরত খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.) ছিলেন একজন বড় মাপের শিক্ষক, শিক্ষা সংস্কারক, শিক্ষা প্রশাসক এবং একই সঙ্গে সাধক। তিনি পূর্ব বাংলার খুলনায় জন্ম গ্রহণ করেন।তবে বেশিরভাগ লেখাপড়া করেছেন কলকাতায়। কলকাতার লন্ডন মিশন সোসাইটি স্কুল, প্রেসিডেন্সি কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি চাকরি জীবন শুরু করেন পূর্ব বাংলায় রাজশাহীর কলেজিয়েট স্কুলে সুপার নিউমারারি টিচার হিসাবে। তারপর তিনি পূর্ব বাংলার নানা প্রান্তে শিক্ষা প্রশাসক হিসাবে অ্যাসিসটেন্ট ডিপিআই এবং ডিপিআই হিসাবে কাজ করেছেন। তিনি বেশির ভাগ কাজ করেছেন চট্টগ্রাম ও কুমিল্লা এলাকায়। এসময় তিনি অসংখ্য প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন। কত স্কুল যে তিনি গড়ে তুলেছিলেন সেটা হয়তো বলে শেষ করা যাবে না। কলেজ গড়বার ক্ষেত্রেও তাঁর অবদান অপরিসীম। বিশেষ করে, কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজ গড়বার সময়ে তিনি বড় ভূমিকা পালন করেছেন। এই কলেজেই বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পড়াশোনা করেছেন। এই কলেজের বেকার হোস্টেলটিও গড়বার জন্য তিনি বড় ভূমিকা পালন করেছেন। সবচেয়ে উল্লেখ করার মতো ভূমিকা রেখেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময়।
ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় গড়বার লক্ষ্যে যে নাথান কমিশন তৈরি হয়েছিল তার একটি সাব-কমিটির সদস্য ছিলেন খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.)। পরবর্তীকালে ব্রিটিশ সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট তৈরি করার জন্য ৯ সদস্যের যে কমিটি করেছিলেন সেই কমিটিরও তিনি একজন সদস্য ছিলেন। তিনি আজীবন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য কাজ করেছেন। এই দুটো বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনি সিনেট সদস্য ছিলেন। সেই সমটায় পূর্ব বাংলার শিক্ষা ও অর্থনীতি অনেক অনগ্রসর ছিল। বিশেষ করে শিক্ষাক্ষেত্রে আমাদের অনগ্রসরতা ছিল প্রকট। এই সময়টি তিনি লক্ষ করেছিলেন যে, পূর্ব বাংলায় সত্যি সত্যি যদি উন্নয়ন করতে হয়, যদি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হয় তাহলে শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন করতে হবে। এজন্য পূর্ব বাংলায় অসংখ্য মাদ্রাসা, স্কুল ও কলেজ গড়ে তুলবার ক্ষেত্রে তার ভূমিকা ছিল অপরিসীম এবং শিক্ষাক্ষেত্রেও তিনি অনেকগুলো আমূল সংস্কারের সাথে যুক্ত ছিলেন। যেমন একসময় আইএ, বিএ ও এমএ সকল পরীক্ষার খাতায় শিক্ষার্থীদের নাম লিখতে হতো। নাম লেখা থাকলে হিন্দু ও মুসলিম বৈষম্য সৃষ্টি করার সুযোগ ছিল। সুতরাং তিনি প্রস্তাব করলেন পরীক্ষার খাতায় নাম থাকবে না। শুধু রোল নাম্বার থাকবে এবং এই সংস্কারটি ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ ও আধুনিক সংস্কার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সামগ্রিকভাবে পূর্ব বাংলার যে মধ্যবিত্ত, সেই মধ্যবিত্ত গড়ে তুলবার জন্য এই বিশ্ববিদ্যালয়টির ভূমিকা ছিল অপরিসীম। ১৯১১ সালে যখন বঙ্গভঙ্গ রদ হয়ে গেল তখন এই পূর্ব বাংলার মধ্যবিত্তদের মধ্যে এক ধরনের ক্ষোভ ছিল। সেই ক্ষোভ নিরসনের জন্য ব্রিটিশরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় যাদের অবদান খুব গুরুত্বপূর্ণ তাদের মধ্যে তিনিও ছিলেন। আরও ছিলেন নওয়াব আলী, শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক ও স্যার সলিমুল্লাহ। তাদের সাথে মিলে তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য বহুমাত্রিক কাজ করেছেন। আর আমরা তো জানি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরবর্তীকালে আমাদের জাতিসত্ত্বা, আমাদের ভাষা আন্দোলন এবং বাংলাদেশ সৃষ্টির একটি কেন্দ্র বিন্দুতে রূপান্তরিত হয়েছিল। সুতরাং এই বিশ্ববিদ্যালয়টি আমাদের স্বাধীনতার সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। সেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় তিনি বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছেন।
তিনি শুধু শিক্ষা সংস্কারক বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা-ই ছিলেন না, ছিলেন তিনি একজন ভালো লেখকও। অসংখ্য বই তিনি লিখেছেন এবং অন্যের অসংখ্য বইও প্রকাশ করেছেন তাঁর প্রকাশনী থেকে। তিনি মখদুমী লাইব্রেরীটি স্থাপন করেছিলেন এবং পরবর্তীকালে তিনি তাঁর আহ্ছানউল্লা বুক হাউস লিমিটেড থেকে আমাদের দেশের অসংখ্য বিখ্যাত উপন্যাস যেমন আনোয়ারা, বিষাদ সিন্ধু, কাজী নজরুল ইসলামের জুলফিকার, বনগীতি, কাব্যে আমপারা; আবু জাফর শামসুদ্দীনের পরিত্যক্ত স্বামী তিনি প্রকাশ করেছিলেন। এসব বই প্রকাশ করে তিনি পূর্ব বাংলার শিক্ষিত মধ্যবিত্তের মানস গঠনে ও মুসলিম সাহিত্য চর্চায় আধুনিকতা এবং সমাজলগ্নতা আনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
এই সময়টায় তিনি তার সুখ্যাত প্রতিষ্ঠান আহ্ছানিয়া মিশন তাঁর নিজ গ্রাম সাতক্ষীরার নলতায় শুরু করেছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি ঢাকায় এসে ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন নামেও একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। আমরা সবাই জানি, প্রতিষ্ঠান খুব গুরুত্বপূর্ণ। একলা মানুষ টুকরা মাত্র। কিন্তু অনেকে মিলে একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সমাজ, সংস্কৃতি এবং অর্থনীতি উন্নয়ন করা যায়। সেই বিচারে ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন বাংলাদেশের অর্থনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতি, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এখনও তা করে যাচ্ছে।
আমি গভর্নর হিসেবে যখন বাংলাদেশের আর্থিক খাতের সাথে জড়িত ছিলাম তখন দেখেছি, আহ্ছানিয়া মিশনের ক্যান্সার হাসপাতাল গড়ে তুলবার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ব্যাংক বড় ভূমিকা পালন করেছে। আমি তাদের উৎসাহিত করেছি। আমার জানা মতে, খন্দকার ইব্রাহিম খালেদ খুবই গুরুত্ব দিয়ে এই হাসপাতালটি গড়ে তোলার জন্য তার নিজের পূবালী ব্যাংক ও অন্যান্য ব্যাংককে উৎসাহিত করেছেন। এছাড়াও আহ্ছানিয়া মিশন সমাজের নানা ক্ষেত্রে বড় ধরনের কাজ করছে। সুতরাং এই শিক্ষাবিদ এবং এই সংস্কারক খুব স্বাভাবিকভাবেই আমাদের এই পূর্ব বাংলার মধ্যবিত্তদের মনে গেঁথে আছেন। সেই জন্য তিনি পুরস্কৃতও হয়েছেন। বাংলা একাডেমির সম্মানসূচক ফেলোশিপ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের মরণোত্তর পুরস্কারে তিনি ভূষিত হন। তাছাড়া তাঁর প্রতিষ্ঠিত ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার অর্জন করে।লেখক: অর্থনীতিবিদ ও সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক।
ADVERTISEMENT
তাঁকে বরাবরই শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি। তিনি সেই সব জায়গায় কাজ করেছেন, যেখানে কাজ করলে মানুষের মনের ওপর প্রভাব ফেলা যায়। শিক্ষাই মানুষের মন ও মননের পরিবর্তন ঘটায়। শিক্ষা ও জীবন আলাদা হতে পারে না। সে কারণেই একটি মানবিক ও অর্থনীতি সমৃদ্ধ সমাজ বিনির্মাণের জন্য তিনি সব সময় কাজ করেছেন শিক্ষা নিয়ে। শিক্ষার প্রসারে তিনি অনেক গুরুত্ব দিয়েছেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়বার জন্য তিনি নিরলস কাজ করেছেন। এই কারণে তার যারা উত্তরসূরি তারা এখনো তাকে স্মরণ করে শিক্ষার ক্ষেত্রে তার অবদানের জন্য এবং সংস্কারের জন্য।
আমি জেনে খুব আনন্দিত যে, ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্যদিয়ে ডিসেম্বর মাসব্যাপী খানবাহাদুর আহ্ছানুল্লাহর ১৫০তম জন্মবার্ষিকী পালন করছে। এই জন্মবার্ষিকী উদযাপনকে কেন্দ্র করে তাঁর অবদানগুলো সকলের সামনে নিয়ে আসতে হবে। এভাবেই আমরা তাকে তরুণ প্রজন্মের কাছে উপস্থাপন ও তাদের মনে তাঁর ভাবনাগুলো গেঁথে দিতে পারি। খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লাহর (র.) নৈতিকতাকে আমাদের সমাজ এবং শিক্ষায় আরো বেশি প্রতিফলিত করে তুলতে পারলে এটি হবে তাঁর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা প্রদর্শনের বড় উপায়। কেননা, শিক্ষার মূল লক্ষ্যই হচ্ছে নীতিবান ভালো মানুষ গড়ে তোলা। আজীবন তিনি সেই কাজটিই করেছেন। আমরাও যেন তাঁর কাছ থেকে এই শিক্ষাটিই গ্রহণ করতে পারি।

