
মোঃ এজাজ আলী : দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের তথা খুলনাঞ্চলের মানুষের কাছে জনপ্রিয় মসলা হয়ে উঠছে চুইঝাল। এ মসলার সঙ্গে আস্ত রসুন দিয়ে গরু, খাসি কিংবা হাঁসের মাংস রান্না যেন এ অঞ্চলের ঐতিহ্য। আর সেই খাবার পরিবেশন করে এরই মধ্যে খুলনা ও রাজধানী ঢাকার বেশ কয়েকটি রেস্তোরাঁ ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। প্রতিদিন খুলনার বিভিন্ন এলাকা তো বটেই, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকেও এ খাবারের স্বাদ রোস্তোরাঁগুলোতে ছুটে আসেন ভোজনরসিকেরা। নিরামিষ ভোজীরাও তাদের খাদ্য তালিকায় চুইঝাল রাখছেন। স্বাদ ও ঘ্রাণ বাড়াতে হালিম, চটপটি ও ঝালমুড়িতেও ব্যবহার হচ্ছে মসলাটি। অনেকে আবার সাধারন তরকারিতেও এটি ব্যবহার করেন। ফলে দেশজুড়ে কদর বেড়ে যাওয়ায় বেশ কিছু এলাকায় বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে লতাজাতীয় গাছ চুইঝালের, যা এখন দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের একটি সম্ভামনাময় কৃষিপণ্য। তাই এটিকে খুলনার কৃষিপণ্য হিসেবে ব্র্যান্ডিংয়ের জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে। খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার চুকনগর বাজারে আব্বাসের হোটেল চুইঝাল দিয়ে রান্না করা খাসির মাংসের জন্য দেশ বিদেশেও নাম ছড়িয়েছে। এ মসলার সাহায্যে রান্না করা মাংস খুলনার জিরোপয়েন্ট, সোনাডাঙ্গা এলাকা ছাড়িয়ে এখন রাজধানী ঢাকায়ও প্রসার লাভ করেছে। কৃষিবিদরা বলছেন, চুইঝাল দেখতে অনেকটা পানের লতার মতো। তবে পাতায় ঝাল নেই। মূলত লতার শিকড়, কান্ড ও ডাল কেটে রান্নায় ব্যবহার করা হয়। রান্নার পর কিছুটা গলে যাওয়া চুইয়ের টুকরো চুষে বা চিবিয়ে খাওয়া হয়, যা স্বাদে ঝাল ঝাল। তবে সেই ঝালের আছে ভিন্ন রকমের মাদকতা। তরকারির স্বাদকে বাড়িয়ে দেয় দ্বিগুন। খুলনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোঃ হাফিজুর রহমান বলেন, চুইঝালের ওৗষধিগুন থাকায় এর চাহিদা ও ব্যবহার দিন দিন বেড়েই চলেছে। বড় হচ্ছে এর বাজার, চুইলতার চারা উৎপাদন বাণিজ্যও বেশ সাড়া জাগিয়েছে। বিভিন্ন গ্রামে গড়ে উঠছে ছোট বড় নার্সারি। ২০২১-২২ অর্থবছরে জেলার ডুমুরিয়া ও বটিয়াঘাটা উপজেলায় ৬০ হেক্টর জমিতে চুইয়ের চাষ করা হয়। বর্তমানে বিভাগের চার জেলা খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা ও নড়াইলে মোট ৯৯ দশমিক ৭ হেক্টর জমিতে মসলাজাতীয় এ ফসলটির চাষ হচ্ছে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা প্রায় ১৯০ টন। এসব জেলায় সাড়ে তিন হাজার কৃষক চুইচাষের সঙ্গে সম্পৃক্ত। ২০২০-২১ অর্থবছরে খুলনার সাড়ে ৫৫ হেক্টর জমিতে চুইয়ের চাষ হয়েছিল। ২০১৯-২০ অর্থবছরে চাষ হয় ৪৭ হেক্টর জমিতে। তার আগের দুই অর্থবছরে যথাক্রমে ৪১ ও ৩৫ হেক্টর জমিতে ফসলটি চাষ করেছিলেন কৃষকরা। খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা ও নড়াইলে ২০২০-২১ অর্থবছরে মোট ৮৯ হেক্টর জমিতে চুইয়ের চাষ হয়েছিল। এছাড়া ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৮০ হেক্টর, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৭৪ হেক্টর, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে চাষ হয় ৬০ হেক্টর জমিতে। জেলা কৃষি সম্প্রসারন কার্যালয়ের তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে খুলনার পাইকগাছা, ডুমুরিয়া, বটিয়াঘাটা ও রূপসমা উপজেলায় চুইয়ের চারা উৎপাদন হয়। গড়ে উঠেছে ছোট বড় নার্সারি। তিনমাসের মধ্যেই চুইচারা বিক্রি শুরু করা যায়। একেকটি চারা তৈরিতে খরচ হয় ৩ থেকে সর্বোচ্চ ১০ টাকা। আর বিক্রি ৩৫-৩৪ টাকায়। এক বিঘা জমিতে লাগানো যায় ৬২০ টি চারা। হাজার পঞ্চাশেক টাকা খরচ করলে একজন চাষী দেড়লাখ টাকার মতো চারা বিক্রি করতে পারেন। লাগানোর এক বছর পরই সে গাছ থেকে আয় আসা শুরু হয়। আবাদ লাভজনক হওয়ায় জেলার বিভিন্ন গ্রামের পাশাপাশি যশোর, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরায়ও ব্যাক্তিগত ও বাণিজ্যিক দুভাবেই এর চাষ বাড়ছে। মাছের ঘেরের আইলেও চুইয়ের চাষ করছেন কেউ কেউ। দু-তিন শতক জমিতে চুই লাগালে তিন চার বছরের মধ্যেই ৪ লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করা সম্ভব বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার বান্ধা এলাকার অশোক বৈরাগী জানান, ২০১২ সালের দিকে তিনিই প্রথম এ অঞ্চলে চুইঝালের ডগা কেটে মাটিতে লাগিয়ে বাণিজ্যিকভাবে চারা উৎপাদনে সফল হন। এরপর স্থানীয় কৃষি বিভাগের সহায়তায় তারা চারা উৎপাদনের পদ্ধতি ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন জেলা উপজেলায়। খুলনার কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, প্রতি কেজি চুই মানভেদে ৩০০ থেকে ১ হাজার ৭০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। ঈদের বাজারে এর দাম ২ হাজার টাকাও ছাড়িয়ে যায়। তবে মাটির নীচের অংশের শিকড় চুইয়ের দাম সবচেয়ে বেশি। কান্ড-ডালও ভালো দামে বিক্রি হয়। নগরীর গল্লামারী কাঁচা বাজারে প্রায় ৩৫ বছর ধরে চুই বিক্রি করেন শুকুর আলী বিশ্বাস। তিনি জানান, রংপুর, কুড়িগ্রামের পাইকার ছাড়াও খুলনার ডুমুরিয়া, যশোরের কেশবপুর, মনিরামপুর ও বাগেরহাটের ফকিরহাট এলাকার চাষী –গৃহস্থদের কাছ থেকে চুই কিনে বিক্রি করেন। আগের থেকে চুইয়ের চাহিদা চারগুন বেড়েছে বলেও তিনি জানান।চাহিদা বাড়ায় বর্তমানে অনলাইনেও এখন মসলাটি বিক্রি হচ্ছে।