রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় বেড়েছে খুন, ডাকাতি, ধর্ষণ ও অস্ত্র ব্যবসা
গ্রেফতারকৃতদের প্রায় সবাই মাদকসেবী, বলছে পুলিশ
শেখ আব্দুল হামিদ : দীর্ঘদিন শান্ত থাকার পর আবারও খুলনা বিভাগে অপরাধমূলক তৎপরতা বেড়েছে। ধর্ষণ, চুরি, মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, জুয়ার ভাগবাঁটোয়ারা, অস্ত্র ব্যবসা নিয়ে বিরোধের কারণে হত্যাকাণ্ডসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সংঘটিত হচ্ছে। এসব অপরাধমূলক কর্মকান্ডের অনেকগুলোই ঘটছে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায়। অপরাধীদের প্রায় সবাই নানা ধরণের মাদকে আসক্ত। বিশেষ করে মাদক চোরাচালানে সড়ক পথে কড়াকড়ি আরোপেরে ফলে মাদক কারবারিরা এখন নৌপথকে বেছে নিয়েছে। টেকনাফ এবং কক্্রবাজার থেকে ইয়াবার বড় চালানগুলো এখন জাহাজে করে বরিশাল বিভাগের বিভিন্ন জেলা হয়ে খুলনায় পাঠান হচ্ছে। যারা এসব ব্যবসার সাথে জড়িত তাদের অনেকেই রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে যাচ্ছেন। যার কারণে প্রশাসন অনেক সময় অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেন না।
কেএমপি কমিশনার মো: মোজাম্মেল হকও স্বীকার করেন, এ ব্যাপারে সামাজিক দায়বদ্ধতা আছে। আমাদের সন্তানরা কে কোথায় থাকে, কি করে তারা মাদকাসক্ত কিনা এ ব্যাপারে নজর রাখতে হবে। যাদের গ্রেফাতার করছি দেখা যাচ্ছে তাদের অধিকাংশই মাদকাসক্ত। আমাদের মাদক বিরোধী অভিযান চলছে।
॥ সম্প্রতি ঘটে যাওয়া অপরাধমূলক তৎপরতা ॥
সম্প্রতি খুলনা বিভাগে খুন-ধর্ষণসহ চাঞ্চল্যকর বেশ কয়েকটি অপরাধমূলক ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে গত ১১ ফেব্রুয়ারি পাইকগাছা উপজেলার রাড়ুলী গ্রামে মধ্যবয়সি গৃহবধূ মুখে-চোখে সুপারগ্লু ও মুখে স্কপটেপ লাগিয়ে ধর্ষণ ও শারীরিকভাবে জখম করেছে দুর্বৃত্তরা। আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাকে খুলনা মেডিকেল কলেজ (খুমেক) হাসপাতালের সার্জারি বিভাগে ভর্তি করা হয়।
গত ২৩ জানুয়ারী সন্ধ্যা ৭টার দিকে খুলনা মহানগরীর ময়লাপোতা মোড়ের আহছানউল্লাহ্ কলেজের সামনে সন্ত্রাসীদের গুলিতে শেখ মো: সাদেকুর রহমান রানা ওরফে বিহারী রানা নামে এক যুবক নিহত হয়। মাদক ব্যবসা ও এলাকার কর্তৃত্ব নিয়ে তাকে হত্যা করা হয়েছে বলে পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে উঠে এসেছে। সে শীর্ষ সন্ত্রাসী ও হত্যা মামলার সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামী গ্রেনেড বাবুর একান্ত সহযোগী ছিল বলে জানা গেছে।
গত ৬ জানুয়ারী নগরীর খানজাহানআলী থানার মশিয়ালী গ্রাম থেকে আবুল কালাম আজাদ নামে এক ইজিবাইকচালকের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় গ্রেফতার আসামীরা পুলিশকে জানায়, নগরীর রূপসা ঘাট থেকে আজাদের ইজবাইক রিজার্ভ করে মশিয়ালী নামক স্থানে নিয়ে যায়। সেখানে তারা তাকে শ^াসরোধে হত্যার পর লাশ সরিষাখেতে ফেলে দিয়ে ইজিবাইক নিয়ে পালায়।
গত ১৪ ফেব্রুয়ারি স্বরস্বতী পুজা দেখানোর নাম করে বটিয়াঘাটা উপজেলার সুখদাড়া গ্রাম থেকে বিপ্লব হালদারসহ চার যুবক এক স্কুল পড়ুয়া ছাত্রীকে ফুসলিয়ে নিয়ে যায়। তাকে সুখদাড়া উত্তর বিলে সারারাত আটকে রেখে ধর্ষণ করে। পরের দিন ভিকটিমের মা চঞ্চলা বাদী হয়ে থানায় মামলা করেন।
গত ১৬ ফেব্রুয়ারি বটিয়াঘাটার কিসমতফুলতলা গ্রামের মাদক ব্যবসায়ী শাহীন বিশ^াস পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়। পুলিশ জানায়, শাহীন দেবীতলা গ্রামের একট কলেজপড়ুয়া ছাত্রীকে কলেজে যাওয়াার পথে জোরপূর্বক তুলে নিয়ে যায়। পরে ওই ছাত্রী ছাড়া পেয়ে তার অভিভাবকদের জানায়। তার বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা হয়েছে।
॥ জড়িত জনপ্রতিনিধিরাও ॥
শুধু হত্যাকাণ্ড বা অস্থবাজিই নয়, ধর্ষণ ও নারী-শিশু নির্যাতনের ত গুরুতর অপরাধের ঘটনা বেড়েই চলেছে। এসব অপরাধের ঘটনায় জনপ্রতিনিধিরাও জড়িয়ে পড়ছেন। গত ১১ জানুয়ারী রাতে এক তরুণী ডুমুরিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান ও আওয়ামীলীগ নেতা গাজী এজাজা আহমেদের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ এনে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়াট স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) ভর্তি হন। এর পরের দিন ওই তরুণী ও তার মাকে হাসপাতালের সামনে থেকে জোরপূর্বক মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। ঘটনা স্থল থেকে স্থানীয়রা ডুমুরিয়ার রুদাঘরা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান এজাজের চাচাত ভাই গাজী তৌহীদুজ্জামানকে আটক করে পুলিশে দেয়।
গত ২ ফেব্রুয়ারি দুপুরে সুজাতা মন্ডল ও রাতে সীমা খাতুন নামে খুলনার এশিয়ান নর্সিং কলেজের দ্ইু ছাত্রীর ঝুলান্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। গত ২৭ জানুয়াারী ডুমুরিয়া উপজেলার গুটুদিয়া ইউনিয়নের কমলপুর গ্রামে ডলি বেগম নামে এক গৃহবধু তার ছয় বছর বয়সী মেয়ে ফাতেমা ও সাত মাস বয়সী ছেলে ওমরকে বালিশ চাপা দিয়ে হত্যার পর নিজে আত্মহত্যা করেন।
বাগেরহাটের ফরিকরহাটে দুই তরুণীকে আটকে রেখে পালাক্রমে ধর্ষণের অভিযোগে গত ১৪ জানুয়ারী সন্ধ্যায় মো. শাকির সরদার নামে এক ছাত্রলীগ নেতাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এছাড়া গত ১৯ জানুয়ারী একই উপজেলায় এক কিশোরীর গোসলের ভিডিও ধারণ করে ২ লাখ টাকা চাঁদা দাবী করায় ওহিদ মোড়ল নামে এক যুবককে গ্রেফতার করে পুলিশ।
॥ যা বলছেন বিশেষজ্ঞ ও পুলিশ প্রশাসন ॥
খুলনা বিশ^াবিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. তানভীর আহমেদ সোহেল বলেন, আমাদের পারিবারিক অনুশাসন কমে যাওয়ার পাশাপাশি সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটেছে। উঠতি বয়স্কদের মধ্যে গ্যাং কালচার বেড়ে গেছে। খেলাধুলার মাঠ কমে যাওয়ায় সুস্থ বিনোদনের অভাবে তরুণরা অপরাধে জড়িত হওয়ারও বড় একটা কারণ। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে এ ব্যপারে আরেকটু কঠোর ভূমিকা পালন করতে হবে।
খুলনা মহানগরীতে অপরাধ বৃদ্ধির বিষয়ে খুলনা মেট্রোপলিটন পুরিশের (কেএমপি) কমিশনার মো. মোজাম্মেল হক বলেন, আত্মহত্যার ব্যাপারটি সাইকোলজিক্যাল ব্যাপার। তবে, খুন ধর্ষণ অবশ্যই অপরাধ। মাঝে মধ্যেই এ ধরণের ঘটনা ঘটে। এ ধরণের ঘটনা ঘটলে আমরা ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। তবে সামাজিক দায়বদ্ধতাও আছে। আমাদের সন্তানরা কে কোথায় থাকে, কি করে, তারা মাদকাসক্ত কিনা এ ব্যাপারে নজর রাখতে হবে। যাদের গ্রেফতার করছি তাদের অধিকাংশই মাদকাসক্ত। আমাদের মাদক বিরোধী অভিযান চলছে। কিন্তু আমাদের অভিভাবকদের সচেতন থাকতে হবে। আবার সামাজিক ভাবেও প্রতিরোধ করতে হবে। খেলার মাঠ ও চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা করা গেলে অপরাধপ্রবণতা কমে যাবে। পাশাপাশি অভিভাবকদের সন্তানদের সময় দিতে হবে।