
ইয়াসীন আরাফাত রুমী
বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন পহেলা বৈশাখ। মধ্যরাতে ডুমুরিয়া উপজেলার শোভনা গ্রাম থেকে দশম শ্রেণির স্কুলছাত্রী অর্পিতা মল্লিক জয়ার ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
চলতি বছর ৬ এপ্রিল খুলনার পাইকগাছায় নিজ ঘরের আড়ার সাথে গলায় রশি দিয়ে আত্মহত্যা করেছে নববধূ আঁখি। এখবর শুনে তার স্বামী শিহাব গাজীও আত্মহত্যার চেষ্টা চালায়। মাত্র ৩ মাস আগে তাদের প্রেম করে তাদের বিয়ে হয়।
৪ এপ্রিল ডুমুরিয়া উপজেলার গুটুদিয়া ইউনিয়নের নিজ বাড়িতে কুয়েট টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৩য় বর্ষের অন্তু রায় আত্মহত্যা করেন। পরিবারে আর্থিক অনটনের কারণে হলের বকেয়া টাকা দিতে না পারায় সে আত্মহত্যা করে।
পাইকগাছায় প্রেমঘটিত বিষয় নিয়ে ২ এপ্রিল গলায় ওড়না পেঁচিয়ে ঘরের আড়ার সাথে ঝুলে আত্মহত্যা করে প্রিয়া।
২০২১ সালের ১৭ নভেম্বর দুপুর বেলায় ব্যক্তিগত হতাশায় খানজাহান আলী থানা এলাকায় ট্রেনের নীচে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন কুয়েট আর্কিটেকচার বিভাগের ১ম বর্ষের শিক্ষার্থী সুব্রত কুমার। ২০১৯ সালের ২৬ফেব্রæয়ারি রূপসার সামন্তসেনায় মনির ফয়সাল শুভ গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে।
খুলনায় প্রতিদিন গড়ে অন্তত একজন আত্মহত্যা করেন। আত্মহত্যার চেষ্টা করেন আরো বেশি। করোনাকালে এই প্রবণতা আরও বেড়েছে। দারিদ্র্য, প্রেমে ব্যর্থতা, হতাশা, পারিবারিক কলহ, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অপব্যবহারসহ বেশ কিছু সুনির্দিষ্ট কারণে আত্মহত্যার ঘটনা বেড়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
গত ৩বছরে খুলনায় ১৭৩৩টি অপমৃত্যুর ঘটনার মধ্যে ১০৩৬টি ছিল আত্মহত্যা। গড় হিসাবে খুলনায় প্রতিদিন একজন আত্মহত্যা করছে। স্বজনরা সময়মতো চিকিৎসাকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ায় অনেকের জীবন রক্ষা হয়। জেলায় আত্মহত্যায় মৃত্যুর ঘটনা উদ্বেগজনক পর্যায়ে চলে গেছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে হারে আত্মহত্যা বাড়ছে, সে হারে সচেতনতা বাড়ছে না। করোনার মাঝে আত্মহত্যার প্রবনতা অনেকটাই বেড়ে যায়-এমন তথ্য জানিয়েছেন খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র।
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তথ্য মতে, অপমৃত্যুর ঘটনাগুলোর মধ্যে ৬০ থেকে ৬৫ ভাগই আত্মহত্যা। ২০১৯ সালে খুলনায় ৬২৫ টি অপমৃত্যুর ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে আত্মহত্যা ছিল ৩০০ টি। ২০২০ সালে ৪৪৫টি অপমৃত্যুর মধ্যে আত্মহত্যা ছিল ২৮০টি। ২০২১ সালে অপমৃত্যু ৫৫৯টি আত্মহত্যা ছিল ৩৮৭টি । ২০২২ সালের জানুয়ারিতে অপমৃত্যু সংখ্যা ৫৩টি যেখানে আত্মহত্যার সংখ্যা ৩৫টি, ফেব্রæয়ারিতে ৫১ টি অপমৃত্যুর মধ্যে আত্মহত্যা ৩৪ টি।
আর এই আত্মহত্যার সংখ্যা জেলার ডুমুরিয়া উপজেলাতে সবথেকে বেশি। ডুমুরিয়া থানার রেকর্ড বুক থেকে জানা গেছে, চলতি বছরে সাড়ে তিনমাসে উপজেলায় ২৫ জন আত্মহত্যা করেছেন। এরআগে ২০২১ সালে ৭৬ জন, ২০২০ সালে ৭৪ জন, ২০১৯ সালে ৬৫ ও ২০১৮ সালে ৫৬ জন আত্মহত্যা করেছেন।
খুলনা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক কর্মকর্তা (আরএমও) ডা. সুহাস রঞ্জন হালদার বলেন, ‘করোনার আগে এ হাসপাতালের তথ্যে আত্মহত্যার হার ছিল ৪৫ শতাংশ। চলতি বছর তা ৬৬ শতাংশে গিয়ে পৌছেছে। মানসিক দুশ্চিন্তা ,পারিবারিক কলহ, বেকারত্ব, প্রেমে ব্যর্থতা ইত্যাদি আত্মহত্যার মূল কারণ। আত্মহত্যাকারীদের মধ্যে নারীর সংখ্যা বেশি।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমাদের সমাজে পিতা-মাতা তাদের সন্তানদের সময় দিচ্ছেন না। স্বামী স্ত্রীকে রেখে বিদেশ চলে যাচ্ছে, ফলে ঘরে অশান্তি বাড়ছে। করোনাকালীন সময়ে চাকরি বা রোজগার হারানোর কারণে হতাশা থেকেও আত্মহত্যার ঘটনা বেড়েছে। এছাড়া খুবই তুচ্ছ বিষয় নিয়ে আত্মহত্যার ঘটনা দেখা যায়। বাবা-মা মোবাইল ফোন বা মোটর সাইকেল কিনে না দেয়ায় সন্তান আত্মহত্যা করেছে। প্রেমে ব্যর্থতা, পরীক্ষায় অকৃতকার্য, পরিবারের সদস্যদের উপর অভিমান করে আত্মহত্যা করছে টিনএজাররা। আবার ঋণগ্রস্ত হয়ে আত্মহত্যা করার মত ঘটনাও রয়েছে। আর পরকিয়ার জেরে আত্মহত্যা করার অসংখ্য নজির রয়েছে।
খুলনা বিএল কলেজের সামাজ বিজ্ঞান বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন বলেন, যারা আত্মহত্যা করেন তারা সামাজিক ও মানসিকভাবে অতিরিক্ত বিষন্নতায় ভোগেন। আত্মহননকারী ব্যক্তি নিজেকে পৃথিবীতে অর্থহীন মনে করেন। শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে ও সাধারণ মানুষকে যথাযত কাউন্সিলিং করা গেলে এই প্রবণতা কমে আসবে।
মহিলা অধিদপ্তর খুলনার উপ-পরিচালক হাসনা হেনা বলেন, নারী স্বাবলম্বী না হলে পরিবারের নানামুখী অশান্তি সৃষ্টি হয় আর এ কারণেই নারীরা আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। স¤প্রতি, শিশু কিশোরদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবনতা বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মেখলা সরকার মনে করেন, খুলনায় আত্মহত্যার হার কেন বেশি, তা নিয়ে গবেষণা প্রয়োজন। কারো জিনের মধ্যে হতাশা, মানসিক অস্থিরতার বিষয়টি থাকতে পারে। আমাদের পারিবারিক, সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। তাহলে সমাজ থেকে অপরাধ ও অপরাধী দুটোই কমবে।’