জন্মভূমি রিপোর্ট : আমানতের সুরক্ষার অংশ হিসেবে ব্যাংকগুলোকে বিতরণকৃত ঋণের বিপরীতে নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) সংরক্ষণ করতে হয়। সঞ্চিতি রাখতে হয় ব্যাংকের অর্জিত পরিচালন মুনাফা থেকে। কোনো ব্যাংকের সঞ্চিতি ঘাটতি থাকার অর্থ হলো ওই ব্যাংকের আর্থিক ভিত দুর্বল। দেশের ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের উল্লম্ফনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সঞ্চিতি ঘাটতির পরিমাণ বেড়েই চলছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত বছরের জুন শেষে ব্যাংক খাতে সঞ্চিতি সংরক্ষণের অনুপাত ৭৮ দশমিক ৭৬ শতাংশে নেমে এসেছে। দেশের ব্যাংক খাতে সঞ্চিতি সংরক্ষণের এত নিম্ন হার অতীতে কখনো দেখা যায়নি।
দেশের ব্যাংক খাতের স্থিতিশীলতা পর্যালোচনা করে প্রতি ত্রৈমাসিকে ‘ফাইন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি অ্যাসেসমেন্ট রিপোর্ট’ প্রকাশ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রকাশনাটির গত বছরের এপ্রিল-জুন মেয়াদের প্রতিবেদন মঙ্গলবার প্রকাশ করা হয়েছে। এতে দেখা যায়, ব্যাংক খাতে সঞ্চিতি সংরক্ষণের অনুপাত ধারাবাহিকভাবে কমে যাচ্ছে। ২০২১ সালের মার্চে দেশের ব্যাংক খাতে সঞ্চিতি সংরক্ষণের প্রয়োজন ছিল ৬৪ হাজার ৮০২ কোটি টাকা। ওই সময় সংকট সত্ত্বেও ব্যাংকগুলো ৬৪ হাজার ৬৭৮ কোটি টাকার সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে পেরেছিল। সে হিসাবে এর হার ছিল ৯৯ দশমিক ৮ শতাংশ। এরপর থেকে ধারাবাহিকভাবে এ অনুপাত কমছে। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে এসে সঞ্চিতি সংরক্ষণের অনুপাত ৮২ শতাংশের ঘরে নেমে আসে। পরবর্তী সময়ে এ অনুপাত কিছুটা বাড়লেও গত বছরের জুনে তা ৭৮ দশমিক ৭৬ শতাংশে নেমে যায়।
খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় ২০২৩ সালের জুনে ব্যাংকগুলোর সঞ্চিতি সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা লাখ কোটি টাকা অতিক্রম করে। গত জুনে ব্যাংক খাতে সঞ্চিতি সংরক্ষণের প্রয়োজন দাঁড়ায় ১ লাখ ১ হাজার ৩১ কোটি টাকা। ওই সময় ব্যাংকগুলো ৭৯ হাজার ৫৬৭ কোটি টাকার সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে সামর্থ্য হয়। সে হিসাবে সঞ্চিতি সংরক্ষণের অনুপাত ৭৮ দশমিক ৭৬ শতাংশে নেমে এসেছে। জুনের পর ব্যাংকগুলোর সঞ্চিতি সংরক্ষণ পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। সেপ্টেম্বর শেষে সরকারি-বেসরকারি নয় ব্যাংকের সঞ্চিতি ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় ২৮ হাজার ৭৫৪ কোটি টাকায়।
সঞ্চিতি সংরক্ষণের হার এতটা কমে যাওয়াকে ব্যাংক খাতের বিপদ সংকেত বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, ‘কোনো ব্যাংকের সঞ্চিতি ঘাটতি বেড়ে যাওয়া মানে ওই ব্যাংক দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। দেশের ভালো ব্যাংকগুলো প্রয়োজনের চেয়েও বেশি সঞ্চিতি সংরক্ষণ করে। সে কারণে দুর্বল ব্যাংকগুলোর ঘাটতি সত্ত্বেও সঞ্চিতি সংরক্ষণের অনুপাত ভালো দেখাত। এখন এ অনুপাত যে পর্যায়ে নেমে এসেছে, সেটি অতীতে কখনো দেখিনি।’
আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোসহ বেসরকারি খাতের অনেক ব্যাংককে সঞ্চিতি সংরক্ষণে ডেফারেল সুবিধা দিচ্ছে। কোনো কোনো ব্যাংককে এখনকার সঞ্চিতি সংরক্ষণের জন্য পাঁচ-সাত বছর অতিরিক্ত সময় দেয়া হচ্ছে। সঞ্চিতি সংরক্ষণে ছাড় দেয়া মানে “ময়লা কার্পেটের নিচে” চাপা দেয়া। কার্পেটের নিচে চাপা দেয়া ময়লা যত বেশিদিন থাকবে, তত বেশি দুর্গন্ধ ছড়াবে।’
আমানতকারীদের সুরক্ষার জন্য ব্যাংকগুলোকে বিতরণকৃত ঋণের বিপরীতে বিভিন্ন হারে নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) সংরক্ষণ করতে হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী, ব্যাংকের অশ্রেণীকৃত বা নিয়মিত ঋণের বিপরীতে দশমিক ২৫ থেকে ৫ শতাংশ হারে সঞ্চিতি রাখতে হয়। আর ব্যাংকগুলোকে নিম্নমান বা সাব-স্ট্যান্ডার্ড ঋণের বিপরীতে ২০ শতাংশ, ডাউটফুল বা সন্দেহজনক ঋণের বিপরীতে ৫০ শতাংশ এবং মন্দ বা খারাপ ঋণের বিপরীতে শতভাগ সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে হয়। এটি করতে হয় ব্যাংকগুলোর অর্জিত পরিচালন মুনাফা থেকে। ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় সঞ্চিতি সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা বেড়েই চলছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ২০ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা। গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে এটি ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৭ কোটি টাকায় গিয়ে ঠেকে। সে হিসাবে গত বছরের প্রথম নয় মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩৪ হাজার ৭৪১ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতের ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ ঋণ ছিল খেলাপির খাতায়।
ব্যাংকগুলোর পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকও খেলাপি ঋণের পরিমাণ কম দেখাতে চাইছে। এ কারণে ঋণ পুনঃতফসিলের নীতিমালা সহজ করা হয়েছে। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো এখন চাইলে নিজেরাই যেকোনো ঋণ পুনঃতফসিল করতে পারছে। নীতি ছাড়ের এ সুযোগে ব্যাংকগুলো ঋণ পুনঃতফসিলের রেকর্ডও গড়েছে। শুধু ২০২২ সালে ব্যাংকগুলোর পুনঃতফসিলকৃত ঋণের পরিমাণ ছিল ৬৩ হাজার ৭২০ কোটি টাকা। গণহারে ঋণ পুনঃতফসিল অব্যাহত ছিল গত বছরেও। বিশেষ করে জাতীয় নির্বাচনের আগে খেলাপি ঋণ কম দেখাতে পুনঃতফসিলের মাত্রা আরো বাড়ানো হয়েছে। তবে এখনো গত বছরের ঋণ পুনঃতফসিলের পরিমাণ কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে প্রকাশ করা হয়নি।
একাধিক ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী জানান, ‘ব্যাংক খাতের সঞ্চিতি ঘাটতির পরিমাণ যা দেখানো হচ্ছে, প্রকৃত ঘাটতি তার চেয়েও অনেক বেশি। সরকারি-বেসরকারি অনেক ব্যাংকই গত কয়েক বছর ধরে সঞ্চিতি সংরক্ষণে ডেফারেল সুবিধা নিচ্ছে। এ কারণে ওই ব্যাংকগুলোর সঞ্চিতি ঘাটতির তথ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে আসছে না। ডেফারেল সুবিধা নেয়া ব্যাংকগুলোর ঘাটতি আমলে নিলে সঞ্চিতি সংরক্ষণের অনুপাত ৫০ শতাংশে নেমে আসবে।’
ব্যাংক এশিয়ার সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আরফান আলী বলেন, ‘কোনো ব্যাংকের আর্থিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে চাইলে সঞ্চিতি ঘাটতি রাখা যাবে না। সঞ্চিতি ঘাটতি থাকার পরও কোনো ব্যাংক শেয়ারহোল্ডারদের নগদ লভ্যাংশ দেয়া মানে ওই ব্যাংকের মূলধন ক্ষয় হওয়া। যে ব্যাংকগুলোর সঞ্চিতি ঘাটতি আছে, সেগুলো যাতে নগদ লভ্যাংশ দিতে না পারে, কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সেটি দেখতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘সঞ্চিতি ঘাটতি রেখে কোনো ব্যাংক দীর্ঘমেয়াদে চলতে পারে না। এ ঘাটতি পূরণে উদ্যোক্তাদের নতুন মূলধন জোগানে বাধ্য করতে হবে। তাহলে পরিচালনা পর্ষদ ও উদ্যোক্তাদের মধ্যে ব্যাংক পরিচালনায় সুশাসন মেনে চলার তাড়না আসবে।’
একই ঋণ বারবার পুনঃতফসিলের মাধ্যমে নিয়মিত দেখানো হলেও দেশের ব্যাংক খাতে ‘স্ট্রেসড’ ঋণের পরিমাণ বেড়েই চলছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২২ সাল শেষে দেশের ব্যাংক খাতের পুনঃতফসিলকৃত ঋণের স্থিতি ছিল ২ লাখ ১২ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা, যা ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত মোট ঋণের ১৪ দশমিক ৪০ শতাংশ। খেলাপি ও পুনঃতফসিলকৃত ঋণকে ‘স্ট্রেসড’ বা ‘দুর্দশাগ্রস্ত’ হিসেবে দেখায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। এ হিসাবে দেশের ব্যাংকগুলোর ‘দুর্দশাগ্রস্ত’ ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩ লাখ ৬৮ হাজার ১৭৭ কোটি টাকা। অন্যদিকে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় আদায় অযোগ্য হওয়ায় ব্যাংকগুলো ৬৫ হাজার ৩২১ কোটি টাকার ঋণ অবলোপনও করেছে। সব মিলিয়ে দেশের ব্যাংক খাতের এক-চতুর্থাংশের বেশি ঋণ এখন দুর্দশাগ্রস্ত।
আগে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত এককালীন বা ডাউন পেমেন্ট জমা দিতে হতো। কিন্তু খেলাপিদের প্রতি নমনীয় হতে গিয়ে ২০১৯ সালে ডাউন পেমেন্টের হার ২ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়। যদিও ব্যাংকের প্রভাবশালী বড় গ্রাহকরা কোনো ডাউন পেমেন্ট না দিয়েও খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করে নিচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। গ্রাহকের অনুকূলে ঋণসীমা বাড়িয়ে দিয়েও ব্যাংকগুলো খেলাপি হওয়ার যোগ্য ঋণকে নিয়মিত দেখাচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘দেশের ব্যাংক খাতের সুশাসন অনেক আগেই ভেঙে পড়েছে। ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের যোগসাজশে ঋণের নামে জনগণের অর্থ লুণ্ঠন হয়েছে। এ কারণে পুনঃতফসিল নীতিমালা সহজ করা সত্ত্বেও ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। দেশের ব্যাংকগুলোয় দৃশ্যমান খেলাপি ঋণের চেয়ে ধামাচাপা দেয়া খেলাপি ঋণ অনেক বেশি। ব্যাংক খাত ভঙ্গুর হয়ে পড়ার প্রভাব অর্থনীতির সবক্ষেত্রে এখন দৃশ্যমান।’#