শেখ আব্দুল হমিদ
এবারের বাজেটে করোনাভাইরাস মোকাবেলায় স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। থোক বরাদ্দ হিসেবে দেয়া হয়েছে ১০ হাজার কোটি টাকা। সংসদে প্রস্তাবিত বাজেট উত্থাপন করার সময় অর্থমন্ত্রী আ,হ,ম মুস্তফা কামালের বক্তব্যেই স্পষ্ট ছিল যে চলমান করোনাভাইরাস মহামারির এই সময়ে একটি ভিন্ন ধরনের বাজেট তৈরি করতে হয়েছে।
বাজেট বক্তৃতায় তিনি বলেন, কোভিড-১৯-এর প্রভাবে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে যে জরুরি এবং অপ্রত্যাশিত আর্থিক প্রয়োজন দেখা দিয়েছে তা মেটাতে এবং অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা পুনরুদ্ধারের কৌশল বিবেচনায় নিয়ে মূলত ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তুত করা হয়েছে।
বাংলাদেশে করোনাভাইরাস মহামারির কারণে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে স্বাস্থ্য খাতে এতদিন কতটা কম মনোযোগ দেয়া হয়েছে এবং কত বড় ধরনের সংস্কার এক্ষেত্রে দরকার। তাই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ থেকে শুরু করে অনেকেরই ধারণা ছিল এবারের বাজেটে স্বাস্থ্য খাত অনেক বেশি গুরুত্ব পাবে। কিন্তু বাজেটে অর্থ বরাদ্দের প্রস্তাবনায় তেমনটা দেখা যায়নি অভিযোগ বিশিষ্ঠজনদের।
কোভিড ১৯ প্রতিরোধে বর্তমান বাজেটে স্বাস্থ্য খাত কি পেল? এমন প্রশ্নের জবাবে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ খুলনা বিএমএ’র সভাপতি ডা. বাহারুল আলম বলেন, করোনা মহামারী প্রতিরোধে থোক বরাদ্দ হিসেবে ১০ হাজার কোটি টাকা দেয়া হয়েছে ঠিক আছে। তবে এ বরাদ্দকৃত অর্থের ছাড় হতে সময় পেরিয়ে যাবে বেশ কয়েক মাস। এবারের বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে সংস্কার প্রস্তাবের ক্ষেত্রে তেমন কোন চমক রয়েছে বলে তিনি মনে করেন না।
তিনি বলেন, যেটা হয়েছে সেটা ক্ষতে মলম লাগানোর মতো। এখন একটা ঘা তৈরি হয়েছে, মলম লাগিয়ে ভাল করলাম। করোনাভাইরাস মহামারির কারণে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে স্বাস্থ্য খাতে কতটা সংস্কার দরকার। যারা সংস্কার করবেন তারাই করেন না। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় একটি সিন্ডিকেট ঘিরে রয়েছে। তাই দুর্নীতি থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে সংস্কার আশাকরা যায় না।
তার মতে, আমাদের দেশে যে রোগগুলো বেশি হয়, তা ক্রোনোলজিকালি সাজিয়ে সেগুলোর চিকিৎসায় কী ধরনের যন্ত্রপাতি, দক্ষ জনশক্তি দরকার, সেটা ভেবে বাজেট প্রণয়ন করা হয়নি। বাজেটের সময় আমরা খোঁজা শুরু করি কী কিনতে হবে, কোনটা কিনলে লাভ বেশি বা বেশি না। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া।
এবার শুধু করোনাভাইরাস মহামারি মোকাবেলায় ১০ হাজার কোটি টাকা থোক বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী যারা কোভিড-১৯ মোকাবেলায় কাজ করছেন তাদের জন্য ৮৫০ কোটি টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। তিনি বলেন, টাকা দিয়ে চিকিৎসকদের মাথা কেনা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। গেল বছরের প্রণোদনার টাকা এখনও চিকিৎসকরা পায়নি। চিকিৎসকদের নিরাপত্তা নেই। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় দুর্নীতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারলে বাজেট বরাদ্দ যাইহোক যথেষ্ট কাজ হবে। কোভিড-১৯ মহামারি মোকাবেলায় দুটি জরুরি প্রকল্প নেয়া হয়েছে। একটি বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় এক হাজার ১২৭ কোটি টাকার। অন্যটি এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের দেয়া এক হাজার ৩৬৬ কোটি টাকার।
করোনাভাইরাস সংক্রমণ মোকাবেলায় যেসব সুরক্ষা সামগ্রী রয়েছে যেমন মাস্ক, গ্লাভস, পিপিই, সেগুলোর দাম কমবে। হাসপাতালে আইসিইউ বা নিবিড়পরিচর্যা কেন্দ্র পরিচালনায় ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির দামও কমবে।
তবে স্বাস্থ্যখাতে সংস্কারের ক্ষেত্রে কী করা হবে এবং কীভাবে করা হবে সে বিষয়ে সুস্পষ্ট করে কিছু নেই বললেই চলে। করোনাভাইরাস মোকাবেলার বিষয়টিই স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে সামনের দিকের পরিকল্পনায় আপাতত সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। বাংলাদেশে যে রোগ গুলো বেশি হয়, সেই অনুযায়ী পরিকল্পনা নেয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশিষ্ঠ শিক্ষাবিদ অধ্যাপক জাফর ইমাম বলেন, বাজেটে স্বাস্থ্যখাতে থোক বরাদ্দ হিসেবে ১০ হাজার কোটি টাকা দেয়া হয়েছে। এটা বর্তমান পেক্ষাপটে করোনার তিব্রতায় যথেষ্ট নয়। তারপরও যদি দুর্নীতি না হয় এবং যথাযথ ব্যবহার হয় তাহলে অনেকটাই কাজে আসবে। তিনি বলেন, যাদের জন্য যতটা প্রয়োজন তাদেরকে ততটা অর্থ দিয়ে সঠিক মনিটরিংয়ের মাধ্যমে কাজ করলে অবশ্যই একটা সুফল পাওয়া সম্ভব। তিনি এ ব্যপারে স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়কে আরও সচেতন হওয়ার কথা বলেন।
খুলনা বিশ^বিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. নাসিফ আহসান বলেন, এবারের বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। যদিও বাজেটে গত বছরের তুলনাম কম বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। তবে এ খাতে প্রয়োজন আগে দুর্নীতিমুক্ত করা। তাহলে বরাদ্দ অর্থের যথাযথ ব্যবহার হলে মানুষ এর সুফল পাবে। এখন যে বাভে করোনা বাড়ছে তাতে বরাদ্দ আরও বাড়াবার প্রয়োজন হতে পারে। তাছাড়া সময় মতো বরাদ্দ পাওয়া না গেলে সমস্যা তো হবেই। বাজেট দেয়া হয় জুন মাসে। সেটা ছাড় করতে দুই-তিন মাস চলে যায়। যখন টাকাটা পাওয়া যায়, তখন সময় মতো টাকা খরচ করার সময় থাকে না। খুব তাড়াহুড়ো হয়ে যায়। যার কারণে কাজ যে মানের হওয়া দরকার, তেমন কাজ আমরা করতে পারি না।
তিনি আরও বলেন, প্রয়োজন কোথায়, কোন ক্ষেত্রে কতটুকু দরকার সেটা যাচাই করে বরাদ্দ হয় না। এটা একটা সমস্যা। বাজেট যখন করা হয়, পূর্ববর্তী বছরের যে টাকাটা থাকে, সেখান থেকে কিছু পার্সেন্ট বাড়িয়ে দেয়া হয়। তিনি বলেন, সরাসরি স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে নিয়োগ না করে আমলাদের দ্বারা স্বাস্থ্য খাত পরিচালনা করা হচ্ছে বলে দীর্ঘ মেয়াাদি সংস্কারে নজর থাকছে না। যাদের স্বাস্থ্য খাতে মাঠ পর্যায়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে তাদেরকে নীতি নির্ধারক হিসেবে নিয়োগ দেয়ার কথা বলেন তিনি।
জাতীয় বাজেট ২০২০-২১: কোভিড-১৯ প্রতিরোধে স্বাস্থ্য খাত কি পেল ?
Leave a comment