
শেখ মাহতাব হোসেন, ডুমুরিয়া : খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার গোনালী, সাজিয়াড়া, মাগুরাঘোনা, রুদাঘরা ও শোভনা গ্রামের প্রান্তিক নারীরা এখন মৎস্য বিভাগের অনুপ্রেরণায় নতুন স্বপ্ন দেখছেন — স্বাবলম্বী জীবনের স্বপ্ন। এক সময় যারা সম্পূর্ণভাবে স্বামীর আয়ে নির্ভর করতেন, আজ তারা নিজেরাই ঘেরে মাছ চাষ করে সংসার চালাচ্ছেন, সন্তানদের পড়াশোনা করাচ্ছেন এবং পরিবারে আর্থিক সহায়তা দিচ্ছেন।
গোনালী গ্রামের সাবিনা বেগম বলেন, “আগে আমার স্বামীর টাকার ওপরই নির্ভর করতে হতো, প্রতিটি পয়সা খরচের হিসাব দিতে হতো। যখন উপার্জনের সুযোগ পেলাম, চ্যালেঞ্জটা নিয়েছি। এখন নিজের আয়ে চলি, সঞ্চয়ও করতে পারি।”তিনি ডুমুরিয়ায় মৎস্য বিভাগের কোস্টাল প্রকল্প থেকে ৪০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে নিজ ঘেরে চিংড়ি চাষ শুরু করেছেন। তার স্বামী এখন আর সাগরে মাছ ধরতে যান না; কখনও ঘেরে কাজ করেন, কখনও ভ্যান চালান। আরাজি-সাজিয়াড়ার সোনিয়া বেগমও একইভাবে ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে মাছ চাষ শুরু করেছেন। প্রশিক্ষণ নিয়ে ঘেরে মাছ চাষ করে সংসারের হাল ধরেছেন তিনি। সোনিয়া বলেন, “আগে আমাদের পুরুষরা নদীতে যেত, এখন আমরা নিজেরা ঘেরে কাজ করছি। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনাও চালিয়ে যাচ্ছি। মাগুরাঘোনা গ্রামের খাদিজা বেগম, বাগদা-গলদা সিবিও (কমিউনিটি বেইজড অর্গানাইজেশন)-এর সহ-সভাপতি, জানান, “আমাদের এলাকায় এক হাজারেরও বেশি চিংড়ি ঘের আছে। কিন্তু মৎস্য অফিসের উৎসাহে আমরা প্রথমবার ১৫ জন মহিলা ও ১০ জন পুরুষ মিলে একটি ঘের তৈরি করেছি। আধুনিক চাষ, জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলা এবং নেতৃত্ব বিকাশ বিষয়ে প্রশিক্ষণ পেয়েছি। আশা করছি, আমরা নিজেরাই স্বাবলম্বী হতে পারব। রুদাঘরা গলদা-বাগদা সিবিও-এর সভাপতি মুক্তা বিশ্বাস বলেন, “উপজেলা মৎস্য অফিসের সহায়তায় আমাদের প্রকল্প ভালোভাবে এগিয়ে চলছে। সব লেনদেন আমরা ব্যাংকের মাধ্যমে করি। এই সমিতির মাধ্যমে এলাকার মহিলারা নতুন স্বপ্ন নিয়ে অনেক দূর এগিয়ে যাবেন বলে আমি বিশ্বাস করি।” মুক্তা জানান, তিনি ২৫ জন সদস্যের মৎস্যচাষি দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন এবং মৎস্য অফিসের সহায়তায় ফিলিপাইন গিয়ে প্রশিক্ষণ নেয়ার সুযোগও পেয়েছেন। শোভনা বাগদা সিবিও-এর কোষাধ্যক্ষ খাদিজা বেগম বলেন, “আমরা ১৩ জন মহিলা ও ১২ জন পুরুষ মিলে শোভনা পশ্চিমপাড়ায় একটি ঘের লিজ নিয়েছি। সরকারি সহায়তায় এই প্রথম এমন প্রকল্প আমাদের এলাকায় এসেছে। অফিস থেকে হাতে-কলমে চিংড়ি চাষের উপর প্রশিক্ষণ নিয়েছি। এছাড়া প্রকল্পের আওতায় সাইনবোর্ড, নেট, চুন, পালিশ কুড়া, ইস্ট, সার, খৈল, মাছ ও চিংড়ির পিএল এবং খাবারও পেয়েছি। তিনি আরও বলেন, “এই সহায়তা পেয়ে আমরা এখন আত্মবিশ্বাসী। আশা করছি, নিজেদের ঘাম ও পরিশ্রমে আমরা আমাদের জীবনমানের আমূল পরিবর্তন ঘটাতে পারব।
ডুমুরিয়া উপজেলার সিনিয়র উপজেলা মৎস্য অফিসার সোহেল মোঃ জিল্লুর রহমান রিগান বলেন, “মৎস্য অধিদপ্তরের ‘সাসটেইনেবল কোস্টাল এন্ড মেরিন ফিসারিস প্রকল্প’ ও ‘কমিউনিটি বেইজড ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্ট ফিশারিজ অ্যান্ড অ্যাকুয়াকালচার ডেভেলপমেন্ট ইন বাংলাদেশ’ প্রকল্পের আওতায় আমরা ডুমুরিয়ার প্রান্তিক নারীদের এবং জেলে সম্প্রদায়ের নারীদের প্রশিক্ষণ, ঋণ, ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দিচ্ছি যেটার লক্ষ্য — তাদের স্বাবলম্বী করে তোলা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সক্ষম করা। ইতিমধ্যে বহু নারী মাছ চাষে যুক্ত হয়ে নিজেদের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনছেন।
এই উদ্যোগ শুধু নারীদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করছে না, বরং পরিবার ও সমাজে তাদের অবস্থানও শক্ত করছে। এক সময় যারা ঘরের চার দেয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলেন, তারা আজ নিজের ঘেরের পাশে দাঁড়িয়ে নতুন ভবিষ্যতের গল্প লিখছেন — আত্মনির্ভরশীল এক প্রজন্মের গল্প।