সিরাজুল ইসলাম, শ্যামনগর : সাতক্ষীরার দৈনিক পত্রদূত সম্পাদক, বীর মুক্তিযোদ্ধা স. ম আলাউদ্দীনের ২৯তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ ১৯ জুন। ১৯৯৬ সালের ১৯ জুন রাতে দৈনিক পত্রদূত অফিসে কর্মরত অবস্থায় ঘাতকদের গুলিতে নিহত হন স. ম আলাউদ্দীন। ১৯৯৬ এর ১২ জুনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠনের পূর্বমুহূর্তে এই হত্যাকান্ড সংগঠিত হয়।উল্লেখ্য, সাতক্ষীরার ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার, শিল্প-কলকারখানা স্থাপনের মাধ্যমে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি, কৃষির বিকাশ ও উন্নয়ন, কর্মমুখি শিক্ষা, জেলার সামগ্রীক উন্নয়নে দলমত নির্বিশেষে একদল উদ্যোমী মানুষকে সাথে নিয়ে তিনি বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ১৯৮৪ সালে মহাকুমা হতে সাতক্ষীরা জেলায় উন্নীত হলে এখানকার অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে ব্যাপক সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। সেইসব সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে স. ম আলাউদ্দীনের নেতৃত্বে সাতক্ষীরা চেম্বার অব কমার্স প্রতিষ্ঠিত হয় ও পরবর্তীতে তিনি সভাপতি নির্বাচিত হন। ভোমরা স্থলবন্দর প্রতিষ্ঠাতায় তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন এবং তিনি ঐ বন্দর ব্যবহারকারী সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন, সাতক্ষীরা ট্রাক মালিক সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, ইটভাটা, শিল্প-কলকারখানাসহ ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণকারী বিভিন্ন সংগঠন প্রতিষ্ঠা ও নেতৃত্বের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি নিজেও মেসার্স আলাউদ্দীন ফুডস এন্ড ক্যামিকেল ইন্ডাস্ট্রি নামে পদ্মার এপারে একটি মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন।বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী মুক্তিযুদ্ধের অকুতোভয় বীর সেনানী স. ম আলাউদ্দীন ছিলেন তৎকালীন সাতক্ষীরা জেলা আওয়ামী লীগের অন্যতম শীর্ষ নেতা। ১৯৭০সালের নির্বাচনে তিনি প্রাদেশিক পরিষদের সর্বকণিষ্ঠ সদস্য নির্বাচিত হন।১৯৬২সালে হামাদুর রহমান শিক্ষা কমিশন বাতিলের আন্দোলনের মধ্যদিয়ে ছাত্র রাজনীতিতে যুক্ত হন তিনি। ১৯৬৫-৬৮ পর্যন্ত খুলনা জেলা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতিসহ বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেন। এসময় আন্দোলন সংগ্রামের কারণে তার বিরুদ্ধে একাধিকবার গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ও একাধিক কলেজ থেকে ফোর্সটিসি দেওয়ায় তার শিক্ষা জীবন বিঘ্নিত হয়। ১৯৬৮-৬৯ সালে খুলনা ল’ কলেজের ছাত্র থাকা অবস্থায় তার নেতৃত্বে তালা থানা আওয়ামী লীগের কমিটি গঠন করা হয় এবং তিনি কমিটির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।১৯৬৭ সালে বিএ পাশ করে তালার জালালপুর হাইস্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে শিক্ষকতা শুরু করলেও রাজনীতির প্রতিটি কর্মকান্ডে দক্ষ সংগঠক হিসেবে জানান দেন স. ম আলাউদ্দীন। ৬৯-৭০’র উত্তাল গণআন্দোলনে স. ম আলাউদ্দীন ছিলেন সাতক্ষীরার তরুণ আন্দোলনকারীদের প্রাণ পুরুষ। উত্তপ্ত রাজপথের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দুর্জয় তরুণ আলাউদ্দীন ওই সময়ই সাতক্ষীরার গণমানুষের নেতা হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন এবং ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে সর্বকনিষ্ঠ প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন।মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অস্ত্র হাতে অংশগ্রহণকারী সংসদ সদস্যদের মধ্যে তিনি অন্যতম। একাত্তরের ২৯ মার্চ তিনি ভারতে প্রবেশ করেন এবং পরবর্তীতে বিএসএফ-এর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের জিওসি মেজর জেনারেল আরুন মুখার্জীর সাথে বেনাপোল ও ভোমরা সীমান্ত দিয়ে যশোর ও খুলনাঞ্চলে যুদ্ধারতদের অস্ত্র ও গোলা বারুদ সরবরাহের চুক্তি করেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের ৮ ও ৯ নাম্বার সেক্টরের অন্যতম সংগঠকেরও ভূমিকা পালন করেন। এসময় নির্বাচিত এমপি হয়েও তিনি কমিশন্ড অফিসার হিসাবে সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন এবং কিছুদিন ক্যাম্পে দায়িত্ব পালনের পর সাতক্ষীরা মহাকুমা মুক্তিবাহিনীর প্রধানের দায়িত্ব পান।পরবর্তীকালে মুক্তিযুদ্ধে ৮ নম্বর সেক্টরে ক্যাপ্টেন সাইফুল্লাহ নাম গ্রহণ করে দেশে প্রবেশ করে সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি খুলনা জেলা মুজিব বাহিনীরও সংগঠক ছিলেন এবং এসময় তার নির্বাচনী এলাকা তালায় মুজিব বাহিনীর খলনাঞ্চলের প্রধান দপ্তর ছিল। স. ম আলাউদ্দীনের ব্যক্তিগত সদ্ভাব ও সমন্বয়ের কারণে খুলনা জেলার কোথাও এই দুই বাহিনীর মধ্যে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। দুঃসাহসিক বিভিন্ন অভিযানের কারণে তিনি কমপক্ষে চার বার মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গেলেও পাকিস্তানের সামরিক আদালত তাকে ১৪বছর সশ্রম কারাদন্ড, সংসদ সদস্যপদ বাতিল, সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার আদেশ দেয় এবং তাকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য ৪০হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে এলাকায় মাইকিং করে।সে সময় বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে অবলম্বন করে কলকাতার উমাপ্রসাদ মৈত্র পরিচালিত ‘জয়বাংলা’ চলচ্চিত্রে বীরমুক্তিযোদ্ধা স. ম আলাউদ্দীনের মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণসহ উদ্দীপনামূলক বিভিন্ন ভাষণ ও কার্যক্রম তুলে ধরা হয় এবং এই চলচিত্রের প্রধান চরিত্রে তাকে তুলে ধরা হয়।১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীনের পর চরম বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির মধ্যে এই বিপ্লবী যোদ্ধা স্থানীয় কতিপয় নেতবৃন্দের দুর্নীতি এবং গণবিরোধী কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠেন। বিভিন্ন অন্যায়ের বিরুদ্ধে তিনি প্রতিবাদমুখর হয়ে পড়েন। এক পর্যায়ে দল তাকে কেন বহিস্কার করা হবে না মর্মে শো-কজ করলে তিনি সংসদ সদস্য পদ ও দল থেকে পদত্যাগ করে এক নজীর বিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। বিবিসিসহ বিভিন্ন জাতীয় আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় তার পদত্যাগের এই খবর প্রচারিত হয়। পরবর্তীতে জাসদ গঠিত হলে তিনি সেই নতুন দলে যোগদান করেন।মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী ১৯৭৫ সালের ১৬ ডিসেম্বর তৎকালীন সামরিক সরকারের নিবর্তনমূলক আইনে স. ম আলাউদ্দীন গ্রেপ্তার হন। ছয় মাস কারাভোগ শেষে মুক্তির তিন মাস পর তিনি পুনরায় গ্রেপ্তার হন। ১৯৭৯ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাসদের মনোনয়ন পেয়ে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বীতার জন্য এলাকায় ফিরে আসেন। কিন্তু সেই নির্বাচনে তার নির্বাচনী এলাকা তালা-কলারোয়ায় মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শক্তির ব্যাপক উত্থান দেখে তিনি নির্বাচন থেকে সরে দাড়ান এবং আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচনী কার্যক্রমে অংশগ্রহণের মধ্যদিয়ে পুনরায় আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত হন এবং নতুন করে আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। একপর্যায়ে ১৯৮৩ সালে স. ম আলাউদ্দীন সাতক্ষীরা শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পরে সভাপতি নির্বাচিত হন এবং ১৯৮৪ সালে জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হন। তিনি সাতক্ষীরা জেলা শ্রমিক লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। তিনি মৃত্যুর দিন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথেই যুক্ত ছিলেন এবং গতানুগতিক রাজনীতির ধারার বাইরে তিনি দলকে জনগনের খুব কাছে নিয়ে যেতে সচেষ্ট ছিলেন। দেশ স্বাধীনের পর দলত্যাগ প্রসঙ্গকে তিনি তপ্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত উনুনে ঝাপ দেওয়ার সাথে তুলনা করে বিভিন্ন আলোচনায় আত্মসমালোচনা করতেন।সম আলাউদ্দীন কর্মমুখী শিক্ষার নিজস্ব ভাবনা থেকে সাতক্ষীরাতে প্রথম ‘বঙ্গবন্ধু পেশাভিত্তিক স্কুল ও কলেজ’ নামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। তিনি ওই প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ ছিলেন।সাতক্ষীরার তালার উপজেলার নগরঘাটা ইউনিয়নের মিঠাবাড়ি গ্রামে ১৯৪৫ সালের ২৯ আগস্ট (বাংলা ১৩৫২ সালের ১৫ ভাদ্র) এই বীর মুক্তিযোদ্ধা স. ম আলাউদ্দীন জন্মগ্রহণ করেন। আজীবন সংগ্রামী আপোষহীন এই মানুষটি ১৯৯৬ সালের ১৯ জুন সাতক্ষীরা সদর থানার দক্ষিণ পাশে অবস্থিত তৎকালীন দৈনিক পত্রদূত অফিসে কর্মরত অবস্থায় ঘাতকের গুলিতে প্রাণ হারান।