মোঃ বাবর আলী, কালিয়া : নড়াইলের কালিয়া উপজেলার ইলিয়াসাবাদ ইউনিয়নের বিলদুড়িয়া গ্রামের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীকে আটকে রেখে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ মনগড়া ও ষড়যন্ত্র বলে দাবি করেছেন দায়িত্বরত নারী পুলিশ সদস্যসহ সংশ্লিষ্টরা। নড়াইলের কালিয়া থানাসহ ঢাকার সাভার ও আশুলিয়া থানার কাগজপত্র বিশ্লেষণ করেও ভুক্তভোগীর বক্তব্যের সাথে অমিল পাওয়া গেছে।
থানার কাগজপত্র অনুযায়ী গত বৃস্পতিবার (৫ ডিসেম্বর) রাত ১০টা ৫০ মিনিটে আশুলিয়া থানার সহযোগিতায় ভুক্তভোগীকে উদ্ধার অভিযানে যায় কালিয়া থানা পুলিশ। এরপর রাত ১২টার দিকে আশুলিয়ার বাইপাইলের ভাইরাল বিউটি বা ক্রীম বিউটি আপার পারলারের পাশের বাসা থেকে ভুক্তভোগীকে উদ্ধার করা হয়। ভুক্তভোগীকে সাভার থানায় রেখে আরেকটি অভিযানে যায় কালিয়া থানা পুলিশের ওই টিম। পরবর্তীতে ভুক্তভোগীকে নিয়ে সাভার থানা থেকে কালিয়া থানার উদ্দেশ্যে গত শুক্রবার ভোর সাড়ে ৫টার দিকে রওনা হয় পুলিশ। কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে কালিয়া থানার এসআই আশিকুজ্জামান গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী থানার ফুকরা এলাকায় জুম্মাবাদ তার চাচাতো ভাইয়ের জানাজায় অংশগ্রহণ করেন্।
এ সময় ভুক্তভোগী ছাত্রীসহ নারী পুলিশ সদস্য ও অন্যরা মাইক্রোবাসের ভেতরে অবস্থান করছিলেন। এ ব্যাপারে মাইক্রেবাসের চালক হিটলার সরদার বলেন, আমাদের গাড়িটি হাইওয়ের পাশে অবস্থান করছিল। শুধুমাত্র গাড়ি থেকে নেমে এসআই আশিকুজ্জামান তার ভাইয়ের জানাজায় অংশগ্রহণ করেন। কোথাও রাত্রিযাপনের কোনো প্রেক্ষাপটই তৈরি হয়নি।
এদিকে উদ্ধার অভিযানে থাকা কালিয়া থানার নারী পুলিশ সদস্য তানিয়া খাতুন বলেন, ভাইরাল বিউটি বা ক্রীম আপার পাশের বাসা থেকে ভুক্তভোগী অষ্টম শ্রেণির ছাত্রীকে উদ্ধার করা হয়েছে। তার আচরণ সব সময় এলোমেলো মনে হয়েছে। মনগড়া কথা বলে আমাদের উদ্ধার অভিযানের সফলতা ভিন্ন দিকে নিয়ে গেছে ওই ছাত্রী। শুক্রবার ভোরে মাইক্রোবাসে আমরা কালিয়া থানায় উদ্দেশ্যে রওনা দিই। কোথাও রাত্রিযাপনের প্রশ্নই উঠে না। সারাক্ষণ মেয়েটির পাশেই ছিলাম। আর এসআই আশিকুজ্জামান চালকের পাশের সিটে ছিলেন। আমরা মাইক্রোবাসের ভেতরে ছিলাম। ভুক্তভোগী মেয়েটি আশুলিয়ায় ভাইরাল বিউটি আপার কাছে থাকতো বলে জানিয়েছে।
অভিযানে থাকা আরেক পুলিশ কনস্টেবল লস্কর মফিজুল ইসলাম বলেন, আমিসহ সহকর্মী তানিয়া খাতুন, ভুক্তভোগী ছাত্রী এবং শান্ত সিকদার নামের একব্যক্তি (ভুক্তভোগীকে শনাক্তকারী) মাইক্রোবাসের ভেতরে ছিলাম। এসআই আশিকুজ্জামান চালকের পাশেই ছিলেন। ভুক্তভোগীকে শারীরিক নির্যাতনের কাহিনী মনগড়া, ভিত্তিহীন ও নাটকীয়। আমরা হতবাক হয়েছি।
এদিকে, ভুক্তভোগীর পরিবারের সাথে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে প্রথমে তার মা ফোন ধরেন। সাংবাদিক পরিচয় পে্য়ে তিনি তেমন কোনো কথা বলেননি। এরপর তার দুলাভাই সুমন গাজীও তার শ্যালিকাকে উদ্ধার এবং এসআই আশিকুজ্জামানের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য দেন।
পুলিশ ও এলাকাবাসী জানান, পরিবারের সঙ্গে রাগ করে ভুক্তভোগী গত ২৭ অক্টোবর বাড়ি থেকে বের হয়। এরপর ২৯ অক্টোবর ছাত্রীর বাবা সরদার মহব্বাত আলী কালিয়া থানায় নিখোঁজের সাধারণ ডায়রি (জিডি) করেন। জিডির সূত্র ধরে নোয়াখালী জেলার চাটখিল থানার পরকোট গ্রামের হুমায়ুন কবিরের ছেলে মানিক হোসেনকে (৩০) গাজীপুরের বাসন থানার বাইপাস এলাকা থেকে গত ১১ নভেম্বর সন্ধ্যার দিকে তাকে গ্রেফতার করে কালিয়া থানা পুলিশ। মানিক পেশায় ট্রাকচালক।
ভুক্তভোগী ছাত্রী বাড়ি থেকে রাগ করে চলে যাওয়ার পর মানিকের কাছে চারদিন ছিল। মানিকের কাছে থাকাকালীন ভুক্তভোগী তার সাবেক প্রেমিক কালিয়া উপজেলার মাথাভাঙ্গা গ্রামের হুমায়ুন সিকদারের ছেলে শান্ত সিকদারের মাধ্যমে ভুক্তভোগীকে শনাক্ত করে পুলিশ। ভুক্তভোগী মানিকের কাছে থাকাকালীন তার (মানিক) ফোন দিয়ে শান্তর সঙ্গে কথা বলেছিল। সেই সূত্র ধরে মানিককে গ্রেফতার করে পুলিশ। মানিককে গ্রেফতারের আগেই ভুক্তভোগী ছাত্রী তার কাছ থেকে চলে যাওয়ায় তাকে সেইদিন উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ। এরপর চারবারের অভিযানে অবশেষে গত ৬ ডিসেম্বর শুক্রবার ভুক্তভোগীকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয় কালিয়া থানা পুলিশ।
এদিকে কালিয়া থানার এসআই আশিকুজ্জামানের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীকে আটকে রেখে যৌন নির্যাতন করেছে।
এ বিষয়ে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী গত শনিবার (৭ ডিসেম্বর) রাত ৮টার দিকে নড়াইলের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সাবরিনা চৌধুরীর কাছে ২২ ধারায় জবানবন্দী দিয়েছে।
তাদের পরিবারের দাবি, আশিকুজ্জামান গত ৫ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার ঢাকার আশুলিয়া থেকে ভুক্তভোগী স্কুলছাত্রীকে উদ্ধার করেন। এরপর এসআই আশিকুজ্জামান কালিয়া থানায় না এনে নিজের বাড়ি গোপালগঞ্জে নিয়ে যায় ভুক্তভোগী ছাত্রীকে। বৃহস্পতিবার রাতে ভুক্তভোগীকে এসআই আশিকুজ্জামান তার বাড়িতে রেখে শরীরের স্পর্শকাতর স্থানে হাত দেয় বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীর।
এ অভিযোগ অস্বীকার করে এসআই আশিকুজ্জামান বলেন, আমার চাচাতো ভাই মারা যাওয়ায় কর্মকর্তাদের অনুমতি নিয়ে ভুক্তভোগীকে সড়কের পাশে গাড়িতে রেখে জানাজা শেষ করে শুক্রবার বিকেলে কালিয়া থানায় নিয়ে আসি। গাড়িতে নারী পুলিশসহ অন্য সদস্যরাও উপস্থিত ছিলেন। ভুক্তভোগী ছাত্রী মেডিকেল পরীক্ষা পর্যন্ত করতে চায়নি। এলোমেলো কথা বলেছে। উদ্দেশ্যমূলক ভাবে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে।
এ বিষয়ে কালিয়া থানার ওসি রাশিদুল ইসলাম বলেন, এসআই আশিকুজ্জামানের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠায় কর্তৃপক্ষ তাকে পুলিশ লাইনে সংযুক্ত করেছেন। অভিযোগের বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। এছাড়া ভুক্তভোগীকে উদ্ধার করে কালিয়া থানায় আনার তার বাবা-মায়ের উপস্থিতিতে তার সঙ্গে কথা হয়েছে। এ সময় সহকারী পুলিশ সুপার কিশোর রায়সহ (কালিয়া সার্কেল) কালিয়া থানার ওসি তদন্ত উপস্থিত ছিলেন। আমাদের কারোর কাছেই ভুক্তভোগীকে যৌন নির্যাতনের কথা বলেনি। এমনকি তার মায়ের সঙ্গে শুক্রবার থানায় রাতযাপন করলেও সেই সময় কোনো নির্যাতনের কথা বলেনি ভুক্তভোগী ওইছাত্রী।