
সাতক্ষীরা প্রতিনিধি : বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বঙ্গোপসাগরের কোলঘেঁষা খুলনার দাকোপ উপজেলা এক সময় ছিল জলবায়ু পরিবর্তনের নির্মম অভিঘাতে জর্জরিত জনপদ। এভাবে পিছিয়ে নেই সাতক্ষীরার উপকূলের তৃণমূলের নারীরা নানা প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে জীবন বাঁচাতে কৃষিকার সহ নানা কাজে জড়িয়ে পড়েছে। সাতক্ষীরার উপকূলে অনেক নারীরা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নদীর পানিতে লবণাক্ততা বাড়ায় নানান রোগে আক্রান্ত হয়ে বসে নেই তাদের জীবন প্রতিদিনের জীবিকা নির্বাহের জন্য ছুটে বেড়াচ্ছেন নানান কাজে। ঘূর্ণিঝড় সিডর ও আইলার পর নোনাপানির আগ্রাসনে এ অঞ্চলের বিস্তীর্ণ ফসলি জমি দীর্ঘদিন অনাবাদি পড়ে ছিল। মাঠে ধান জন্মাত না, জীবিকার উৎস হারিয়ে মানুষ হতাশায় দিন কাটাত। ছিনতাই হয়ে গিয়েছিল হাসি, থমকে গিয়েছিল জীবন।
কিন্তু সেই দৃশ্যপট এখন আর আগের মতো নেই। খুলনার দাকোপের চরডাঙ্গা কিংবা তিলডাঙ্গা গ্রামে ঢুকলেই চোখে পড়ে সবুজের সমাহার। বাঁশের মাচায় ঝুলে থাকা লাউ, সারি সারি ঢেঁড়স, বেগুন, টমেটো আর পাশাপাশি ঝিলমিল করা মাছের ঘের। একসময় যে জমি ছিল বিরানভূমি, তা এখন হয়ে উঠেছে শষ্য উৎপাদনের প্রাণকেন্দ্র। আর এই পরিবর্তনের নেপথ্যে রয়েছে জলবায়ু সহনশীল কৃষি আর একদল অপ্রতিরোধ্য নারীর কোমল হাতের ছোঁয়া।
উপজেলার চরডাঙ্গা গ্রামের গৃহবধূ চিত্রা রানী রায় ছিলেন তাদেরই একজন। দিনমজুর স্বামীর সামান্য আয়ে কোনভাবে চলত সংসার, যেখানে অভাব ছিল নিত্যসঙ্গী। কিন্তু জলবায়ু সহনশীল কৃষি প্রশিক্ষণ বদলে দিয়েছে তার জীবনের গতিপথ। এখন তিনি নিজেই জমি লিজ নিয়ে সবজি চাষ করেন। আয় করছেন নিজের হাতে।
চিত্রা রানী বলেন, আগে ছিল শুধু টিকে থাকার লড়াই। এখন পরিশ্রমের ফল পাই। আমি এখন একজন কৃষক, একজন উদ্যোক্তা। তার চোখেমুখে আত্মবিশ্বাস, কণ্ঠে জীবনের দৃঢ়তা।
জেলার দাকোপ উপজেলার মতো উপকূলীয় এলাকায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রথম আঘাত লাগে কৃষিতে। লবণাক্ততার কারণে ধানসহ প্রচলিত ফসল আর টিকে থাকে না। তবে কৃষকরা এখন শিখছেন বিকল্প পথ। বাঁধের ওপর চলে সবজি চাষ, জৈব সার ও খড়ের মালচ ব্যবহার, লবণসহনশীল সবজি ও মাছের সমন্বিত চাষ। এই নতুন কৌশলগুলো একদিকে যেমন ফলন বাড়িয়েছে, অন্যদিকে এক জমি থেকেই তৈরি করেছে ভিন্ন ভিন্ন আয়ের সুযোগ।
তিলডাঙ্গা গ্রামের কৃষক সুকুমার মল্লিক বলেন, আগে একবার ঘূর্ণিঝড় এলেই সারা বছর ঋণে ডুবে থাকতাম। এখন মাছ আর সবজি একসঙ্গে চাষে ঝুঁকি কমেছে। ক্ষতি হলেও পুরোপুরি ভেঙে পড়তে হয় না।
এই পরিবর্তনের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ দিক হলো, নারীর অংশগ্রহণ। দাকোপে নারী কৃষকের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। তারা শুধু ঘরের কাজেই সীমাবদ্ধ নেই, মাঠেও সমানভাবে সক্রিয়। জলবায়ু সহনশীল কৃষি প্রকল্পের মাধ্যমে তারা শিখেছেন, কম জমিতে বেশি উৎপাদন, জৈব সার তৈরি, ফসল সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণ।
তিলডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জালালউদ্দিন গাজী বলেন, এক সময় এখানে লবণাক্ততার কারণে ফসল হতো না। এখন মানুষ প্রযুক্তি শিখে নিজের জমি কাজে লাগাচ্ছে। নারীরা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছেন, এতে পরিবার ও সমাজে স্থিতি এসেছে। তিনি জানান, কৃষি আয় বাড়ায় এলাকায় অপরাধপ্রবণতা কমেছে, শিক্ষার হার বেড়েছে, সামাজিক সহযোগিতার পরিবেশ তৈরি হয়েছে।
এই সাফল্যের পেছনে রয়েছে সরকার ও বেসরকারি সংস্থার যৌথ উদ্যোগ। আন্তর্জাতিক সংস্থা কনসার্ন ওয়ার্ল্ডওয়াইড বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে দাকোপে জলবায়ু সহনশীল জীবিকা উন্নয়নে কাজ করছে। সংস্থাটির প্রোগ্রাম ম্যানেজার মো. মাছুমুর রহমান বলেন, আমাদের লক্ষ্য আয়ের বৈচিত্র্য তৈরি করা, যেন দুর্যোগ এলেও মানুষ পুরোপুরি ভেঙে না পড়ে। ক্ষতিগ্রস্ত হলেও যেন তারা দ্রুত জীবিকায় ফিরে আসার সুযোগ পায়, আমরা সেই সক্ষমতা গড়ে তুলছি।
তিনি জানান, তার সংস্থার সহায়তায় শতাধিক পরিবার এখন নিজস্ব জৈব সার উৎপাদন করছে। আর অনেক নারী স্থানীয় বাজারে সরাসরি সবজি বিক্রি করছেন।
খুলনা কৃষি দফতরের তথ্য অনুযায়ী, গত তিন বছরে দাকোপ উপজেলায় প্রায় ৪০ শতাংশ কৃষক জলবায়ু সহনশীল চাষাবাদে যুক্ত হয়েছেন। বেড়েছে মাছ ও সবজির উৎপাদন। কেউ কেউ বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে সেচের কাজে ব্যবহার করছেন। এগিয়ে যাচ্ছেন স্মার্ট ফার্মিংয়ের দিকে।
দাকোপের এই পরিবর্তন শুধু কৃষির নয়। এটি সামাজিক পুনর্জাগরণের গল্প। আয় বাড়ায় নারীরা এখন সংসারের সিদ্ধান্তে ভূমিকা রাখছেন। তাদের সন্তানরা স্কুলে যাচ্ছে। পারিবারিক কলহ কমেছে। বেড়েছে তাদের আত্মসম্মান।
তবে স্থানীয়দের মতে, এই অগ্রযাত্রা টেকসই করতে আরো অবকাঠামোগত সহায়তা জরুরি। প্রয়োজন টেকসই বাঁধ, কৃষিপণ্য সংরক্ষণাগার এবং উন্নত সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা।
দাকোপ উপজেলার তিলডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জালালউদ্দিন গাজী বলেন, কৃষকরা এখন কাজ করতে জানে। সরকার যদি বাজার ও সংরক্ষণ ব্যবস্থা শক্তিশালী করে, তাহলে দাকোপ হতে পারে দেশের সবুজ উপকূল মডেল।
প্রতিদিন প্রভাতের আলোয় চরডাঙ্গা গ্রামের মাঠে যায় চিত্রা রানী ও তার সঙ্গীরা। কাঁধে থাকে ঝুঁড়ি। সূর্য ফুটে ওঠার সাথে তাদের মুখে ফোটে হাসি। উপকূলের বাতাসে ভেসে বেড়ায় নতুন আশার স্বপ্ন।
দাকোপের এই গল্প প্রমাণ করে, স্থানীয় জ্ঞান, নারী-পুরুষের সমন্বিত উদ্যোগ আর সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব মিললে জলবায়ু অভিযোজন কেবল সম্ভবই নয়, হয়ে উঠতে পারে টেকসই উন্নয়নের শক্ত ভিত।

