
এম সাইফুল ইসলাম
শহীদ রওনাকুল ইসলাম বাবর। একাত্তরের রনাঙ্গনে তিনি শহীদ হন। তার লাশ পাকিস্তানি ক্যাম্পের অদূরে পড়ে থাকায় দৌলতপুর মহসিন স্কুলের শিক্ষক মো: হানিফের পুত্র তিনি। স্কুলে পড়াকালীন তিনি ছাত্র ইউনিয়নের সাথে যুক্ত হন। পরে এস. এস. সি পাশ করে ব্রজলাল কলেজে ভর্তি হলে নিজেকে ছাত্র রাজনীতিতে নিবেদন করেন।
১৯৬৮ সালে সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন এবং ৬৯ এর গণ অভ্যুত্থানে সক্রিয় অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে একজন প্রথম সারির ছাত্র নেতা হিসেবে শুধু ব্রজলাল কলেজে নয় সারা খুলনা জেলার ছাত্রসমাজের কাছে পরিচিত হন।
যুদ্ধের শুরুতে তৎকালীন ছাত্রনেতা শেখ মনিরুজ্জামানের সাথে তিনি সংগঠনের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা কর্মীদের ভারতে ট্রেনিং এর জন্য পাঠিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। দীর্ঘ কয়েক মাস এভাবে বাড়ি ছেড়ে কাজ করার পর ২৯ জুলাই তিনি তার অসুস্থ পিতার সাথে দেখা করতে দৌলতপুরের বাড়িতে আসেন। এলাকার রাজাকার বাহিনী খবর পেয়ে হানাদারদের দিয়ে আটক করিয়ে দৌলতপুরের বিখ্যাত পানচাষীর বিল্ডিংয়ে আটকে রাখে।
খুলনা মহানগরীর মহেশ্বরপাশা পুলিশ ফাঁড়ির অদূরে ছিল নারায়ণ মজুমদারের বাড়ি। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে নারায়ণ মজুমদার ভারতে পালিয়ে গেলে তার বাড়িটি লুটপাট হয়। এরপর হানাদার বাহিনী এ বাড়িতে ক্যাস্প করে। এ ক্যাম্পে বাঙালিদের ওপর নির্যাতন চালানো হতো। ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে এখানকার কালী মন্দিরে পুরোহিত সতিশ চক্রবর্তীসহ ছয় জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। হত্যা করা হয় দৌলতপুর মহাসিন স্কুলের শিক্ষক শেখ মুহাম্মাদ হানিফের দুই সন্তানকে।
খুলনার বেসরকারি প্রতিষ্ঠান মাসাস-এর নির্বাহী পরিচালক শামিমা সুলতানা শিলু জানান, যুদ্ধের সময় তিনি কিশোরী। হানিফ স্যারের তিন ছেলেকে হত্যার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন তিনি। ওই হত্যার ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘ঘটনার দিন বিকালে বারান্দায় বসে খেলছিলাম। হঠাৎ বাবর ও জাকির সহ তিনটা ছেলেকে হানাদার বাহিনীর সদস্যরা লাথি মেরে রায় ফেলে দেয়। পেছনে হাত বাঁধা একটি ছেলেকে পাশের ড্রেনে ফেলে দেয়। কষ্ট করে সে উঠে দাঁড়ায়। এ অবস্থায় কোমর বেঁধে তাকে টানতে টানতে বাড়ির ভেতরে নিয়ে যায়। দু’দিন পর ঝড়-বৃষ্টির সন্ধ্যায় তিনটি গুলির শব্দ শোনা যায়। পরে তিনটি ছেলের লাশ দেখা যায়। জানা যায়, ওই তিন জন ছিলেন দৌলতপুর মহাসিন স্কুলের শিক্ষক শেখ মুহাম্মাদ হানিফ স্যারের সন্তান রওনাকুল ইসলাম বাবর ও জাকির । বাকি একজনের নাম তপন কুমার দাশ।’
জানা যায়, তার সঙ্গে আটক করে তার ছোট ভাই জাকির হোসেন ও ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী তপন দাসকে। সারাদিন নির্যাতনের পর সেদিন সন্ধ্যায় স্থানীয় মহেশ্বরপাশা বিলে অর্থাৎ কৃষি বিভাগের নার্সারি (বর্তমান প্রস্তাবিত কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়) তাকে নিয়ে যাওয়া হয়। অনেক জিজ্ঞাসাবাদের পর তাকে একবার বলা হয় – ‘তুমি একবার পাকিস্তান জিন্দাবাদ বল’ তোমাকে ছেড়ে দেব। বাবর উত্তরে চিৎকার করে উঠলো জয় বাংলা বলে। তারপর প্রথম তার দুই হাত কেটে ফেলা হয় এবং এরপর দু’পা। পরে বেয়নেট দিয়ে চোখ উপড়ে ফেলা হয়। অবশেষে তাকে নির্মমভাবে জবাই করে হত্যা করা হয়। দেশ স্বাধীন হলে ওই স্থানে তার কঙ্কাল পাওয়া যায় এবং সেখানেই তাকে সমাহিত করা হয়।