By using this site, you agree to the Privacy Policy and Terms of Use.
Accept

প্রকাশনার ৫২ বছর

দৈনিক জন্মভূমি

পাঠকের চাহিদা পূরণের অঙ্গীকার

  • মূলপাতা
  • জাতীয়
  • আন্তর্জাতিক
  • রাজনীতি
  • খেলাধূলা
  • বিনোদন
  • জেলার খবর
    • খুলনা
    • চুয়াডাঙ্গা
    • বাগেরহাট
    • মাগুরা
    • যশোর
    • সাতক্ষীরা
  • ফিচার
  • ই-পেপার
Reading: পচাব্দী গাজী শুধু বিখ্যাত বাঘ শিকারি নয় তিনি বাঙালি জাতির ইতিহাস
Share
দৈনিক জন্মভূমিদৈনিক জন্মভূমি
Aa
  • মূলপাতা
  • জাতীয়
  • জেলার খবর
  • ই-পেপার
অনুসন্ধান করুন
  • জাতীয়
  • জেলার খবর
  • আন্তর্জাতিক
  • খেলাধূলা
  • বিনোদন
  • ই-পেপার
Have an existing account? Sign In
Follow US
প্রধান সম্পাদক মনিরুল হুদা, প্রকাশক আসিফ কবীর কর্তৃক জন্মভূমি প্রকাশনী লি: ১১০/২,সাংবাদিক হুমায়ুন কবীর বালু সড়ক, খুলনা থেকে মূদ্রিত ও প্রকাশিত
দৈনিক জন্মভূমি > জেলার খবর > সাতক্ষীরা > পচাব্দী গাজী শুধু বিখ্যাত বাঘ শিকারি নয় তিনি বাঙালি জাতির ইতিহাস
তাজা খবরসাতক্ষীরা

পচাব্দী গাজী শুধু বিখ্যাত বাঘ শিকারি নয় তিনি বাঙালি জাতির ইতিহাস

Last updated: 2025/01/16 at 12:02 PM
করেস্পন্ডেন্ট 6 months ago
Share
SHARE

সিরাজুল ইসলাম, শ্যামনগর : সুন্দরবনের কোন এলাকায় মানুষখেকো বাঘের উপদ্রব হলে প্রথমে বন অফিসের লোকেরাই সেই বাঘ মারতে চেষ্টা করেন। বন-কর্মকর্তাগণের মধ্যে, এমন কি বনপ্রহরী, বনমাঝিদের মধ্যেও অনেকে আছেন যারা ভাল শিকারী। কিন্তু মারাত্মক মানুষখেকোর ক্ষেত্রে তখন আর এঁদের উপরে নির্ভর করা যায় না, পেশাদার এবং শক্ত স্নায়ুর অধিকারী সুকৌশলী শিকারীর প্রয়োজন হয় । সুন্দরবনের প্রান্তবর্তী গ্রামসমূহে কিছুসংখ্যক শিকারী পরিবার আছে, তাঁদের মধ্যে বন দফতরের অনুমোদনপ্রাপ্ত শিকারীগণ রয়েছেন, বন দফতর মানুষখেকো বাঘের উপর পুরস্কার ঘোষণা করে সেই শিকারীগণকে খবর দেয়, তখন তাঁরা গিয়ে বাঘ মারেন। পচাব্দী গাজী তেমনি এক নামকরা শিকারী বংশের সন্তান এবং আজ পর্যন্ত সুন্দরবনের সর্বশ্রেষ্ঠ ও সবচেয়ে গৌরবময় কৃতিত্বের অধিকারী শিকারী । তিনি জীবনে সাতান্নটা রয়াল বেঙ্গল বাঘ মেরেছেন, সেগুলোর মধ্যে একুশটাই ছিল ভয়ঙ্কর মানুষখোকো।

১৯৭২ সাল পর্যন্ত সুন্দরবনে বাঘকে উপদ্রব বলে গণ্য করা হত। তখন অনুমোদনপ্রাপ্ত যে কোন শিকারী বাঘ মেরে চামড়া ও মাথার খুলি বন অফিসে জমা দিলে তাঁকে অর্থ পুরস্কার দেওয়া হত। ১৯৭৩ সালে জারীকৃত বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী বনে এখন সকল প্রকার প্রাণী শিকার নিষিদ্ধ, বন দফতর থেকে ‘মানুষখেকো’ বলে কাগজেপত্রে ঘোষণা করলে তবেই কেবল সেই বাঘ মারা যায়। পচাব্দী গাজীর শিকার জীবন ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বিস্তৃত, যদিও আশির দশকের শেষভাগে তিনি আরো একটি বিখ্যাত মানুষখেকো বাঘ মেরেছেন। তিনি প্রথমে চাকরী করতেন না, পিতার মত স্বাধীনভাবে শিকার করতেন, পরে বিখ্যাত বন কর্মকর্তা জনাব আবদুল আলীম তাঁকে বন বিভাগের চাকরীতে নিয়ে আসেন। ফ্রান্স, জার্মানী, মধ্যপ্রাচ্য ও জাপানের পত্র-পত্রিকা ও টেলিভিশনে শিকারী পচাব্দী গাজীর কৃতিত্বের কাহিনী প্রচারিত হয়।

বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় সেবা প্রকাশণী থেকে ১৯৮০ সালে।  বিখ্যাত শিকারি পচাব্দী গাজীর জবানিতে বইটি লিখেছেন হুমায়ুন খান। বইয়ে ৭টি অনুচ্ছেদ আছে। ১. আঠারোবেকির বাঘ, ২. দুবলার চরের মানুষখেকো, ৩. গোলখালীর বিভীষিকা, ৪. সুন্দরবনের ভয়ঙ্কর, ৫. শিকারী জীবনের বিচ্ছিন্ন স্মৃতি, ৬. সুপতির মানুষখেকো, ৭. তালপট্টির বিভীষিকা।

তেইশজন মানুষ খাওয়ার পরে এই ভয়ঙ্কর বাঘটা আমার হাতে মারা পরে। এটার কথা আমি সবার আগে বলব সাতক্ষীরা জিলার শ্যামনগর থানার অধিকাংশ এলাকাই সুন্দরবনের অন্তর্ভুক্ত। রায়মঙ্গল ও যমুনা নদী দুইটি শ্যামনগরের ভিতর দিয়ে বয়ে গিয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে; দুই নদীর মাঝখানের মৌজাটির নাম আঠারবেকী। প্রায় বিশ মাইল লম্বা মৌজা, পুরাটাই বন আর বন। সুন্দরবন। অত্যন্ত ঘন গজানো গরান আর গেওয়া বন, তার সঙ্গে সুন্দরী, কাঁকড়া, কেওড়া, বাইন ও অন্যান্য গাছ। মাঝে মাঝে হুদো লতার জঙ্গল, আবার অতি দুর্ভেদ্য হেতাল ঝোপ-বাঘের প্রধান আস্তানা।

নদী থেকে বের হওয়া অসংখ্য ছোটবড় খালে মৌজাটি প্রায় জালের মত ছাওয়া। চব্বিশ ঘন্টায় দুইবার জোয়ার, দুইবার ভাটা হয়। জোয়ারকে আমরা সুন্দরবনের লোকেরা বলি ‘গোণ লেগেছে’, অর্থাৎ গ্রহণ লেগেছে। সে সময়ে খালগুলো কানায় কানায় ভরে যায়, পাড় ডুবে বনের ভিতরেও হাঁটু পানি হয়। আবার ভাটার টানে সেই পানি সব নেমে যায়, তখন ঝিঝিরা পানিতে পড়ে থাকে অসংখ্য ছোট-বড় লোনাপানির মাছ। সুন্দরবনের সব নদী ও খালের পানিই লোনা।

এক আঠারবেকী মৌজার মধ্যেই এ রকম অসংখ্য খাল রয়েছে-নদীতে পড়েছে, নদী থেকে উঠেছে। এগুলোর ধারে ধারে, নদীর কিনারে সুন্দরবনের বিখ্যাত গোলপাতার গাছ হয়। পাতা গোল নয়, হুবহু নারিকেল পাতার মত, আবার নারিকেল গাছের মত কাণ্ড হয় না, একেবারে গোড়া থেকেই পাতা গজায়। গোলপাতা দিয়ে ঘরের ছাউনি হয়, বেড়া হয়, নৌকার ছৈ হয় সাবেক খুলনা, যশোর, বরিশাল, পটুয়াখালী ও নোয়াখালী জিলার নীচু অঞ্চলের অধিকাংশ নিম্নবিত্ত মানুষের ঘরই গোলপাতা দিয়ে ছাওয়া। অনেক অবস্থাপন্ন গৃহস্থের ঘরেও এই ছাউনি থাকে, একেক ছাউনিতে সাত-আট বছর চলে যায়। সুন্দরবনের নদী খালের কিনারা থেকে যারা এই গোলপাতা কেটে আনে, দুর্গম বন এলাকা থেকে যারা কাঠের গুড়ি আর লাকড়ি কেটে আনে তাদেরকেই বলা হয় ‘বাওয়ালী । এরা নেহায়েত দরিদ্র শ্রমিক, পেটের দায়ে বনে গিয়ে কাজ করে কোনরকমে সংসার চালায়।

ইংরাজী ১৯৬৬ সালের ঘটনা। সকাল সাতটা-আটটার সময়ে ছয়জন বাওয়ালী দুই ডিঙি নৌকা করে আঠারবেকীতে গোলপাতা কাটতে যায়। খালের কিনারা জুড়ে একটানা বিস্তৃত গোলগাছের কাছে ডিঙি বেঁধে কিনারায় আধা কাদা আধা-মাটিতে নেমে গোলপাতা কাটছিল, কেউ কারো থেকে বেশী দূরে নয়। একজন বাওয়ালী দুইখানা ডগা কেটে মাটিতে রেখে তৃতীয়টির গোড়ায় দায়ের কোপ দিয়েছে, সেই মুহূর্তে বাম পাশ থেকে হুঙ্কার দিয়ে বাঘ তার উপরে পড়ে। ঘাড় কামড়ে ধরে বিড়াল যে রকম সহজে ইঁদুর নিয়ে যায় ঠিক তেমনি বাওয়ালীকে নিয়ে পিছনের জঙ্গলে চলে যায় ।

বাঘের ‘হুঙ্ক!’ গর্জন শুনেই পাঁচজন বাওয়ালীর আত্মা কেঁপে উঠে, দুইজন গোলগাছের উপড়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায়। পুরা হুঁশ হলে পাচজনই উঠে সঙ্গী যেখানে পাতা কাটছিল সেই গাছটার কাছে যায়। তাকে বাঘে নিয়ে গেছে চোখেই দেখেছে, তবু বিশ্বাস হতে চায় না। তার দা গোলগাছের গোড়ায় পড়ে রয়েছে, তীরের মত রক্ত ছুটে গাছের পাতায় আর কাদাতে লেগেছে, গোলপাতার ধার বেয়ে নীচে পড়ছে । সংখ্যায় পাঁচজন ছিল বলে আর সকালবেলা বলে বাওয়ালীরা সাহস সম্পূর্ণ হারায়নি। দা-কাঠ-লাঠি নিয়ে চীৎকার করতে করতে তারা সঙ্গীকে উদ্ধার করতে রওনা হয়। ভিজা মাটিতে বাঘের পারা ও তাজা রক্ত দেখে এগুতে থাকে। হাত বিশেক যেতেই তার নীল-রঙা লুঙ্গি পায়, এক কোনা গাছের ডালের সঙ্গে আটকা, একজনে ছিঁড়া লুঙ্গিটা হাতে তুলে নেয়।

পাঁচজনে আবার এগুতে থাকে। আরও আন্দাজ দুইশ হাত জঙ্গলের ভিতরে গিয়ে তারা লাশ পায়। বাওয়ালীর উলঙ্গ শরীরটা কুঁচকানো, মাথা একদিকে কাত হয়ে আছে। পিঠ আর বাম হাতে বাঘ যে থাবা মেরেছে গোশত আলগা হয়ে গেছে, ঘাড় গলা মারাত্মক দাঁতের কামড়ে এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে গেছে, প্রচুর রক্ত পড়েছে এবং তখনো পড়ছে।

বাওয়ালীরা হৈ-চৈ চীৎকার করতে করতে লাশ নৌকায় নিয়ে আসে। আঠারবেকীর মানুষখেকো বাঘ তার প্রথম শিকার খেতে পারেনি। দ্বিতীয়টি পেরেছিল। সেই দিনই রাত্রে এই ঘটনাস্থল থেকে মাত্র পোয়া মাইল দূরে ফুলখালীর খালের গোলপাতা বোঝাই নৌকায় ঘুমাচ্ছিল চারজন বাওয়ালী। এটা সুন্দরবনের খুব সাধারণ দৃশ্য এবং চিরাচরিত রীতি। খুব সকাল থেকে একেবারে সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত বাওয়ালীরা বনে কাঠ, লাকড়ি বা গোলপাতা কাটে। রাত হলে কাঠ-কাটা বাওয়ালীরা নদীর কিনারায় মাটি থেকে সাত-আট হাত উঁচুতে তৈরী টোঙ বা অস্থায়ী ছোট্ট ঘরে গিয়ে ঢালা বিছানাতে ঘুমায়। কিন্তু পাতা-কাটা বাওয়ালীরা পাড় থেকে পনেরো-বিশ হাত বাইরে নৌকা গেড়ে সেখানে ঘুমায়। জোয়ারের সময়ে অনেকে খালেও রাত কাটায়। ভাটার সময়ে খালে পানি কম থাকলে তখন নৌকা নদীতে নিয়ে গিয়ে সে রকমই কিনারা থেকে পনের, বিশ কি তিরিশ হাত দূরে গেড়ে ঘুমায় নৌকা বড় হলে মজবুত ছৈ-এর তলে তারা নিরাপদেই থাকে, কিন্তু মাঝারি নৌকা হলে সাধারণ একটা ছৈ-মাত্র তাদের রাত কাটাবার আশ্রয় হয় ।

ফুলখালীর খাল বেশ বড়, চল্লিশ হাতের কম প্রশস্ত নয়। চারজন বাওয়ালী ছিল মাঝারি আকারের নৌকাতে। সামান্য ছৈ-এর তলায় সকলের জায়গা হয় না, বাকী নৌকাতে গোলপাতা বোঝাই, উপরভাগ সমান। সেই পাতার উপরেও বিছানা করা হয়েছিল। ভাত খেয়ে, হুঁকা খেয়ে, চারজন রাতের মত শুয়ে পড়ে। দুইজনের পুরা শরীরই ছৈ-এর ভিতরে থাকলেও পা ছিল বাইরে।

সকালবেলা মাত্র পোয়া মাইল দূরের একজন গোলপাতা কাটা বাওয়ালীকে যে বাঘে খেয়েছে সে কথা এই চারজন বাওয়ালী শুনেছিল, যদিও লাশ তারা দেখতে যায়নি। তা সত্ত্বেও মাত্র আধ মাইলখানেক দূরের নদীতে না গিয়ে তারা যে খালেই ঘুমানো স্থির করেছিল সেটা অবশ্য ছিল তাদের দুঃসাহস এবং বোকামী, কিন্তু সে ধরনের বোকামী সুন্দরবনে আদৌ কোন বিরল ঘটনা নয়। আগের দিন বিকালে যেখান থেকে হয়ত বাঘে মানুষ ধরে নিয়ে গেছে, পরদিন সকালেই তার আশেপাশে বাওয়ালীরা আবার কাজ করছে, এটা বনে অহরহ ঘটে থাকে ।

এদের নৌকা গোলপাতায় ভরেনি, আরো পাঁচ-সাত মন আন্দাজ খালি ছিল। ভেবেছিল যে, পরদিন সকালে আরো ঘন্টা দুই ঘন্টা পাতা কেটে বোঝাই পুরা করে তখন নৌকা ছাড়বে । তাছাড়া তাদের পানির হিসাবও মোটামুটি ঠিক ছিল। রাত্রে যখন তারা ঘুমায় তখন খালে ছিল জোয়ার ভাটার টানে পানি কমতে শুরু করলেও ভোর রাতের আগে ভাটা শেষ হবে না, তখন তারা ঘুম থেকে উঠে নামাজ-কালাম পড়বে। ফুলখালীর খালে ভাটার সময়েও কিছু পানি থাকে এবং মাঝখালে নৌকা রাখা চলে ।

কিন্তু আঠারবেকীর মানুষখেকো ছিল সুন্দরবনের ইতিহাসে এক অতি ভয়ঙ্কর বাঘ । সম্পূর্ণ অচিন্তিত উপায়ে সে একজন হতভাগা মানুষকে ধরে নিয়ে যায়। রাত আন্দাজ বারোটার কাছাকাছি সময়ে বাঘ নিঃশব্দে সাঁতার কেটে কিনারা থেকে দূরে নৌকাতে গিয়ে উঠে। বাঘের ভরে নৌকা একদিকে কাত হয়ে ডুবে যাওয়ার মত হয়। তখন ডিঙিতে আধা শরীর তুলে ছৈ-এর বাইরে শোওয়া যে বাওয়ালীর ঘাড় কামড়ে ধরে, সে কেবল ‘ক্ক্যাক!’ করে একটা শব্দমাত্র উচ্চারণ করতে পেরেছিল। তিনজন বাওয়ালীর ভয়ার্ত ‘বাঘ! বাঘ! যাঃ! যাঃ!’ চীৎকারে কিছুমাত্র না দমে, লোকটিকে মুখে তুলে বিশাল বড় বাঘ খাল পার হয়ে বনের ভিতরে অদৃশ্য হয়ে যায়।

ভয়াবহ স্তব্ধতার মাঝে তিন বাওয়ালীর বাকী রাত কাটে। সকালে সূর্য উঠলে তখন নৌকা খুলে তারা গিয়ে আরো দশ-বারোজন বাওয়ালী ভাইকে ডেকে আনে। সকলে মিলে দা-কাঠ-কুড়াল নিয়ে হৈ-চৈ করতে করতে জঙ্গলে ঢোকে। বাঘের পারা দেখে দেখে প্রায় সিকি মাইল ভিতরে গিয়ে একটা আঁটো যায়গায় লাশ পায়। রাতের মধ্যে বাঘ বাওয়ালীর পেট, নাড়িভুরি, কোমর ও উরু সব খেয়ে ফেলেছে। সেই আধা-খাওয়া লাশ এনে তারা বন বিভাগের অস্থায়ী অফিসে এই মৃত্যুর খবর রেকর্ড করায় এবং তারপরে জানাজা পড়ে নদীর চরেই দাফন করে। এর পরে তিনদিন পর্যন্ত বাঘ যদিও আর কাউকে আক্রমণ করেনি তবু সমস্ত আঠারবেকী এলাকায় মারাত্মক ভীতি ছড়িয়ে পড়ে।

বন বিভাগের কর্মকর্তাগণ মানুষখেকো বাঘ সম্বন্ধে সতর্ক হয়ে উঠেন। অবিলম্বেই বন দফতরের কয়েকজন শিকা বন্দুক ও রাইফেল নিয়ে বের হয়ে যান। কর্মকর্তাদের মধ্যে শিকারী আছেন, অন্যান্য বন কর্মচারীগণের মধ্যেও কেউ কেউ আছেন যে শিকার করতে জানেন—যদিও তাঁরা ঠিক পেশাদার শিকারী নন। কোনখানে মানুষখেকো বাঘের উপদ্রব হলে সঙ্গে সঙ্গে এই শিকারীগণ সেখানে গিয়ে বাঘের মোকাবিলা করতে চেষ্টা করেন এবং বাওয়ালীরা যাতে নির্বিঘ্নে কাজ করতে পারে সে রকম নিরাপত্তার বিধান করেন। যখন এই ব্যবস্থা যথেষ্ট না হয় তখন বন বিভাগ থেকে মানুষখেকো বাঘের জন্যে পুরস্কার ঘোষণা করা হয় এবং পেশাদার শিকারীগণকে জরুরী সংবাদ পাঠানো হয় ।

ঠিক তিন দিন পরে বাঘ আরেকজন বাওয়ালীকে ধরে নিয়ে যায়। ফুলখালী থেকে কাঁচিকাটা খালের দূরত্ব আধ মাইলের বেশী নয়। দুইটি ডিঙি নৌকা করে ছয় বাওয়ালী গোলপাতা কাটছিল খালে। ফুলখালীর বাওয়ালীকে বাঘে খাওয়ার পর থেকে আঠারবেকীর আর সব বাওয়ালীই যতদূর সম্ভব সাবধানতার সঙ্গে পাতা কাটতে থাকে দল থেকে দূরে একাকী না থেকে পরস্পর কাছাকাছি থাকলে বাঘের আক্রমণের সম্ভাবনা কম থাকে। এই বাওয়ালীরাও খুব সতর্কতার সঙ্গেই কাজ করছিল

সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত নির্বিঘ্নে পাতা কেটে, গোসল করে, বাওয়ালীরা নৌকায় বসে ভাত খায়। তারপর খানিক বিশ্রাম করে, হুঁকা টেনে, আবার গিয়ে পাতা কাটায় লাগে। কেউই একজন আরেকজন থেকে পাঁচ-সাত হাতের বেশী দূরে ছিল না। হঠাৎ ‘হুঙ্ক!’ করে এক ভয়ঙ্কর গর্জনের সঙ্গে বাঘ আড়াল থেকে একজন বাওয়ালীর ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ে। আক্রমণের ধাক্কায় আর বাঘের বিশাল দেহের ভারে বাওয়ালী তলে পড়ে যায়।

এই কাহিনী যিনি পড়বেন তিনি সঙ্গী বাওয়ালীদের সাবাসী না দিয়ে পারবেন না। হয়ত কতকটা মানসিক প্রস্তুতি তাদের ছিল, হয়ত বা একেবারে গায়ের কাছেই ঘটনাটি ঘটায় তারা মহা সাহসের সঙ্গে এক অবিশ্বাস্য কাজ করে ফেলে। পাঁচজন একসঙ্গে বনের কাটা ডাল দিয়ে বাঘকে পিটাতে থাকে আর চীৎকার করতে থাকে। তখন বাঘ শিকার ছেড়ে দিয়ে জঙ্গলের ভিতরে চলে যায়।

হতভাগ্য বাওয়ালীর নিঃসাড় দেহ পড়ে থাকে সেখানে। মরা। ঘাড় থেকে মাথা থেকে তখন স্রোতের মত রক্ত ছুটছে। ঘাড়-মাথা জুড়ে একটা কামড় দিয়ে ধরেছিল, তাতে তার মাথা চ্যাপ্টা হয়ে গেছে। বাওয়ালীরা কাশিমারী গ্রামের বাড়ীতে নিয়ে গিয়ে তাকে দাফন করে।

কয়েকদিন পরেই এই বাওয়ালী দলটি আবার গোলপাতা কাটতে এলে তখন আমি গিয়ে তাদের সঙ্গে দেখা করি এবং ঘটনার বিস্তারিত জানতে চাই। তখন একজন আমাকে বলে যে, ‘বিশাল বড় বাঘ, আমার মাথার উপর দিয়ে লাফ দিয়ে গিয়ে ওকে ধরল!’ আর আরেকজন বলে, ‘এই লাঠি দিয়ে বাড়ি মেরে বাঘকে খেদিয়েছি!’

বর্ণনা দুইটি যত রোমাঞ্চকর তার চেয়ে অনেক বেশী দুঃসাহসিক। সঙ্গের সঙ্গীকে নিয়ে যাচ্ছে বাঘে, আর তাকে বাঁচানোর জন্যে মহা শক্তিমান ও হিংস্র জন্তুটিকে লাঠির বাড়ি দিয়ে তাড়ানোর চেষ্টা করাতে যে কি পরিমাণ সাহসের দরকার হতে পারে তা সার্কাসের বা চিড়িয়াখানার বাঘ দেখে ধারণা করা যাবে না। অন্তহীন, জনবসতিহীন গভীর বনে এমন কি দূরেও একটা সাধারণ বাঘ দেখলে প্রাণে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়ে যায়; আর বিশাল আকারের মানুষখেকোর মুখের সামনে অসহায় মানুষের পক্ষে নিজের জীবন বিপন্ন করে সঙ্গীকে বাঁচানোর চেষ্টা করাতে অবিশ্বাস্য বীরত্বেরই দরকার হয়। একটিমাত্র থাবায় তার মৃত্যু হতে পারে, আর থাবা মারতে বাঘের এক সেকেণ্ড সময়ও লাগে না। সুন্দরবনের দরিদ্র, অশিক্ষিত বাওয়ালীদের মধ্যে মনুষ্যত্বের এই যে পরিচয় এর কোন তুলনা নেই।
পর পর কয়েকজন বাওয়ালী বাঘের মুখে যাওয়ায় সমস্ত বন বিভাগে এক মহা শঙ্কা ও চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়ে যায়। বন কর্মকর্তা ও বনরক্ষীদের মধ্যে যারা শিকারী ছিলেন তাঁরা ইতিমধ্যেই বোট নিয়ে নৌকা নিয়ে আঠারবেকীতে বাঘের অনুসন্ধানে ছিলেন । কেউ যদিও এই বাঘকে একটি গুলি করার সুযোগ পাননি, তবু তাঁরা সকাল-সন্ধ্যা আপ্রাণ চেষ্টা করেই যাচ্ছিলেন। এই সময়ে বন বিভাগ থেকে সুন্দরবনের পেশাদার শিকারী পরিবারগুলোর কাছে এই বাঘ শিকারের জন্যে সংবাদ পাঠানো হয়। আমি অবিলম্বে রওনা হয়ে যাই এবং আঠারবেকীর অস্থায়ী বন অফিসে গিয়ে অন্যান্য শিকারীগণের সঙ্গে যোগ দিই।

বন বিভাগ থেকে শিকারীগণকে সকল রকম সুযোগ সুবিধা দেওয়া হল। আমাকে নেওয়া হয় এক বোটে, সঙ্গে একটি ডিঙি নৌকা এবং কয়েকজন বনপ্রহরী ও বনমাঝিকে সাহায্যের জন্য দেওয়া হয়। বড় বোট নদীতে রেখে ডিঙি করে সকাল সন্ধ্যা এক খাল থেকে আরেক খালে, পাড়ে উঠে কিনারে, এবং যেখানে যতদূর সম্ভব বনের ভিতরে গিয়ে আমি বাঘের খোঁজ করতে লাগলাম। সুন্দরবনে এভাবে ছাড়া খোজার বা চলাচলের আর কোন উপায় নেই। বিশাল বনের কোনখানে রাস্তাঘাট বলে কিছু নেই, কোন রাস্তার চিহ্নও নেই। একটানা বনের এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়ার একমাত্র উপায় নৌকা। আমি সকলের সঙ্গে অব্যাহতভাবে মানুষখেকো বাঘের সন্ধান করতে লাগলাম।

এর মধ্যে আঠারবেকী এলাকায় কর্মরত সকল বাওয়ালী ও জেলেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল যে, কোনখানে বাঘে কাউকে নিয়ে গেলে বা আক্রমণ করলে বা বাঘ দেখলেও যেন অস্থায়ী বন অফিসে বা কোন না কোন বোটে সঙ্গে সঙ্গে খবর দেওয়া হয়। তারপর কয়েকদিন ধরে চলল আমাদের সবার প্রাণান্তকর চেষ্টা আর সন্ধান। সেই সব চেষ্টাই ব্যর্থ হল, কোনখানে একবার বাঘ দেখতে পেলাম না। নৈরাশ্যের মধ্যে হঠাৎ একদিন অত্যন্ত দুঃখজনক আরেকটি মৃত্যুসংবাদ এল-আঠারবেকী মৌজা থেকেই। পাড় আঁটুনির খালে এক হিন্দু জেলে তার ছেলেকে নিয়ে মাছ ধরছিল। এই বৃদ্ধ সারা জীবন মাছ ধরেছে সুন্দরবনের খালে আর গাঙে। ছেলেকে যে সঙ্গে নিয়েছে তাও আজ অনেক বছর । বাঘ সে হয়ত দেখেছে বহুবার, চোখের সামনে দিয়ে গাঙ পার হয়ে যেতেও হয়ত দেখেছে বহুবার, কিন্তু মানুষখেকোর নজরে পড়তে হয়নি কোনদিন; একবার নজরে পড়ল, সেই সেবারেই মৃত্যু ঘটল।

আগের দিন সন্ধ্যায় বাপ-ছেলে পাড়-আঁটুনির ভরা খালে জাল পেতে রেখে গিয়েছিল, সেদিন সকালে ভাটার টানে পানি নেমে গেলে তখন ঝিঝিরা পানিতে আটকে থাকা মাছ ধরতে আসে তারা। এই জেলেরা দুইদিন, তিনদিন, চার-পাঁচ-, এমন কি সাতদিন পর্যন্ত থাকে নৌকায়; ডিঙিতে খায়, ডিঙিতেই রাত কাটায়। মাছ ধরে ধরে নৌকায় দুইপাশে বাঁধা চাই-এর মধ্যে জিইয়ে রাখে, সেগুলো ভরে গেলে তখন নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে।

একটানা কয়েক ঘন্টা খালের কাদাতে অনেক দূরে পর্যন্ত হেঁটে হেঁটে বাপ আর ছেলে মাছ ধরল। বড় ছোট নানারকম লোনা পানির মাছ। বেলা দুপুর হলে তখন রান্নার ব্যবস্থা করতে হয়, বুড়া বাপ কিনারায় উঠল লাকড়ির জন্যে। বৃদ্ধ পাড়ে উঠল শুকনা ডাল কেটে আনতে, আর ছেলে মাছ ধরতে থাকল। হঠাৎ ছেলে একটা ‘হুঙ্ক!’ গর্জন শুনল, তারপর গোঙানি, কাঠ কাটার আওয়াজ থেমে গেল। বিভ্রান্ত ছেলে ‘বাবা! বাবা!’ বলে চীৎকার করতে করতে দ্রুত পাড়ে উঠল। কিন্তু বুড়া বাবার কাছ থেকে কোন জবাব এল না। সে কাণ্ডজ্ঞানহীনের মত বনের ভিতরে ঢুকে পড়ল। হঠাৎ মাত্র কয়েক হাত সামনেই ‘হাম!’ করে বাঘের গভীর ডাক শুনে তার জ্ঞান ফিরে এল । সে ডিঙিতে ফিরে দ্রুত গিয়ে কয়েকজন বাওয়ালীকে জোগাড় করে আনল।

সুন্দরবনের এ আরেক আশ্চর্য সহমর্মিতা। কারো বাবাকে, ভাইকে কি সঙ্গীকে বাঘে নিয়ে গেছে শুনলে কাছে-ধারের আর সবাই সেখানে আসে, বিপদ উপেক্ষা করে যতদূর সাধ্য সাহায্য করে। সকলে মিলে হৈ-চৈ করতে করতে বাঘের পায়ের চিহ্ন আর রক্তের দাগ দেখে বনের ভিতরে এগুতে থাকল। কিছুদূর যেতেই জেলের পরনের কাপড় পেল। বাপের দা আর রক্তমাখা কাপড় হাতে নিয়ে ছেলে ছুটতে লাগল পাগলের মত । সেই উদভ্রান্ত মুহূর্তে তার যেন বিশ্বাস ছিল যে, তাড়াতাড়ি যেতে পারলে বাবাকে সে জীবিতই উদ্ধার করে আনতে পারবে। কিন্তু বেলা ইতিমধ্যে পাঁচটা-সাড়ে পাঁচটা হয়ে যাওয়াতে বাওয়ালীরা বাধ্য হয়ে অনুসন্ধান স্থগিত করে এবং ছেলেকে জোর করে নৌকায় ফিরিয়ে নিয়ে আসে। বনে অন্ধকার দ্রুত ঘন হয়ে আসছিল, তাই আর অগ্রসর হওয়া তাদের পক্ষে মোটেই নিরাপদ ছিল না। এই জেলের দেহের অবশিষ্ট আর উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।

আঠারবেকী মৌজা সীমানার মধ্যেই এই বাঘ একের পরে এক অসহায় জেলে ও বাওয়ালীকে খেতে থাকে। সমস্ত এলাকায় মারাত্মক ত্রাসের সৃষ্টি হয়ে যায়, বহু খালে বাওয়ালীরা প্রাণভয়ে লাকড়ি ও পাতা কাটা বন্ধ করে দেয়, জেলেরাও মাছ ধরা বন্ধ করে দেয়—যদিও এটাই তাদের রুজি রোজগারের উপায়। কয়েকজন বন কর্মকর্তা, অন্যান্য শিকারী ও আমি বহু চেষ্টা করেও তখন পর্যন্ত একবার মানুষখেকো বাঘ দেখতে পাইনি। আমি কেবল পায়ের পারার দাগ পেয়েছিলাম। কয়েকদিনের বাসি চিহ্ন হলেও বুঝতে পেরেছিলাম যে সেটা বিশাল এবং অস্বাভাবিক বড় এক বাঘের পারা; তত বড় আমি আগে আর কোনদিন দেখিনি।
এর মধ্যে একটি জার্মান টেলিভিশন দল সুন্দরবনে আসে ছবি তুলতে। সামগ্রিকভাবে পৃথিবীবিখ্যাত সুন্দরবনের এবং বিশেষ করে রয়াল বেঙ্গল টাইগারের চলচ্চিত্র তুলে নিয়ে যাবেন তাঁরা। রাজা, রাষ্ট্রপ্রধান, কোন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব বা বিদেশীগণ সুন্দরবনে এলে বন দফতর থেকে সাধারণতঃ আমাকেই তাঁদের গাইড নিযুক্ত করা হয়। জার্মান দলের গাইডও আমাকেই নিযুক্ত করা হল।

যথাশীঘ্র সম্ভব খুলনা শহরে যাবার জন্যে আমার প্রতি জরুরী নির্দেশ এল যে বাঘের মাত্র কয়েকটি ভয়াবহতার আমি উল্লেখ করেছি, যে বাঘ কয়েক সপ্তাহ যাবত আমাদের সকল শিকারীর আপ্রাণ চেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়ে এক বর্ণনাতীত ত্রাসের সৃষ্টি করে ফেলেছে তাকে জীবিত রেখে খুলনা শহরে যাবার কথা আমি চিন্তাও করতে পারিনি। কিন্তু বাধ্য হয়েই আমাকে আঠারবেকী ছেড়ে যেতে হল এই দলের কয়েকজনই ছিলেন নামকরা শিকারী। একজন মেম ছিলেন, তাঁরও শিকারে আগ্রহ কিছু কম ছিল না, কিন্তু দুনিয়ার অন্যান্য জায়গায় বনভূমিতে সাধারণ বাঘ শিকার করলেও সুন্দরবনে মানুষখেকো রয়াল বেঙ্গল শিকারের পূর্ব অভিজ্ঞতা তাঁদের কারো ছিল না।

আঠারবেকীতে এক মানুষখেকোর উপর্যুপরি আক্রমণে সেই এলাকায় জেলে বাওয়ালীদের সকল কাজ বন্ধ হবার অবস্থা হয়েছে শুনে তাঁরা সেখানেই যাবেন বলে স্থির করলেন। টেলিভিশনের ছবি তুলতে এসেছেন, দুঃসাহস যতটা আছে এখানকার ভয়াবহতার ধারণা ততটা নেই। তাঁদেরকে আঠারবেকীতে নিয়ে যাওয়া আমার পক্ষে উচিত ছিল না, কিন্তু হতভাগ্য জেলে-বাওয়ালীদেরকে ধূর্ত মানুষখেকোর খোরাক করে রেখে বনের অন্য কোন নিরাপদ জায়গায় গেলেও আমি বোধ হয় শাস্তি পেতাম না। মনের এক দিকের অনিচ্ছার উপরে আরেক দিকের ইচ্ছাই জয়ী হল এবং সম্ভাব্য বিপদের কথা সবই উল্লেখ করার পরে জার্মান দলকে শেষ পর্যন্ত আমি আঠারবেকীতে নিয়ে গেলাম।

এই সময়ের মধ্যে বাঘ আরো মানুষ খেয়েছে, বাওয়ালী-জেলেরা প্রতিদিন বন ত্যাগ করছে। বন অফিসের এবং পেশাদার শিকারীগণও আপ্রাণ চেষ্টা করেও কেউ এই মানুষখেকোটিকে একটি গুলি করার সুযোগ পাননি, যদিও তাঁরা বৃঘের পায়ের চিহ্ন দেখে সন্ধান করেছেন, রাত জেগেছেন এবং অনেক বিপদেরও ঝুঁকি নিয়েছেন।

সব বাঘ মানুষখেকো হয় না, যেটা হয় বুড়া হলে হয়। শরীরের শক্তি কমে গেলে যখন আর দ্রুতগামী হরিণ ধরতে পারে না, শুয়োর ধরতে পারে না, তখনি বাঘ মানুষ ধরে খায়, কারণ মানুষ অসহায় প্রাণী। আর, একবার মানুষখেকো হলে তখন বাঘ কেবল মানুষই খায়, অন্য কোন প্রাণী ধরতে যায় না। আঠারবেকীর মানুষখেকো বাঘ বিশজন জেলে ও বাওয়ালীকে মেরে আতঙ্কজনক রেকর্ড করে ফেলে এবং তা মাত্র মাস দেড়-দুই সময়ের মধ্যে সুন্দরবনের ইতিহাসে সে রকম ব্যাপক ভীতি আর অচল অবস্থা আর কখনো সৃষ্টি হয়নি। জার্মান টেলিভিশন দলকে নিয়ে আঠারবেকীতে পৌছেই আমরা যে জোড়া ঘটনার খবর পেলাম তার বর্ণনা না করে পারছি না।

একজন হিন্দু নমশুদ্র, সবার কাছে গুণীন বলে পরিচিত ছিল। গুণীন এজন্যে যে, তিনি বনের হিংস্র জীবজন্তু বশীভূত করার মন্ত্র জানতেন। অনেক বাওয়ালী ও জেলে তাঁকে সঙ্গে নিয়ে বা তাঁর কাছ থেকে মন্ত্রপূতঃ লাল কাপড়ের টুকরা নিয়ে বনে কাজ করতে যেত এবং কাজের স্থানে কাপড়টি নিশানের মত করে গেড়ে রাখত। এতকাল পর্যন্ত কোনদিন তাঁর মন্ত্রের কার্যকারিতা মিথ্যা প্রমাণিত হয়নি বলে এই গুণীন বাওয়ালী এবং জেলেদের কাছে বিশেষ শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি ছিলেন যে তিনি একবার মন্ত্র পড়ে দিলে তাতে বনের দেবী বনবিবি বশীভূত হন; বাঘের সাধ্য নেই যে আর কাছে আসে। বনের বিশালত্ব, অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশ, জনমানবহীনতা, হিংস্র মানুষখেকো বাঘ, অজগর, কুমীর ও হাঙরের যত্রতত্র উপস্থিতির জন্যে মানুষের মনে যে অসহায়ত্ববোধ জাগে, গুণীনগণের যাদুটোনা সেখানে স্বভাবত কিঞ্চিত নিরাপত্তাবোধ আনে এবং মানুষকে বনে কাজ করার শক্তি জোগায়। কিন্তু এই খ্যাতনামা গুণীনের মন্ত্রবল শেষ পর্যন্ত তাঁর নিজের জীবনেই অসার বলে প্রমাণিত হয় এবং তা এই আঠারবেকীতে।

গুণীনরা বাওয়ালীদের সঙ্গে লাকড়ি, গোলপাতা কাটার যায়গাতে যান। এই গুণীনও বাওয়ালী দল নিয়ে যেতে চাইলেন। কিন্তু বন অফিস এবার তাঁকে টিকিট দিতে অস্বীকার করে। কর্মকর্তা গুণীনকে দোলনপীরের খাল ছাড়া অন্য কোন খালের টিকিট নিতে বললেন, কেন না গত মাস দেড়েকের মধ্যে দোলনপীরে বেশীরকম মানুষ মারা পড়েছে। কিন্তু গুণীন দোলনপীরেরই টিকিট চান, সেখানে গোলপাতা বেশী আছে এবং মন্ত্র দিয়ে তিনি এলাকা আটক করে নিবেন, বাঘের আর কোন শক্তি থাকবে না। তখন নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেই বন কর্মকর্তা সেই বাওয়ালী দলকে পাঁচটি নৌকা নিয়ে পাতা কাটার পারমিট দেন।

চার ডিঙি এবং একটি বড়, মোট পাঁচ নৌকায় পনেরজন বাওয়ালী রাত্রিবেলা দোলনপীরের খালে গিয়ে নৌকা গাড়ে। রাত্রেই গুণীন মন্ত্র দিয়ে সেই এলাকা ‘আটক’ করে ফেলেন এবং সকাল সাতটার সময়ে বাওয়ালীরা খালের পাড় থেকে পাতা কাটতে শুরু করে। দুপুর পর্যন্ত নির্বিঘ্নে কাজ করে তারা বড় নৌকাতে এসে ভাত খায়। পান তামাক খেয়ে পড়ন্ত বেলায় আবার কাজে লাগে এবং সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রচুর পাতা কাটে— গোলপাতা সেখানে যথেষ্টই ছিল। রাতে মন্ত্রের উপরে আস্থাশীল পনেরজন লোকই বড় নৌকায় নির্বিঘ্নে ঘুমায়।

সকালে কারো মনেই আর তেমন কোন ভয় নেই, সেদিন তারা আরো কিছুটা উজানে পাতা কাটতে যাবে। সবার আগে গুণীনের নৌকা, বৈঠা হাতে গলুই-পাছায় দুইজন বাওয়ালী এবং মাঝখানে তিনি বসা। তখন ভাটার সময় বলে কিছুদূর গিয়েই নৌকা খালে আটকে যায়। পাছার বাওয়ালী একটা বিড়ি ধরায় তিনজনেই টানবে বলে, হঠাৎ পাড় থেকে বাঘ লাফ দিয়ে গুণীনকে ধরে। আক্রমণের চোটে নৌকা কাত হয়ে যায় আর শিকারসহ বাঘ খালের পানিতে গিয়ে পড়ে। মৃত্যুরূপ মহাবিপদ যখন একেবারে সামনে এসে পড়ে মানুষ কখনো তখন অবিশ্বাস্যরকমের সাহসী হয়ে উঠে। পাছার বাওয়ালী চীৎকার করতে করতে হাতের বৈঠা দিয়ে বাঘের মাথায় পিটাতে শুরু করে।

করেস্পন্ডেন্ট January 16, 2025
Share this Article
Facebook Twitter Whatsapp Whatsapp LinkedIn Email Copy Link Print
Previous Article পলিনেট হাউজে চারা উৎপাদন ও সবজি চাষে সফল কৃষক
Next Article বাংলাদেশে এইচএমপিভিতে আক্রান্ত নারীর মৃত্যু
Leave a comment

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

দিনপঞ্জি

July 2025
S M T W T F S
 12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
2728293031  
« Jun    
- Advertisement -
Ad imageAd image
আরো পড়ুন
তাজা খবরসাতক্ষীরা

সাতক্ষীরা পৌর এলাকায় বিশুদ্ধ পানি সংকটে নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে জারের পানির ওপর

By করেস্পন্ডেন্ট 15 minutes ago
তাজা খবরসাতক্ষীরা

সাতক্ষীরা ‌৩মাস ধরে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেও মায়ের দেখা পেল না শিশু তোয়া-ফুয়াদ

By করেস্পন্ডেন্ট 1 hour ago
তাজা খবরসাতক্ষীরা

সাতক্ষীরায় পিতা-মাতা কারাগারে মুক্তির দাবিতে ‌অসহায় ৩ শিশু সন্তান

By করেস্পন্ডেন্ট 2 hours ago

এ সম্পর্কিত আরও খবর

তাজা খবরসাতক্ষীরা

সাতক্ষীরা পৌর এলাকায় বিশুদ্ধ পানি সংকটে নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে জারের পানির ওপর

By করেস্পন্ডেন্ট 15 minutes ago
তাজা খবরসাতক্ষীরা

সাতক্ষীরা ‌৩মাস ধরে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেও মায়ের দেখা পেল না শিশু তোয়া-ফুয়াদ

By করেস্পন্ডেন্ট 1 hour ago
তাজা খবরসাতক্ষীরা

সাতক্ষীরায় পিতা-মাতা কারাগারে মুক্তির দাবিতে ‌অসহায় ৩ শিশু সন্তান

By করেস্পন্ডেন্ট 2 hours ago

প্রতিষ্ঠাতা: আক্তার জাহান রুমা

প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক: হুমায়ুন কবীর বালু

প্রকাশনার ৫২ বছর

দৈনিক জন্মভূমি

পাঠকের চাহিদা পূরণের অঙ্গীকার

প্রতিষ্ঠাতা: আক্তার জাহান রুমা

প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক: হুমায়ুন কবীর বালু

রেজি: কেএন ৭৫

প্রধান সম্পাদক: লে. কমান্ডার (অব.) রাশেদ ইকবাল, প্রকাশক: আসিফ কবীর কর্তৃক জন্মভূমি প্রকাশনী লি: ১১০/২,সাংবাদিক হুমায়ুন কবীর বালু সড়ক, খুলনা থেকে মূদ্রিত ও প্রকাশিত

Developed By Proxima Infotech and Ali Abrar

Removed from reading list

Undo
Welcome Back!

Sign in to your account

Lost your password?