সিরাজুল ইসলাম, শ্যামনগর : ২৩জন মানুষ খাওয়ার পরে এই ভয়াবহ বাঘটি আমার হাতে মারা পড়ে।তাই এটির কথা আমি সবার আগে বলবো।ঠিক এভাবেই আঠারোবেকীর ভয়াবহ মানুষখেকো বাঘটির বর্ণনা দিলেন সুন্দরবন তথা সমগ্র এশিয়ার বিখ্যাত শিকারি পচাব্দী গাজী।
আমি এ বর্ণনাটুকু নিয়েছি পচাব্দী গাজি কতৃক বর্ণীত হুমায়ুন খান কর্তৃক অনুলিখিত “সুন্দরবনের মানুষখেকো”নামক বইটি থেকে।বইটি বাংলাভাষায় শিকার অভিযানের উপর লিখিত একটি অত্যান্ত মুল্যবান ডকুমেন্ট।পাঠকমাত্রেই আমি অনুরোধ করবো উপরোত্ত বইটি পড়ার জন্য।এটি এখন সেবা প্রকাশনী বা প্রজাপতি প্রকাশনীতে পাওয়া যায়।আবার পচাব্দী প্রসংগে আসা যাক।
বস্তুত পচাব্দী গাজী একটি কিংবদন্তীর নাম,সুন্দরবন অঞ্চলে তিনি ও তার বংশ অত্যান্ত সুপরিচিত।তিনি তার সমসাময়িক কালের মধ্যে সবচেয়ে অগ্রগামী,তার সাহস,অধ্যাবসায়,ইস্পাত কঠিন দৃঢ় স্নায়ু এসব মিলে তিনি হয়ে উঠেন এক বিশ্ব বিখ্যাত বাঘ শিকারী।
তিনি আনুমানিক ১৯২৫ সালে সাতক্ষিরার শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়নের সোরা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তদানিন্তন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ও জার্মান চ্যাঞ্চেলরের সুন্দরবন পরিদর্শনে গাইড হিসেবে কাজ করেন এবং পুরস্কৃত হন।এছাড়াও তিনি নেপালের প্রয়াত রাজা মাহেন্দ্র ও তার ছেলে প্রয়াত বীরেন্দ্রকে নিয়েও শিকার অভিযানে যান।তিনি জীবনে অনেকগুলো নামীদামী সার্টিফিকেট ও স্মারক পান।
যদিও আমরা তাকে পচাব্দি গাজী নামে জানি, তার প্রকৃত নাম আব্দুল হামিদ গাজী। পিতার নাম মেহের আলী গাজী।মেহের আলী গাজী নিজেও বিখ্যাত শিকারী ছিলেন।তিনি তার জীবনে ৫০টির ও বেশী বাঘ মারেন।অতঃপর ১৯৫১ সালে শিঙ্গের গোলখালীর বাঘ মারতে গিয়ে তিনি বাঘের আক্রমনে গুরুতর আহত হন,তার মুখমন্ডলের সৌন্দর্য নস্ট হয়ে যায়,এ অভিযানে তার ভাই নিজামদী গাজির এক হাত বাঘ বিচ্ছিন্ন করে দেয়।এরপরো তিনি আরো ৪টি মানুষখেকো বাঘ মেরে সুপতির মানুষঅখেকো বাঘটির হাতে মারা পড়েন।উল্লেখ্য শিঙ্গের গোলখালী ও সুপতির দুটো মানুষখেকো বাঘই পরবর্তীতে পচাব্দী গাজীর হাতে মারা পড়ে।পচাব্দী গাজি তার শিকারি জীবনে প্রায় ৫৬টি বাঘ মারেন,যার মধ্যে ২৩টি ছিল ভয়াবহ মানুষখেকো।
লেখক হুমায়ুন খান তার প্রথম দেখায় এই রোগা কৃশ শিকারী সম্পর্কে এভাবে বর্ণনা দেন,এই শিকারীর বর্তমান বয়স ৫৫ এর বেশি,জীবনে তিনি ৫৬ টি রয়াল বেঙ্গল বাঘ মেরেছেন যার মধ্যে ২৩ টি ভয়াবহ মানুষখেকো।মাঝারী গড়নের এই শিকারী অতি কম কথা বলেন।ঘরে বসে যখন ধীরে ধীরে স্মৃতিকথা বর্ণনা করেন তখন শুধু তার তীক্ষ,স্থিরনিবন্ধ চোখদুটো সাক্ষ্য দেয় যে তিনি দুনিয়াতে সবচেয়ে হিংস্র রয়াল বেঙ্গল বাঘের শিকারী।তার এ দীর্ঘজীবনে কেবল দুবলাচরের বাঘ তার গায়ে এসে ঝাপিয়ে পড়ে,এটি ছিলো ভয়ংকর মানুষখেকো বাঘ।তিনি আল্লাহর অসীম রহমতে প্রানে বেচে যান,কিন্তু ভয়াবহ মানসিক পীড়নে আক্রান্ত হন।এর বিবরন আমি পাঠকের আগ্রহ থাকলে পরে পোস্ট করবো।অসীম সাহসী এই বীর শিকারি ১৯৯৭ খ্রীস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন।
আজ যদি তিনি পাশ্চাত্যের কোন দেশের শিকারী হতেন তাহলে তাদের মিডিয়ার তান্ডবে তিনি জিম করবেট বা জন হান্টার,বা কেনেথ্ এন্ডারসনদের সমতুল্য হতেন।কিন্তু এই গরীব দেশের সামান্য বনকর্মী হওয়াতে তার কোন প্রচার নেই।
তাই হুমায়ুন খান এবং মরহুম তোয়াহা খানকে অসীম কৃতজ্ঞতা জানাই।নিন্মে তার অনেকগুলো শিকার কাহিনী থেকে একটির বর্ণনা দিলামঃশুরু করার আগে এটূকু না বললেই নয়,ব্যাপারটি এমন নয় যে,পচাব্দি গাজী গেলেন বাঘ দেখলেন আর গুলি করলেন।সুন্দরবন আফ্রিকার বনের মত খোলামেলা প্রান্তর নয়,বরং এটি সমগ্র পৃথিবীর সবচেয়ে দূর্গম বন।এর ভেতর পায়ে হাটার রাস্তা বলতে গেলে নাই।আর বাঘও তার স্বভাবমত বনের বিস্তৃত অঞ্চলে ঘুরে বেড়ায়,তাই প্রায় বাঘই তাকে দীর্ঘদিন অনুসরনের পর মারতে হয়েছে।এই অনুসরনে তার মানসিক চাপ,সাহস,স্নায়ুর অবস্থা ছিলো লক্ষ্যনীয়।
আঠারবেকীর ত্রাস:
সুন্দরবনের সাতক্ষীরা অংশের যমুনা আর রায়মঙ্গল নদীর মাঝখানের মৌজা আঠারবেকী। ঘটনার শুরু ১৯৬৬ সালের এক সকালে। তখন ৭টা-৮টার মতো বাজে। দুটি ডিঙ্গি নৌকায় চেপে আঠারবেকীতে গোলপাতা কাটতে এল ছয় বাওয়ালি। ঘন হয়ে গোলপাতা জন্মেছে_এমন একটি স্থানের কাছে নৌকা বেঁধে গোলপাতা কাটতে লেগে গেল তারা। একজন দুটি গোলপাতা কেটে সবে তিন নম্বরটার গোড়ায় দা বসিয়েছে। এমন সময় ভয়ংকর গর্জন করে পাশের বন থেকে তার ওপর লাফিয়ে পড়ল একটি বাঘ। লোকটার সঙ্গীরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাকে মুখে নিয়ে আবার জঙ্গলে ঢুকে পড়ল বিশাল আকারের পুরুষ বাঘটা। শুরুতে ভড়কে গেলেও কিছুক্ষণের মধ্যেই সাহস ফিরে পেল বাকি পাঁচ বাওয়ালি। এক হাতে বৈঠা, আরেক হাতে দা নিয়ে হৈচৈ করতে করতে বনে ঢুকল। লতাপাতা ও মাটিতে লেগে থাকা ছোপ ছোপ রক্ত আর বাঘের তাজা পায়ের ছাপ ধরে অনুসরণ শুরু করল তারা। কিছুদূর গিয়েই খুঁজে পেল লাশ। সম্ভবত তাদের চেঁচামেচিতে বিরক্ত হয়েই দেহটা রেখে চলে গেছে প্রাণীটি।
সাধারণত বাঘ এক দিনে দুটি শিকার করে না। কিন্তু প্রথম শিকার হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়েই কি না, রাতে আবার হামলা চালাল ওই বাঘ। প্রথম হত্যাকাণ্ডটা যেখানে ঘটেছে, তার চেয়ে মাত্র সিকি মাইল দূরে ফুলখালী খালে নৌকায় ঘুমাচ্ছিল চার বাওয়ালি। নৌকার বেশির ভাগ অংশই ছিল গোলপাতায় বোঝাই। ফুলখালী বেশ বড় খাল, চওড়ায় অন্তত ৪০ হাত। নৌকার ওপর চাটাই বিছিয়ে শুয়েছিল তারা। দুজনের শরীর ছিল নৌকার ছইয়ের ভেতর। বাকি দুজনের মাথা ছইয়ের ভেতর হলেও পা বাইরে। খালে তখন ভরা জোয়ার। পানি ঠেলে এসে কোনো বাঘ নৌকায় আক্রমণ চালাবে, কল্পনায়ও ছিল না লোকগুলোর। কিন্তু দুরন্ত সাহসী এই বাঘটা জোয়ারের সব হিসাব-নিকাশের থোরাই কেয়ার করে। রাত ১২টার দিকে সাঁতরে নদী থেকে প্রায় ১৫ হাত দূরে নৌকায় গিয়ে উঠল ওটা। তারপর ছইয়ের বাইরে শোয়া একজন বাওয়ালির ঘাড় কামড়ে ধরে নেমে পড়ল পানিতে। লোকটা কেবল একবার ক্যাঁক শব্দ করত পারল। অন্য বাওয়ালিদের চিৎকার-চেঁচামেচিকে মোটেই পাত্তা না দিয়ে খালপাড় হয়ে বনে ঢুকে গেল বাঘটি। সকালে বেশ কয়েকজন বাওয়ালি একত্র হয়ে বনের গভীর থেকে উদ্ধার করে লাশ। ইতিমধ্যে মড়ির মৃতদেহ বেশির ভাগই খেয়ে ফেলেছে বাঘটি। আর এভাবেই শুরু সুন্দরবনের ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ংকরতম মানুষখেকোগুলোর অন্যতম ‘আঠারবেকীর বাঘ’-এর রাজত্ব।
আঠারবেকীর সীমানার মধ্যে একের পর এক জেলে আর বাওয়ালি যেতে লাগল বাঘের পেটে। ওই বাঘ এমনই আতঙ্ক সৃষ্টি করল যে, অনেক বাওয়ালি গোলপাতা কাটাই বন্ধ করে দিল। জেলেরা বন্ধ করে দিল মাছ ধরা। বন বিভাগের কয়েকজন কর্মকর্তা-শিকারি বাঘের পিছু লাগলেন। তাঁদের মধ্যে আছেন সুন্দরবনের বিখ্যাত মানুষখেকো বাঘ শিকারি পচাব্দী গাজীও। কিন্তু কোনোভাবেই বাঘের নাগাল আর পান না তাঁরা। তবে বেশ কয়েকবার ওটার পায়ের ছাপ দেখলেন পচাব্দী। বলতে গেলে, তাঁদের নাকের ডগা দিয়েই একের পর এক মানুষ নিয়ে যেতে লাগল বাঘটা। দেখতে দেখতে মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল ২৩-এ। শেষ শিকারটাও ছিল একজন বাওয়ালি। আঠারবেকী খালের কাছে গোলপাতা কাটার সময় তাকে ধরে নিয়ে যায় বাঘ। মানুষখেকোটার পায়ের ছাপ আর রক্তের চিহ্ন অনুসরণ করে বেশ কিছুদূর এগোতেই বনের মধ্যে লোকটার লাশ খুঁজে পেলেন পচাব্দী গাজী। মড়ির বেশ কিছুটা খাওয়া তখনও বাকি। অর্থাৎ আবার আসবে বাঘ। অনেক বলে-কয়ে নিহতের আত্মীয়স্বজনকে লাশটা সন্ধ্যা পর্যন্ত সেখানে রাখতে রাজি করালেন। বাওয়ালিদের একজনও তাঁর সঙ্গে থাকতে রাজি হলো।
তখন বিকেল ৩টা। শিকারির আশা, সন্ধার আগেই বাঘটা পদধূলি দেবে। তবে সমস্যা হলো, আশপাশে ৬০-৭০ গজের মধ্যে বসার মতো বড় কোনো গাছ নেই। উপায়ান্তর না দেখে দারুণ একটা ঝুঁকি নিয়ে ফেললেন পচাকী। খালের ঢালের মধ্যে শুয়ে পড়লেন সঙ্গীসহ। শুধু মাথা রইল ওপরে, শরীরের বাকি অংশ ঢালে। বাওয়ালি শুয়ে পড়ল তাঁর বামে। সামনের দিক থেকে কোনো বিপদ এলে সতর্ক করে দিতে পারবে সে। বেশ কিছুটা সময় পার হওয়ার পর পূর্ব দিক থেকে ভয়ার্ত স্বরে ডেকে উঠল একটি বানর। মিনিট দশেক পরেই এল বাঘটা। সরাসরি ওটার ঘাড়ে গুলি করলেন পচাব্দী গাজী। গুলি খেয়ে পড়ে গেল বাঘটা। একটু অপেক্ষা করার পর নিশ্চিত হওয়ার জন্য আরো একবার গুলি করলেন_এবার বুকে। আর কোনো মানুষ মারবে না আঠারবেকীর ভয়ংকর ওই বাঘ।(ফটোগুলো বই হতে নেওয়া)।