
সিরাজুল ইসলাম শ্যামনগর: পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর প্লাস্টিকজাত পণ্য বা পলিথিন ব্যাগ শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বজুড়েই মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রবা ফটো
বর্তমানে বিশ্বজুড়ে পরিবেশ দূষণের প্রধান কারণ প্লাস্টিক ও প্লাস্টিকজাত পণ্য। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। দেশের নদ-নদী, খাল-বিল, রাস্তার ধারসহ সর্বত্রই প্লাস্টিকের উপস্থিতি চোখে পড়ে। প্লাস্টিক পণ্য নিয়ন্ত্রণে আইন থাকলেও প্রশাসন ও সাধারণ মানুষের অসচেতনতায় তা বাস্তবায়িত হয় না। প্রয়োজনীয় হলেও আমাদের জীবনের জন্য অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে যেন এই প্লাস্টিক
প্লাস্টিক নিত্যব্যবহার্য পণ্য। ‘প্রায় অপচনশীল’ এই প্লাস্টিক পণ্যের যথেচ্ছ ব্যবহারের ফলে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য হুমকির সম্মুখীন। প্লাস্টিকের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা তথা মাইক্রোপ্লাস্টিক জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। পলিথিনও একপ্রকার প্লাস্টিক পণ্য। সর্বত্রই পলিথিন ব্যাগের ছড়াছড়ি। পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর প্লাস্টিকজাত পণ্য বা পলিথিন ব্যাগ শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বজুড়েই মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিবেশের শত্রু পলিথিন প্রতিনিয়ত ক্ষতি করে চলেছে। খাবারের প্যাকেট বা মোড়ক হিসেবে প্লাস্টিকের জয়জয়কার। নিত্যপ্রয়োজনীয় বেশিরভাগ পণ্য এখন প্লাস্টিকের আবরণে বন্দি। পানি খাওয়ার জন্য মানুষ এখন ঝকঝকে ও আকর্ষণীয় প্লাস্টিকের বোতলের দিকে ঝুঁকছে। এমন কোনো দ্রব্য নেই যেটা প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি হচ্ছে না! প্লাস্টিকের উৎপাদন এবং গণহারে ব্যবহারের ইতিহাস খুব বেশি দিনের নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে প্লাস্টিকের উৎপাদন ও ব্যবহার ব্যাপকভাবে বাড়তে শুরু করে। বর্তমান বাস্তবতায় প্লাস্টিক ছাড়া বিশ্ব কল্পনা করা যেন অসম্ভব!
পলিথিন ব্যাগ পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকিÑ এ কথা আমরা কমবেশি সবাই জানি। এটি দেশে নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও প্রকাশ্যে এর ব্যবহার চলছেই। হাত বাড়ালেই পাওয়া যাচ্ছে পলিথিন ব্যাগ এবং এটি সহজে বহনযোগ্যও বটে। প্রশ্ন হলোÑ নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যাগ প্রকাশ্যে বিস্তারের দায় কার? বাজারের দোকানদার বা বিক্রেতা সহজেই ক্রেতার নিত্যপণ্য পলিথিনে ভরে দিচ্ছেন। ফলে খোলাখুলিভাবে চলছে পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার। পলিথিন ব্যাগ শহরের জলাবদ্ধতা, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা ও কৃষিজমিতে মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। কাগজের ঠোঙা, কাপড়ের ব্যাগ কিংবা পাটের ব্যাগ সহজপ্রাপ্য ও কম দাম না হওয়ায় ক্রেতা এবং বিক্রেতা উভয়ই পরিবেশবান্ধব এসব ব্যাগ ব্যবহারে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন।
তথ্যমতে, প্রতি বছর বিশ্বে ৫ লাখ কোটি টন পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করা হচ্ছে। এর মাত্র ১ শতাংশই পুনর্ব্যবহারের জন্য রিসাইক্লিং করা হয়। ‘পবার’ (পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন) তথ্যমতে, ঢাকায় প্রতিদিন প্রায় ২ কোটি পলিথিন ব্যাগ জমা হচ্ছে, যেগুলো একবার ব্যবহার করেই ফেলে দেওয়া হচ্ছে। ২০০২ সালে আইন করে সারা দেশে সব ধরনের পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন, আমদানি, বাজারজাতকরণ, বিক্রয়, বিক্রয়ের জন্য প্রদর্শন, মজুদ, বিতরণ, বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পরিবহন ও ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয় (তবে রেণু পোনা পরিবহন ও পণ্যের মোড়ক হিসেবে একটু মোটা প্লাস্টিকের মোড়ক বৈধ)। আইন থাকলেও ক্রেতা-বিক্রেতা কারোরই ভ্রুক্ষেপ নেই।
শিশুরা অল্প বয়স থেকে প্লাস্টিকের খেলনাসামগ্রীর সংস্পর্শে আসে। অভ্যাসবশত শিশুরা এসব খেলনা মুখে দেয়! প্লাস্টিকের খেলনায় বিসফেনোল (প্লাস্টিক শক্ত করতে ব্যবহার হয়) ও ফথালেটস (প্লাস্টিক নরম করতে ব্যবহৃত হয়) নামক এক ধরনের রাসায়নিক থাকে। প্লাস্টিকের ফিডিং বোতলেও ক্ষতিকর রাসায়নিক থাকে। শিশুদের দেহ সংবেদনশীল হওয়ায় এগুলো সহজেই গ্রহণ করে ফেলে। প্লাস্টিকের থালাবাসন ও চামচ থেকে শিশুদের দূরে রাখা উত্তম। প্লাস্টিকের বর্জ্যে ধুঁকছে পথশিশুও।
সাগর-মহাসাগরগুলো প্রাণিকুল রক্ষার মূল উপাদান অক্সিজেন যেমন উৎপাদন করে থাকে; তেমনি ব্যাপকমাত্রায় কার্বন শোষণ করে থাকে। সমুদ্র পৃথিবীর জলবায়ুকে সহনীয় করে রাখে। পানিচক্র, কার্বনচক্র ও নাইট্রোজেনচক্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে এই সমুদ্র। বিজ্ঞানীদের গবেষণার তথ্য বলছে, সমুদ্র বৈশ্বিক উষ্ণতার ৯০ ভাগ শোষণ করে থাকে। সে হিসেবে জলবায়ু সমস্যা মোকাবিলায় মহাওষুধের মতো কাজ করে সমুদ্র। পৃথিবী নামক শরীরের রক্তপ্রবাহ বলা হয় সমুদ্রকে। রক্তপ্রবাহে কোনো প্রকার দূষণ দেখা দিলে শরীর টিকিয়ে রাখা যেমন দুষ্কর হয়ে পড়ে; তেমনি সমুদ্রে দূষণ দেখা দিলে পৃথিবীর সমস্যা অনিবার্য।
দূষণ যদি মাত্রাতিরিক্ত হয়ে যায় তখন সমুদ্র তার ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। জাতিসংঘের একটি সমীক্ষা বলছে, প্রতি বছর ৫০ লাখ থেকে দেড় কোটি টন প্লাস্টিক বর্জ্য সমুদ্রে গিয়ে পড়ছে। তথ্য বলছে, সমুদ্রের মোট দূষণের ৩০ শতাংশ হয়ে থাকে প্লাস্টিকের কারণে। আইইউসিএনের (প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণ সংস্থা) সমীক্ষা জানাচ্ছে, গাড়ির টায়ার ও বিভিন্ন টেক্সটাইল কারখানা থেকে নিঃসৃত প্লাস্টিকের বর্জ্য সমুদ্র দূষণের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নদীবাহিত প্লাস্টিক দ্বারা সমুদ্রের দূষণ হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশের নদ-নদী দ্বারা সমুদ্রে প্লাস্টিক দূষণ হচ্ছে।
ওয়ান টাইম প্লাস্টিকের ব্যবহার অস্বাভাবিক গতিতে বেড়েই চলেছে। যেসব প্লাস্টিক পণ্য একবার ব্যবহার শেষে আর কোনো কাজে লাগে না বা ফেলে দেওয়া হয়; সেগুলোই ওয়ান টাইম প্লাস্টিক হিসেবে পরিচিত। বহু ধরনের ওয়ান টাইম প্লাস্টিক পণ্য এখন হাতের নাগালে। এসবের মধ্যে রয়েছে কাপ, চামচ, স্ট্র, প্লেট, গ্লাসসহ অনেক ধরনের প্লাস্টিক পণ্য। রেস্টুরেন্ট, আবাসিক হোটেল, এয়ারলাইনস, সুপারশপ, চায়ের দোকান ও বিশেষ অনুষ্ঠান আয়োজনের মতো জায়গা থেকে এসব ওয়ান টাইম প্লাস্টিক পণ্য বেশি আসছে। প্লাস্টিক ব্যবহারের পর ফেলে দেওয়া প্লাস্টিক পণ্য যুগের পর যুগ পরিবেশে থেকে যায়। চায়ের দোকানগুলোতে এখন ওয়ান টাইম প্লাস্টিক কাপের ছড়াছড়ি। ওয়ান টাইম প্লাস্টিকের ক্ষতিকর প্রভাব না জেনেই হরহামেশা সাধারণ লোকজন প্লাস্টিকের কাপে চা পান করছেন। গবেষণার তথ্যমতে, প্লাস্টিকের কাপে থাকা টক্সিন পদার্থ মুখ ও লিভারের ক্যানসারের অন্যতম কারণ। এই ক্ষতিকর পদার্থ গরম পানির সঙ্গে সহজেই মিশে যায়।
‘ইএসডিও’-এর এক জরিপ প্রতিবেদন মতে, বাংলাদেশে বছরে ওয়ান টাইম প্লাস্টিক বর্জ্যের পরিমাণ ৮৬ হাজার ৭০৭ টন। শহর এলাকায় ওয়ান টাইম প্লাস্টিক বর্জ্যের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। এটি বছরের পর বছর পরিবেশে টিকে থেকে জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের ক্ষতি করে চলেছে।
মাইক্রোপ্লাস্টিক যেন বিষের আরেক নাম। প্লাস্টিকের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা তথা মাইক্রোপ্লাস্টিক পরিবেশের ক্ষতি করছে সবচেয়ে বেশি। যেসব প্লাস্টিকের আকার সাধারণত ২ মাইক্রোমিটার থেকে ৫ মিলিমিটারের মধ্যে, সেই সব প্লাস্টিক হলো মাইক্রোপ্লাস্টিক। চাইলেই মানুষ প্লাস্টিকের এই ক্ষুদ্রকণা এড়িয়ে চলতে পারে না। সমুদ্রের মাছ খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করছে মাইক্রোপ্লাস্টিক। মাইক্রোপ্লাস্টিকের কারণে জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি হচ্ছে। সুন্দরবনেও এখন মাইক্রোপ্লাটিকের উপস্থিতি মিলেছে। প্লাস্টিক দূষণ সুন্দরবনের বন্যপ্রাণী ও বনের গাছপালার ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। পথশিশুদের একটি অংশ মাইক্রোপ্লাস্টিক বর্জ্যের রাসায়নিকের প্রভাবে চর্মরোগ ও শ্বাসকষ্টে ভুগছে।
আসবাব তৈরি, গৃহস্থালি ও বাণিজ্যিকভাবে প্লাস্টিকের ব্যবহার দিন দিন বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ১২তম প্লাস্টিক পণ্য রপ্তানিকারক দেশ। এ শিল্পের সঙ্গে লাখ লাখ কর্মসংস্থান জড়িত। প্লাস্টিক শিল্প অন্যতম বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী শিল্প। প্লাস্টিকের ব্যবহার কমানো সম্ভব, তবে একবারে বন্ধ করা হয়তো সম্ভব নয়! তবে প্লাস্টিকের মতো সম্ভাবনাময় ও উৎপাদনশীল শিল্পকে রিসাইক্লিং দ্বারা এর দূষণ রোধ করা যেতে পারে। যেসব দেশে প্লাস্টিকের রিসাইক্লিং প্রক্রিয়া উন্নত, সেসব দেশে দূষণ কম। পৃথিবীর উন্নত দেশে প্লাস্টিকের দূষণ কম। যেসব কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠান কোমল পানীয় বা পানির বোতল ও অন্য যেসব প্লাস্টিক পণ্য বিক্রয় করে থাকে, সেই সব পণ্য ব্যবহার শেষে আবার ফিরিয়ে নেওয়ার (সামান্য মূল্যের বিনিময়ে) ব্যবস্থা রাখতে পারে। এতে করে প্লাস্টিক পণ্য রাস্তাঘাটে বা চারপাশে যেমন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকবে না, দূষণও হ্রাস পাবে।
পরিবেশদূষণ কমাতে প্লাস্টিকের খালি বোতল ফিরিয়ে নিতে ২০১৯ সালে প্লাস্টিক কোম্পানিগুলোর প্রতি আহ্বান জানান ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম। নেদারল্যান্ডসভিত্তিক কর্ডএইডের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ ও ক্রয় করার উদ্যোগ নিয়েছিল নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন (নাসিক)। অতি সম্প্রতি ডেঙ্গু সমস্যা মোকাবিলায় অব্যবহৃত প্রতি কেজি পলিথিনের জন্য ৫০ টাকা এবং ডিসপোজেবল কাপ, প্লাস্টিক, মেলামাইন বা সিরামিকের প্রতিটি পাত্রের জন্য নির্দিষ্ট অর্থ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। কিন্তু সমন্বিত ও পরিকল্পিতভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় কোনো উদ্যোগই সফল হচ্ছে না!
অপ্রয়োজনীয় প্লাস্টিকের ব্যবহার যত কমবে, পৃথিবী তত নিরাপদ হবে। বাংলাদেশে প্লাস্টিকের উৎপাদন ও ব্যবহারের নীতিমালা নেই। প্লাস্টিকের বহুবিধ ব্যবহার দূষণকে ত্বরান্বিত করছে। যে জিনিস আগে প্লাস্টিক দ্বারা তৈরি কল্পনা করা যেত না, এখন সেটি অনায়াসেই তৈরি হচ্ছে। তথ্য বলছে, প্লাস্টিকের বহুমুখী ব্যবহার ও উৎপাদন আগামীতে বাড়বে। বলা যায়, প্লাস্টিক দূষণের মাত্রাও বাড়বে। তাই প্লাস্টিক নিষিদ্ধ করার বিষয়ে এখনই চিন্তা করা দরকার। পরিবেশবান্ধব পদক্ষেপ ও জনগণের মধ্যে সচেতনতাই পারে পলিথিন এবং প্লাস্টিক দূষণের হাত থেকে রেহাই দিতে।

