# বজ্রপাত বেড়েছে ১৫ শতাংশ
# প্রতি বছর গড়ে ৩০০ জনের মৃত্যু
ইয়াসীন আরাফাত রুমী
বজ্রপাত এখন প্রাকৃতিক দুর্যোগে পরিণত হয়েছে। প্রতিবছর দেশে বাড়ছে বজ্রঘাতে মৃত্যুর সংখ্যা। বায়ুমÐলের আর্দ্রতা বৃদ্ধি এবং পৃথিবীর উষ্ণতা বেড়ে যাওয়ায় বাড়ছে বজ্রপাত। মৃত্যুর সংখ্যার কারণে ২০১৫ সালের ১৭মে বজ্রপাতকে ‘দুর্যোগ’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
সূত্র জানায়, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিরূপ প্রকৃতি, উষ্ণতা বৃদ্ধি, উঁচু বৃক্ষ নিধনসহ বিবিধ কারণে প্রতি বছর বাড়ছে বজ্রপাত। বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যাও। সাধারণত এপ্রিল থেকে মে-জুন পর্যন্ত বজ্রপাতের মৌসুম। তবে এখন দেখা যায়, সেপ্টেম্বর-অক্টোবর পর্যন্ত বজ্রপাতে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। শুধুমাত্র গত বৃহস্পতিবারই শিশুসহ ১৪জন মারা গেছেন বজ্রঘাতে। এরমধ্যে সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় ১০ জন, ফরিদপুরে ২ জন ও শেরপুরে ২ জনের মৃত্যু হয়েছে।
জানা গেছে, সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় মাটিকোড়া গ্রামের মাঠে বীজতলা থেকে ধানের চারা তুলছিলেন ১৫-২০ জন কৃষি শ্রমিক। এসময় বৃষ্টি ও বজ্রপাত শুরু হলে তারা সবাই মাঠের একটি স্যালোমেশিনের ঘরে আশ্রয় নেন। সেখানে বজ্রপাত হলে ঘটনাস্থলেই ৬ জন মারা যান। আহত ৮ জনকে হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসাধিন অবস্থায় আরও ৪ জন মারা যায়। এর আগে গত মঙ্গলবার দেশে ৭ জনের মৃত্যু হয়।
বজ্রপাত নিয়ে কাজ করে এমন সংস্থা ও বিশেষজ্ঞদের তথ্য বলছে, সা¤প্রতিক বছরগুলোতে দেশে বজ্রপাত বেড়েছে ১৫ শতাংশ। পৃথিবীতে বজ্রপাতে যত মানুষ মারা যায়, তার এক-চতুর্থাংশই বাংলাদেশে। হাওর, বাঁওড় ও বিল এলাকার জেলাগুলোয় বজ্রপাতে মৃত্যু বেশি। বজ্রপাতে একটি মৃত্যুর সঙ্গে অন্তত ১০ জন আহত হয়ে থাকে বলে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। আহতরা স্থায়ীভাবে প্রতিবন্ধী হয়ে যায়।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় এবং বেসরকারি সংগঠন ‘ডিজাস্টার ফোরাম’-এর তথ্যমতে, ১৯৮৮ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বজ্রপাতে ৬ হাজার ৭৪২ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর ২০১১ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ১২ বছরে বজ্রাঘাতে মৃত্যু হয়েছে ৩ হাজার ১৬২ জনের। এর মধ্যে ২০১১ সালে ১৭৯ জন, ২০১২ সালে ২০১ জন, ২০১৩ সালে ১৮৫ জন, ২০১৪ সালে ১৭০ জন, ২০১৫ সালে ১৬০ জন, ২০১৬ সালে ২০৫ জন, ২০১৭ সালে ৩০১ জন, ২০১৮ সালে ৩৫৯ জন, ২০১৯ সালে ১৬৮ জন, ২০২০ সালে ২৩৬ জন এবং ২০২১ সালে ৩৬২ জন মারা গেছেন বজ্রাঘাতে। এই হিসাব অনুযায়ী, বছরে গড়ে ২৬৩ দশমিক ৫ জনের মৃত্যু হয় এই দুর্যোগে।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে প্রতি বছর গড়ে বজ্রপাতে ৩০০ জনের মৃত্যু হচ্ছে। বজ্রাঘাতে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের প্রায় ৭০ শতাংশই কৃষক, এছাড়া সাড়ে ১৪ শতাংশ বাড়ি ফেরার পথে এবং গোসল কিংবা মাছ শিকারের সময় ১৩ শতাংশের মৃত্যু হয়েছে। তবে শহরের ভবনগুলোতে বজ্রপাত প্রতিরোধক দÐ থাকায় হতাহতের সংখ্যা কম।
বুয়েটের তড়িৎ ও ইলেকট্রিক্যাল কৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. শহীদুল ইসলাম খান বলেন, একেকটি বজ্রপাতের সময় প্রায় ৬০০ মেগা ভোল্ট বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়। একজন মানুষের মৃত্যুর জন্য মাত্র ১০০ ভোল্ট বিদ্যুতই যথেষ্ট। তিনি আরও বলেন, বজ্রপাতের ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনতে, মানুষের প্রাণ বাঁচাতে এবং এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে পাঠ্যবইয়ে এর কারণ এবং রক্ষা পেতে করণীয় বিষয়ে পাঠদান জরুরি।
জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ড. এ কে এম সাইফুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশে প্রতি বর্গকিলোমিটারে অন্তত ৪০টি বজ্রপাত হয় বলে আন্তর্জাতিক গবেষণায় উঠে এসেছে। বিশ্বে বজ্রপাতে যত মানুষ মারা যায়, তার এক-চতুর্থাংশই বাংলাদেশে। প্রযুক্তির ব্যবহার করে বজ্রপাতে মৃত্যু নিয়ন্ত্রণে আনা যেতে পারে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রযুক্তির ব্যবহার হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগবিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল বলেন, বিশ্বে বজ্রপাতে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু বাংলাদেশে। আর্লি ওয়ার্নিং সিস্টেম (প্রাক-সতর্কীকরণ ব্যবস্থা) ও লাইটেনিং অ্যারেস্টর (বজ্রপাত নিরোধক) স্থাপনের মাধ্যমে মানুষকে রক্ষার পদক্ষেপ নেওয়া যায়। কাজটি সরকারকেই করতে হবে। বেশি দরকার সচেতনতা। ওড়িশায় আর্লি ওয়ার্নিং সিস্টেম বেশ কাজে লেগেছে বলে জানান তিনি।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি বাড়লে বজ্রপাতের আশঙ্কা বেড়ে যায় ১২ শতাংশ। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ও নেপালে বজ্রপাতের হার বেশি।
বিশ্বে বজ্রপাতে মৃত্যুর এক-চতুর্থাংশই বাংলাদেশে
Leave a comment