
সিরাজুল ইসলাম, শ্যামনগর: টানা বৃষ্টি, নদী-খালের অপরিকল্পিত খনন ও দখলের কারণে ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে সাতক্ষীরা পৌর এলাকার জলাবদ্ধতা। ঘরবাড়ি, রান্নাঘর, টয়লেটÑসবই পানিতে ডুবে যাচ্ছে। দূষিত পানি ও স্যানিটেশন সমস্যায় ইতোমধ্যেই ছড়িয়ে পড়েছে পানিবাহিত রোগ। অনেকে এলাকা ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
বৃহস্পতিবার রাত থেকে শুরু হওয়া হালকা ও মাঝারি ধরনের বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে শহর ও শহরতলীর নি¤œাঞ্চল।শহরের কুখরালি এলাকার বাসিন্দা তৌহিদুর রহমান জানিয়েছেন, “সরকার যায় সরকার আসে কিন্তু দুর্ভোগ কাটে না কুখরালিবাসির। একটি ড্রেন বদলে দিতে পারে অত্র এলাকার পরিবেশ।
তিনি প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করে বলেন, “সাতক্ষীরা পৌরসভার ৬নং ওয়ার্ডের কুখরালী উত্তরপাড়ার রাস্তাটি প্রায় ১মাস যাবৎ ১০০পরিবারের ৫০০ শতাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে আছেন। শহরের ইটাগাছা, গড়েরকান্দা, কুখরালী ও বাঁকাল বারুইপাড়া এলাকার পানি আসে যে বিলে, সেই বিলের পানি বেরোনোর পথ বন্ধ করে রেখেছে স্থানীয় প্রভাবশালীরা। বিগত পাঁচ বছর ধরে চলছে এই অবস্থা।
তিনি আরও জানান, বছরের চার থেকে পাঁচ মাস ওই এলাকায় হাঁটু পানি জমে থাকে। দীর্ঘ দিন পানি আটকে থাকায় চলাচলের রাস্তাটি গেছে নষ্ট হয়ে গেছে। পঁচা পানির কারণে দেখা দিয়েছে চর্মরোগ। স্থায়ী জলাবদ্ধতায় রূপ নিয়েছে এলাকাটি। গোসল, পায়খানা, খাওয়ার পানি সংগ্রহে খুব কষ্ট হচ্ছে মানুষের। এ অবস্থায় শিশুরাও ঠিকমত স্কুলে যেতে পারছে না পঁচাপানি ও সাপের ভয়ে।
পুরাতন সাতক্ষীরা ডাঙিপাড়া এলাকার সাইফুল ইসলাম জানান, সাতক্ষীরা-আশাশুনি সড়কের পূর্বপাশে রামচন্দ্রপুর বিলের পানি উঠেছে উঠোনে। সেখানে অন্তত অর্ধশতাধিক বাড়ি-ঘরে ও উঠোনে পানি থৈ থৈ করছে। নারী ও শিশুরা রয়েছে চরম ঝুঁকিতে।
এদিকে শহরের রসুলপুর এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, পুলিশলাইন সড়কটি পানিতে ডুবে গেছে। ডুবে গেছে এ এলাকার অরি-গলি। টার্মিনাল এলাকার অনেক রাস্তা পানির নিচে। এছাড়া পলাশপোল এলাকার বেশ কয়েকটি নি¤œ এলাকায় জমেছে পানি। ফলে দেখা দিয়েছে জলাবদ্ধতা। বিষয়টি নিয়ে চরম উদ্বেগের মধ্যে রয়েছে সেখানকার বাসিন্দারা। এদিকে শহরের কামালনগর ও ইটাগাছা এলাকায়ও একই চিত্র দেখা গেছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে খনন করা নদী ও খালগুলোতে রয়েছে ব্যাপক অনিয়ম। প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ছিল পানি নিষ্কাশনের পথ সচল রাখা। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছেÑ তলদেশ না কেটে পাড় উঁচু করে কৃত্রিম গভীরতা দেখানো হয়েছে, খালের প্রশস্ততা কমানো হয়েছে। যার ফলে বর্ষার পানি নদীতে না গিয়ে দীর্ঘদিন ধরে লোকালয়ে জমে থাকছে। এমনকি নদীর পানিও মাঝে মাঝে লোকালয়ে ঢুকে পড়ছে।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, সাতক্ষীরা পৌরসভার কামালনগর, ইটাগাছা, মেহেদীবাগ, রসুলপুর, বদ্দীপুর কলোনি, রইচপুর, মধ্য কাটিয়া, রথখোলা, রাজার বাগান, মুনজিতপুর, গদাইবিল ও পুরাতন সাতক্ষীরার নি¤œ এলাকাগুলোতে ভয়াবহ জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে।
সাতক্ষীরা আবহাওয়া অফিসের উচ্চমান সহকারী জুলফিকার আলী রিপন জানান, বৃহস্পতিবার (৩ জুলাই) সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত সাতক্ষীরায় ১৩ মি. মি বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। এরপর শুক্রবার (৪ জুলাই) সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত সাতক্ষীরায় ১২১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। শনিবারও আবহাওয়া অপরিবর্তীত থাকবে।
এদিকে জলাবদ্ধতা নিরসনে স্থানীয়রা জোর দাবি জানিয়ে বলেনÑ “সবার আগে প্রভাবশালীদের কবল থেকে পানি নিষ্কাশনের পথ জনস্বার্থে উন্মুক্ত করতে হবে। নদী-খাল খননে প্রকৃত গভীরতা বজায় রেখে এবং আদি ম্যাপ অনুযায়ি সঠিকভাবে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে।
সরকারি খাল ও জলমহাল থেকে অবৈধ দখল, নেট-পাটা উচ্ছেদ করতে হবে। ইজারা বাতিল ও পরিবেশবান্ধব জলব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে। স্থায়ী ড্রেনেজ নেটওয়ার্কের আওতায় আনতে পৌর শহরকে পরিকল্পিতভাবে “জোনিং” ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করতে হবে।
অপরিকল্পিত ঘের নিষিদ্ধ ও বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। অকেজো স্লুইস গেট সংস্কার ও ত্রুটিপূর্ণ বাঁধ মেরামত করতে হবে।”
এব্যাপারে সাতক্ষীরা সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শোয়াইব আহমাদ বলেন, “জলাবদ্ধতা নিরসনে আমরা ঘের মালিকসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে একাধিকবার আলোচনা করেছি। আশা করছি দ্রুত সময়ের মধ্যে পরিস্থিতি কিছুটা উন্নত হবে।”
সাতক্ষীরা শহরের দীর্ঘস্থায়ী জলাবদ্ধতা আজ শুধু একটি পরিবেশগত সমস্যা নয়Ñএটি একটি মানবিক সংকটে রূপ নিচ্ছে। এখনই যদি কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তাহলে আগামীতে এই শহরে বসবাস করাই অসম্ভব হয়ে পড়বে।