জন্মভূমি ডেস্ক : মহানগরে ইজিবাইক, সিএনজি ও থ্রিহুইলার চালকরা চাঁদার চাপে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ৯টি পয়েন্টে সিএনজি ও থ্রিহুইলার এবং ৫টি পয়েন্টে ইজিবাইক চালকদের চাঁদা দিতে হয়। মাসে প্রায় অর্ধকোটি টাকার চাঁদাবাজি হচ্ছে। শ্রমিক ইউনিয়নের ছত্রছায়ায় নগর জাতীয় শ্রমিক লীগের প্রভাবশালী তিন নেতা এই চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করছেন। তাদের নিয়োগ দেয়া স্ট্যাটারনামধারীরাই চাঁদার এ অর্থ সংগ্রহ করেন। চাঁদা না দিলে হুমকি ও মারধরের ঘটনাও ঘটছে।
ভুক্তভোগী চালকরা জানান, নগরের রূপসা ঘাট থেকে ফুলতলা বাজার পর্যন্ত ৩২ কিলোমিটার সড়কের ৯টি পয়েন্টে প্রতিদিন থ্রিহুইলার ও সিএনজি চালকপ্রতি ৭০ থেকে ৮০ টাকা এবং মাসে ১০০ টাকা হারে চাঁদা দিতে হয়। আগে রূপসা থেকে ফুলতলা রুটে ১০ মিনিট অন্তর নগর পরিবহন সেবা চালু ছিল। কিন্তু ২০১৮ সালে নগর পরিবহন সেবা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তিন চাকার এই যানগুলোই একমাত্র ভরসা নগরবাসীর।
বিআরটিএর তথ্য বলছে, নগরে নিবন্ধিত থ্রিহুইলার ও অটোরিকশার সংখ্যা ২ হাজার ৫৯০টি। এর মধ্যে সাতটি ছাড়া বাকিগুলো ফিটনেস ও নিবন্ধন নবায়ন করা। অর্থাৎ সব গাড়িই সড়কে চলাচল করছে। এছাড়া বিআরটিএ বা সিটি করপোরেশন কারও কাছেই নিবন্ধনহীন সিএনজি, থ্রিহুইলার এবং ইজিবাইকের কোনো সঠিক হিসাব নেই। আর শ্রমিক ইউনিয়নগুলোর তথ্য অনুযায়ী, সড়কে মাত্র ১ হাজার ৬০০ থ্রিহুইলার ও অটোরিকশা চলাচল করে।
সরেজমিন দেখা গেছে, নগরের ডাকবাংলো মোড় ও দৌলতপুর স্ট্যান্ডকেন্দ্রিক দুটি শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা চাঁদার বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করেন। তাদের নির্ধারিত ব্যক্তিরাই ৯টি মোড়ে প্রকাশ্যেই চাঁদা তোলেন। ফুলতলা বাজার, শিরোমনি বাজার, ফুলবাড়িগেট স্ট্যান্ড, রেলগেট, দৌলতপুর, নতুন রাস্তা মোড়, পাওয়ার হাউস মোড়, ডাকবাংলো স্ট্যান্ড এবং রূপসা ঘাটে টাকা দেয়া বাধ্যতামূলক। এর বাইরে ইস্টার্ন গেট ও পিটিআই মোড়েও মাঝে মধ্যে চাঁদা নেয়ার অভিযোগ আছে। এর মধ্যে ফুলতলায় ১০ টাকা, শিরোমনি ১০ টাকা, নতুন রাস্তা মোড় ১০ টাকা, ডাকবাংলো ১০ টাকাসহ প্রত্যেক চালককে সবমিলে ৭০ থেকে ৮০ টাকা চাঁদা দিতে হয়। প্রতিদিন এই ৯টি পয়েন্টে এ অর্থ আদায় করা হয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মাসে আদায় করা হয় প্রায় ৩৭ লাখ ৬০ হাজার টাকা। তিনটি শ্রমিক ইউনিয়নের মাধ্যমে এ চাঁদাবাজির টাকা ভাগবাটোয়ারা করা হয়। ডাকবাংলো মোড়ে খুলনা জেলা বেবি ট্যাক্সি শ্রমিক ইউনিয়নের কার্যালয় অবস্থিত। সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন সোনা জাতীয় শ্রমিক লীগ নগর কমিটির সহসভাপতি। তার সংগঠনের আওতায় গাড়ি চলে ১৮০ থেকে ২০০টি। তবে চালকরা জানান, এই ইউনিয়নে চালক সংখ্যা প্রায় ৪০০।
চালকদের সবচেয়ে বড় সংগঠন দৌলতপুর-খুলনা বেবি টেক্সি সিএনজিচালিত অটোরিকশা থ্রিহুইলার ড্রাইভার্স ইউনিয়ন। সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক জহিরুল ইসলাম পান্নু খানজাহান আলী শ্রমিক লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি। এই সংগঠনের আওতায় চলে প্রায় ১ হাজার ২০০ গাড়ি। অন্যটি খুলনা নগর ইজিবাইক শ্রমিক লীগ। দুই শ্রমিক ইউনিয়নের হয়ে চাঁদা আদায়ে ৩০ থেকে ৩৫ জনের মতো স্ট্যাটার রয়েছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ১ হাজার ৬০০ গাড়িতে দৈনিক গড়ে ৭৫ টাকা হিসাবে মাসে আদায় ৩৬ লাখ টাকা। এছাড়া মাসের শুরুতে এককালীন ১০০ টাকা হিসেবে আদায় করা হয় ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা। এই টাকাও ভাগ করে নেন ইউনিয়নের নেতারা। তবে এই টাকা আদায় করা হয় গাড়ির মালিকের কাছ থেকে। মাসের শুরুতে এই টাকা ইউনিয়নে পৌঁছে দিতে হয় মালিককেই। এছাড়া নতুন কোনো গাড়ি নিবন্ধন করাতে হলে ইউনিয়নে ২ থেকে ৫ হাজার পর্যন্ত টাকা দিতে হয়।
অবশ্য খুলনা জেলা বেবি ট্যাক্সি শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন সোনা দাবি করেন, শ্রম অধিদপ্তরের অনুমোদন নিয়ে প্রতিদিন গাড়ি থেকে ১০ টাকা আদায় করা হয়। আর তা দিয়ে অফিস ভাড়া, কর্মচারীদের বেতন, অন্য খরচ হয়। বাকি যে টাকা থাকে তা বিভিন্ন সময়ে শ্রমিকদের মৃত্যু ভাতা, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচ দেয়া হয়। বিভিন্ন পয়েন্টে যে টাকা আদায় হয়, তা স্ট্যাটাররা ভাগ করে নেন। ওই টাকা ইউনিয়নে আসে না।
দৌলতপুর ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক জহিরুল ইসলাম পান্নু বলেন, একজন শ্রমিক মৃত্যুকালীন ভাতা পান ১০ হাজার টাকা। এর বাইরে অসুস্থ হলে, দুর্ঘটনা ঘটলে, বিভিন্ন সময় অনুদান দেয়া হয়। তাছাড়া প্রতিদিন ৩০০ জনের বেশি চাঁদার টাকা দেয় না। আদায় হয় মাত্র ৩ হাজার টাকা। এই টাকা দিয়ে কী হয়? প্রতিদিন অফিস খুললে ৫ হাজার টাকা খরচ।
অন্যদিকে নগরে ইজিবাইকের সঠিক হিসাব না থাকলেও সিটি করপোরেশন এলাকায় ১০ হাজারের বেশি ইজিবাইক চলে বলে জানা যায়। নগর ইজিবাইক শ্রমিক লীগের দুই নেতার ছত্রছায়ায় বিক্ষিপ্তভাবে স্ট্যাটারের মাধ্যমে এসব ইজিবাইক চালকদের কাছ থেকে চাঁদা তোলা হয়। অন্তত ১০ জন চালকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ফুলতলা বাজার, শিরোমনি, মহাসীন মোড়, বয়রা বাজার, খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে, গল্লামারী ও ময়লাপোতায় ইজিবাইক থেকে চাঁদা তোলা হয়। মুজগুন্নী মহাসড়ক, গল্লামারী ও নতুন রাস্তা মোড়ের দুই মাথায় সিরিয়াল দেয়ার নাম করে স্ট্যাটারদের ১০ টাকা করে ২০ টাকা দিতে হয়। এছাড়া খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে রোগী নামালে বা ওঠালেও ১০ টাকা চাদা নেয় স্টাটারনামধারীরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র আরও জানায়, প্রতিদিন অন্তত তিন হাজার ইজিবাইক থেকে ৩০ টাকা হারে চাঁদা তোলা হয়। আর ইজিবাইক নিবন্ধনের নামে টাকা আদায়ে নৈরাজ্য তো রয়েছেই।
কেএমপির উপ-কমিশনার (ট্রাফিক) মনিরা সুলতানা বলেন, তারা শ্রমিকদের কাছ থেকে কি বলে টাকা তোলে এটা শ্রমিক ও ইউনিয়নের বিষয়। পুলিশের কেউ এক টাকাও কোথা থেকে নেয় না। খুলনা শ্রম অধিদপ্তর ও বিআরটিএ এ বিষয়ে অভিন্ন বক্তব্য দিয়েছে।
