সিরাজুল ইসলাম, শ্যমনগর : সাতক্ষীরা বাঙালি জাতির অবিস্মরণীয় কীর্তি স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয় অর্জন। ১৯৭১এর সেই তেজস্বী গৌরব- গাঁথা নিয়ে এই প্রতিবেদন।
মহান স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জাতিকে বিশ্বের মানুষের সামনে মাথা উঁচু করে বুক টানটান করে দাঁড়ানোর সাহস শক্তি ও শিক্ষা দিয়েছে। এ মর্যদার আসন অর্জন করতে ৩০ লক্ষ জীবন এবং ২লক্ষ মা বোনের সম্ভ্রমের সর্বচ্চো মুল্য দিতে হয়েছে, যা কখনোই পরিশোধ যোগ্য নয়। যাদের জীবনের বিনিময়ে আমরা যারা আজ বংশপরম্পরায় স্বাধীনতার সুফল ভোগ করছি, স্বাধীন জাতি হিসেবে মাথা উঁচু করে বিশ্বে পরিচিত হচ্ছি; আজএক কাতারে দাঁড়িয়ে সেই জীবন উৎসর্গ করা আমাদেরই স্বজন জাতীয় বীর মুক্তিযোদ্ধা ও আত্মত্যাগীদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে ৯নং সেক্টরের মুক্তিযুদ্ধের ভুমিকা ও গুরুত্ব অপরিসীম। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম সুন্দরবন সীমান্ত অঞ্চলের বীর মুক্তিযোদ্ধাগণের দক্ষতাপূর্ণ গেরিলা এবং সম্মুখ যুদ্ধের ফলে সুন্দরবন সহ উপকূলীয় শ্যামনগর, কালিগজ্ঞ, দেবহাটা, ভোমরা অঞ্চল ১৯৭১ এর ২৩ নভেম্বরের মধ্যে পাক হানাদার মুক্ত হয়। ০৩ ডিসেম্বরের মধ্যে শহর সাতক্ষীরা সহ বৃহৎ অঞ্চল প্রথম পাক হানাদারশত্রু মুক্ত হয়। বীর মুক্তিযোদ্ধাগণের সাফল্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধা জনতার মনে পূর্ণ স্বাধীনতার স্বপ্ন জাগায়। নবম সেক্টরে অসংখ্য ছোট বড় যুদ্ধে সংঘটিত হয়। বিশেষ কটি যুদ্ধের সংক্ষিপ্ত তথ্য উল্লেখ করা হলো।
টাউনশ্রীপুরের যুদ্ধ: নবম সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাগণের বীরত্বপূর্ণ প্রথম যুদ্ধ টাউনশ্রীপুর যুদ্ধ। এই যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন বীর মুক্তিযোদ্ধা অনারারি ক্যাপ্টেন মাষ্টার শাহজাহান। সাত জুন ১৯৭১ প্রত্যুষে ইছামতীর তীরবর্তী প্রসিদ্ধ ওই গ্রামের পরিত্যাক্ত বাড়ির একটি বাগানে এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে শহীদ হন হাবলু, নারায়ণ, নাজমুল, কাজল, বিলু সহ সাত জন বীর মুক্তিযোদ্ধা। ২০/২৫জন শত্রুসেনা এই যুদ্ধে খতম হয়। বলা যায় এটি ছিল ৯নং সেক্টরের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গেরিলাদের মর্যদাপূর্ণ আক্রমণ। এর পর থেকে সীমান্ত পারের মুক্তি ক্যাম্প থেকে প্রায় প্রতি রাতে পাকসেনাদের উপর গেরিলা হামলা চলতো। পর্যায়ক্রমে ভারতীয় প্রশিক্ষণ ক্যাম্প গুলি থেকে দলে দলে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাগণ সীমান্ত পারের হিঙলগজ্ঞ, টাকি, শমসেরনগর প্রভৃতি ক্যাম্পে অবস্থান গ্রহণ করেন।
গোপালপুর যুদ্ধ; ১৯ আগষ্ট ১৯৭১ শ্যামনগর অঞ্চল হানারমুক্ত করার লক্ষ্যে সাজোয়া পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে বীর মুক্তিযোদ্ধাগণ সম্মুখ যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এর আগে হিঙলগজ্ঞ মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পের কমান্ডিং অধিনায়ক ক্যাপটেন নূরুল হুদার নির্দেশে মেজর লিয়াকত আলী খান, লেফটেন্যান্ট বেগ, মিজানুর রহমান সহ কয়েক জন কমান্ডারের নেতৃত্বে সীমানা পেরিয়ে পাঁচ শতাধিক সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা শ্যামনগরে আক্রমণ করে থানা দখল করে জয় বাংলা ধ্বনি দিয়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়িয়ে ওয়াপদা ভবন সহ আসপাশ্বে অবস্হান গ্রহণ করেন ১৮ই আগষ্ট। এই ঘটনার ফলে হটে যাওয়া পাক সেনারা রাতের অন্ধকারে সাজোয়া বাহিনী নিয়ে সাতক্ষীরা থেকে এসে দুদিক থেকে ভোরবেলায় শ্যামনগরে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের উপর আক্রমণ চালায়। ফলে মুক্তিগেরিলারা গোপালপুর নামক স্থানে এক বয়াবহ সম্মুখ যুদ্ধে লিপ্ত হন। যুদ্ধে সুবেদার ইলিয়াস খান, আব্দুল কাদির আবুল কালাম আজাদ সহ পাঁচ ছয় জন বীর মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হন। পাক হানাদারদের নৃশংসগুলিতে দশজন সাধারণ মানুষ মৃত্যু বরণ করেন। গোপালপুর যুদ্ধে নবম সেক্টরের এই বিপর্যয়ের ফলাফল হয় সুদুরপ্রসারী।
অন্যান্য যুদ্ধ: পরবর্তীতে শ্যামনগরের রামজীবনপুর, কৈখালী, বুড়িগোয়ালিনী, হরিনগর, হায়বাতপুর, নুরনগন, শংকরকাটি খানপুর প্রভৃতি স্থানে এবং সুন্দরবনের অভ্যন্তরে নৌকমান্ডো যুদ্ধ ও গেরিলা যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
শ্যামনগর মুক্ত: বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্রমাগত পরিকল্পিত হামলার ফলে ১৯৭১ এর ১৯নভেম্বর সুন্দরবন সংলগ্ন শ্যামনগর উপজেলা থেকে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ওই অঞ্চল থেকে প্রথমে হটে যেতে বাধ্য হয়। এখানে বেশ কয়েক জন পাকসেনা নিহত হয়। এ বিষয়ে মুজিবনগর সরকার ফোর্স কার্যালয়ের যুদ্ধ বুলেটিং এ উল্লেখ করা হয়েছে, “Mukit Bahini is now in cnntrol of Kaligonj. On November 19,Mukti Bahini advanced towards SHYAMNAGAR and after minor exchange of fire,Mukti Bahani advanced towards NOORNAGAR and drove the occupation troops.,,,On the same day Mukti Bahini raided SANKERKATI and after heavy fight they captured it.,,, Acceding to latest report intensive fight is continuing all around Satkhira, a subdivisonal Town of Khulna district.” তথ্যসূত্রঃ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র- একাদশ খন্ড, পৃষ্ঠা- ১৫৯-৬০।
কালিগজ্ঞ মুক্ত: ২০ নভেম্বর বসন্তপুর, নাজিমগজ্ঞ কালিগঞ্জে ক্যাপ্টেন নুরুল হুদার কমান্ডে পাকবাহিনীর সাথে তুমুল যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে টিকতে না পেরে কালিগজ্ঞ অঞ্চল থেকে পাকিস্তান আর্মি পিছু হটে দেবহাটা উপজেলার পারুলিয়া অভিমুখে চলে যায়। কালীগজ্ঞের যুদ্ধে পাকবাহিনী বহুগোলা-বারুদ ও সৈন্য হারিয়ে পিছু হটতে বাধ্য হয়। বীর মুক্তিযোদ্ধাগণ পুরা অঞ্চল দখলে নেয়। ২০ নভেম্বর পাক হানাদার মুক্ত হয় কালিগজ্ঞ অঞ্চল। দিনটি ছিল পবিত্র ঈদের দিন। সীমানা ঘেঁষা এই উপজেলার বসন্তপুর, রতনপুর, মৌতলা, কালিগজ্ঞসহ সীমান্তের অনেক স্থানে বিভিন্ন ভাবে মুক্তিযোদ্ধাগণ কখনো গেরিলা হামলা কখনো সম্মুখ যুদ্ধ করে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী এবং তাদের দোসর রাজাকার বাহিনীকে বিধ্বস্ত করে।
২০ নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল আক্রমণের মুখে সৈন্য হারিয়ে, গোলাবারুদ ফেলে পাকবাহিনী কালিগজ্ঞ অঞ্চল ছেড়ে পালিয়ে যায়।,,, “Mukti Bahini raided the occupation troops position in BASANTAPUR of Kaliganj Police Station under Satkhira Subdivision on 20th November. After the whole day fight Mukti Bahini captured BASANTAPUR. On the same day Mukri Bahini continued advancing towards KALIGANJ Police Station. After heavy exchange of fire and suffering casualties the occupation troops retreated from Kaliganj. (বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র একাদশ খন্ড, পৃষ্ঠা -১৫৯) কালিগজ্ঞ থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ডাকটিকিট প্রকাশিত হয়।
৯ নং সেক্টরের অন্যতম যুদ্ধপরিচালনাকারী ক্যাপ্টেন নুরুল হুদা সহ¯্রাধিক বীর মুক্তিযোদ্ধার সমাবেশের মাধ্যমে কালিগজ্ঞে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন।
দেবহাটা মুক্ত: সেক্টর কমান্ডার মেজর এম এ জলিল এর নির্দ্দেশে ক্যাপ্টেন নুরুল হুদার নেতৃত্বাধীন যোদ্ধাগণ দীর্ঘ পথ পায়ে হেঁটে অগ্রবর্তী পাক ঘাটি দেবহাটায় আক্রমন চালানোর জন্য অগ্রসর হয়। এদিকে টাউনশ্রীপুর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প থেকে অনারারী ক্যাপ্টেন মাষ্টার শাহজাহান তাঁর বাহিনী নিয়ে মাঝ পথে আক্রমন চালায়। পাক-হানাদাররা দিশাহারা হয়ে পারুলিয়া ব্রিজ ধ্বংস করে দিয়ে কুলিয়া ব্রিজের উত্তর পারে অবস্থান গ্রহণ করে। ক্যাপ্টেন নুরুল হুদা তাঁর বাহিনী নিয়ে ৪ মাইল দূরে অবস্থান নেয়। লেপ্ট্যানেন্ট মাহফুজ আলম বেগ জানান, তিনি “রাতের অন্ধকারে কয়েক জন গেরিলা যোদ্ধা নিয়ে পাকসেনাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ডিনামাইট দ্বারা কুুলিয়া-শ্রীরামপুর ব্রিজ ভেঙে দেন, এখানে কয়েক জন পাক-টহল সেনা নিহত হয়।”এখানে ত্রিমুখী যুদ্ধে হানাদার সৈন্য, গোলাবারুদ হারিয়ে টিকতে না পেরে পিছু হটতে বাধ্য হয়।
কুলিয়া মুক্ত; ২৩ নভেম্বরের মধ্যে কুলিয়া, ভোমরাসহ আলীপুর অঞ্চল পাক-হানাদার মুক্ত হয়। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ফোর্স হেড কোয়ার্টারের ২৩ নভেম্বর /১৯৭১ এর যুদ্ধ বুলেটিং এ উল্লেখ আছে, “ÒIn Khulna Sector Mukti Bahini yesterday captured enemy position at BHOMRA and KHULIA. Fearing to be cutoff the Pakistani army has vacated Satkhira town During their raid in Kulia area Mukti Bahini killed 12 enemy soldiers.” তথ্যসূত্রঃ স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র ১১তম খন্ড, পৃষ্ঠা -১৬০।
সেক্টর কমান্ডার মেজর এম এ জলিল তাঁর সীমাহীন সমর গ্রন্থে বলেছেন, “২৩শে নভেম্বর পারুলিয়া থেকে চার মাইল দূরে আর একটা ব্রীজের পিছনে হানাদাররা সরে গেল। আমাদের সৈন্যরা সামনের দিকে অগ্রসর হতে লাগলো”।
নবম সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাগণের নিরাপদ ঘাটি ছিল ভারতের হিঙ্গলগজ্ঞ, হাসনাবাদ, টাকী, সমশেরনগর। সেখান থেকে দলে দলে মুক্তিযোদ্ধা মাতৃভুমিতে ঢুকে ক্ষুধার্ত বাঘের ন্যায় পাক আর্মি ও তাদের দোসর রাজাকার আলবদরদের উপর হামলা চালায়।
ভোমরা মুক্ত; এদিকে ভোমরা সীমান্তে ভীষণ যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে পরাজিত হয়ে হানাদার বাহিনী সাতক্ষীরা অভিমুখে পালিয়ে গিয়ে বাঁকাল ব্রীজের পারে অবস্থান গ্রহণ করে।
মেজর এম,এ জলিলের ‘সীমাহীন সমর’ গ্রন্থ থেকে জানা গেছে, ক্যাপ্টেন হুদা, মিঃ চৌধুরী ও শাহজাহনের নেতৃত্বাধিন মুক্তিবাহিনী ও তাদের লোকজন একত্র করে আটটি কোম্পানিতে বিভক্ত করেন যুদ্ধ পরিচালিত হয়। লেঃ মোহাম্মদ আলী, লেঃ আহসানউল্লাহ, লেঃ শচীন এবং চৌধুরীকে নেতৃত্বের দায়িত্ব দিয়ে সাতক্ষীরা দিকে অগ্রসর হয়ে যুদ্ধের নির্দেশ প্রদান করা হয়। তিনি উল্লেখ করেছেন, “২৩ নভেম্বর চার মাইল দুরে আর একটা ব্রিজের পিছনে হানাদাররা সরে গেল।” অর্থাৎ পাকআর্মিরা বাঁকাল ব্রিজের সাতক্ষীরা পারে অবস্থান নেয়।
২৩ নভেম্বরের মধ্যে ১৯৭১ সীমান্তবর্তী দেবহাটা, কুলিয়া, ভোমরা আলীপুর অঞ্চল পাক-হানাদার মুক্ত হয়। এর পর তারা বাঁকাল ব্রিজ ভেঙে দিয়ে সাতক্ষীরার পারে ঘাটি গাড়ে। মুক্ত হয় সাতক্ষীরর সীমান্ত অঞ্চল।
দীর্ঘ পরাধীনতার পর এ অঞ্চলের মানুষ প্রথম গ্রহন করে মুক্ত বাতাস। বাংলাদেশ ফোর্স হেডকোয়ার্টারের ২৩ নভেম্বর ১৯৭১ এর যুদ্ধ বুলেটিন এ উল্লেখ করা হয়েছে,“In Khulna Sector,Mukti Bahini yesterday captured enemy position at BHOMORAR and KHULIA. Fearing to be cut off the Pakistani Army has vacated Satkhira town.During their raid in Kulia area, Mukti Bahini killed 12 enemy soldiers. (সূত্রঃ স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিল পত্র ১১তম খন্ড, পৃষ্ঠা-১৬০)
কর্নেল ওসমানীর মুক্তাঞ্চল পরিদর্শনঃ স্বাধীনতার এই ঊষালগ্নের কথা বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচারিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের সেক্টরস অধিনায়ক কর্ণেল এম এ জি ওসমানী ২৬শে নভেম্বর ১৯৭১ সাতক্ষীরার হানাদার মুক্ত স্বাধীন দেবহাটা কুলিয়া অঞ্চল পরিদর্শন করেন এবং বীর মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসাহিত করেন। এ সময় তাঁর একান্ত সচিব, বঙ্গবন্ধু পুত্র ক্যাপ্টের শেখ কামাল ও অন্যান্য সমর নায়কগণ উপস্থিত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের নবম সেক্টর কমান্ডার মেজর এম এ জলিল, ক্যাপ্টেন নুরুল হুদা সহ অন্যান্য সামরিক কর্তাগণ তাকে অভ্যর্থনা জানান। এ পর্যায়ে স্বাধীন ও মুক্তঞ্চল দেবহাটায় মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা হয়।
প্রবাসী সরকার মন্ত্রীর সাতক্ষীরা মুক্তাঞ্চল পরিদর্শনঃ কর্ণেল এম এ জি ওসমানীর সাতক্ষীরা মুক্তাঞ্চল পরিদর্শনের পর স্বদেশের মাটি সাতক্ষীরার মুক্তাঞ্চল প্রথম পরিদর্শনে আসেন ৭১ এর প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী (জাতীয় নেতা) এম কামরুজ্জামান। এসময় তাঁর সাথে ছিলেন দেশী-বিদেশী গণমাধ্যম কর্মী ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। দলে দলে মুক্ত উৎসুক জনতা তাঁদের অর্ভত্থনা জানায়।
এপর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধাগণ প্রবল মানসিক পরাক্রমে চারদিক থেকে সাতক্ষীরা শহরের গেরিলা হামলা চালায় এবং রাস্তায় ট্যাংক বিধ্বংসী মাইন পেতে পাকসেনাদের খতম ও বিভ্রান্ত করে তোলে। ফলে ভারতীয় মিত্র সেনাবাহিনী বাংলাদেশে ঢোকার পূর্বেই মুক্তিযোদ্ধাগণের পরাক্রমের মুখে সাতক্ষীরা শহর পাকহানাদার মুক্ত হয়। বলা হয়েছে, “In this engagement 3 enemy soldiers including one captain were killed and the jeep was destroyed. SATKHIRA Town is now isolated from the rest of KHULNA District, it is learnt.(সূত্রঃ পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা-১৬৩)
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে নিঃসন্দেহে বলা যায় ১৯৭১ এর নভেম্বর মাসের ১৯ তারিখ থেকে ২৩ তারিখের মধ্যে সুন্দরবন উপকূলীয় শ্যামনগর থেকে ভোমরা বর্ডারসহ বাঁকাল পর্যন্ত পাকহানাদার মুক্ত করে নবম সেক্টরের যোদ্ধাগণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছেন। এই অসাধারণ ভুমিকা দেশের অন্যান্য অঞ্চলের বীর মুক্তিযোদ্ধাগণকে যুদ্ধজয়ে আত্ম প্রত্যয়ী করে তুলতে সক্ষম হয়েছে এবং ভুক্তভোগী দেশী-বিদেশী স্বাধীনতাকামী কোটি কোটি জনতাকে বাংলাদেশ স্বাধীনের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপদান করেছে।
এর পর সারাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ জয়ের আকাংখা বেড়ে যায়।
এদিকে নবম ও অষ্টম সেক্টরের যোদ্ধাগণ দলে দলে আনাড়ি পথে সাতক্ষীরা শহর ও সংলগ্ন অঞ্চলে ঢুকে পড়ে এবং শহরের খুলনা এবং যশোরগামী সড়কের দু’পাশে পাক বাহিনীর সুরক্ষিত বাংকারে ক্রমাগত কখনো গেরিলা, কখনো সম্মুখ হামলা চালানোর ফলে পাকিস্তানী আর্মিরা সাতক্ষীরা শহর, থেকে ছাউনি গোঠাতে বাধ্য হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের ট্যাংক ধ্বংসকারী মাইন ব্যবহারের পর ভীত হয়ে পাকিস্তান আর্মির একটি অংশ কলারোয়ার হয়ে যশোরের পথ ধরে অন্য অংশ বিনেরপোতা ব্রীজ ভেঙে দিয়ে প্রাণ ভয়ে চুকনগর-খুলনার পথ ধরে।
সাতক্ষীরা যুদ্ধে বেশ কয়েক জন পাকআর্মি, অফিসার এবং সৈন্য নিহত ও গাড়ি ধ্বংস হয়। এই অবস্থায় অস্ত্র-সস্ত্র, গোলাবারুদ ফেলে তারা পশ্চাৎপদ অনুস্মরণ করে। মেজর এম এ জলিল উল্লেখ করেছেন, ডিসেম্বর ১৯৭১ এর তিন তারিখের মধ্যে পাকসেনারা সাতক্ষীরা শহর ছেড়ে চুকনগর-দৌলতপুর রাস্তা ধরে খুলনার পথে রওনা হয়। তিনি উল্লেখ করেছেন, “আমাদের মুক্তিবাহিনী ডিসেম্বর মাসের ৩ তারিখে সাতক্ষীরা অধিকার করে সাতক্ষীরা-দৌলতপুর রোড ধরে অগ্রসর হতে লাগলো”,,,।
এই ভাবে মিত্রবাহিনী পাকিস্তান আর্মির বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার পূর্বেই মুক্তিযোদ্ধাগণের যুদ্ধে হানাদার মুক্ত হয় সীমান্তবর্তী তৎকালীন মহাকুমা শহর সাতক্ষীরা সহ সীমান্ত অঞ্চল। আমাদের দৃষ্টিতে যুদ্ধজয়ের মাধ্যমে হানাদার মুক্ত অঞ্চল হিসেবে বাংলাদেশের সুন্দরবনসহ উপকূলীয় সাতক্ষীরা অঞ্চলই প্রথম একক বৃহৎ পাক-হানাদার মুক্ত স্বাধীন ভূুখন্ড।
মুক্তিযুদ্ধে দেশের প্রথম হানাদারমুক্ত স্বাধীন অঞ্চল সুন্দরবন উপকূলীয় জনপদ

Leave a comment