যশোর অফিস : যশোর জেলা পরিষদে চলছে গাছচুরির মহোৎসব। জেলা পরিষদের মালিকানাধীন বিভিন্ন সড়কের পাশের শতবর্ষী এসব গাছ প্রকাশ্যে লুটপাট করছে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীরা। অভিযোগ রয়েছে জেলা পরিষদের একাজের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা কর্মচারীদের যোগসাজসে এই গাছ চুরির ঘটনা ঘটছে। এর ফলে সরকার যেমন কোটি কোট টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে তেমনি পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে মারাত্মকভাবে । এলাকাবাসী বলছেন, এতোদিন একটি রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় থাকায় তার নেতাকর্মীরা মাঠ পর্যায়ের বিভিন্ন প্রশাসনিক চেয়ারে বসে যা খুশি তাই করে গেছেন। কিন্তু ৫ আগষ্ট মহা বিপ্লবের পর শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেলেও তার ল্যান্সপেন্সারা সগৌরবে পূর্বের ন্যায় যশোরের বিভিন্ন অপকর্ম করছে এক প্রকার প্রকাশ্যে। যা দেখার কেউ নেই।
সূত্র বলছেন, যশোরের জেলা পরিষদে রয়েছে কয়েকশো কোটি টাকা মুল্যের শতবর্ষী শত শত রেইন্ট্রি কড়াই থেকে শুরু করে মেহগণী, শাল, সেগুন, আম কাঠালসহ নানা মুল্যবান বড় বড় গাছ। বিশেষ করে ঐতিহাসিক যশোর রোড, যশোর-খুলনা মহাসড়ক, যশোর-নড়াইল মহাসড়ক, যশোর-ঝিনাইদহ মহাসড়ক,যশোর-সাতক্ষীরা ভায়া নাভারণ মহাসড়কসহ যশোর- কেশবপুর, যশোর-চৌগাছা, যশোর- বাঘারপড়াসহ ছোট বড় প্রায় শতাধিক সড়ক রয়েছে যার মালিক যশোর জেলা পরিষদ। আর এসব মহাসড়ক ও আঞ্চলিক সড়কের দুই পাশে ছিল হাজার হাজার মহামুল্যবান কাঠের গাছ। কিন্তু গত সাত বছরে জেলা পরিসদের চেয়ারম্যান সাইফুজ্জামান পিকুল ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা কোন প্রকার নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে কোটি কোটি টাকার গাছ নিলামের নামে চুরি করে বিক্রি করেছেন। সূত্র বলছে, ২০১৮ সালের ২ ডিসেম্বর যশোর-খুলনা মহাসড়কের শেষ সীমানা পর্যন্ত ৪ গ্রুপ ও যশোর ঝিনাইদহ সড়কের হৈবতপুর ব্রীজ পর্যন্ত ১ গ্রুপ সর্বমোট ৫ গ্রুপে ১৯৬২টি শতবর্ষী মেহগনী ও রেইন্ট্রি গাছ টেন্ডার করে জেলা পরিষদ। সে সময় নামে বেনামে এই ৫ গ্রুপের টেন্ডারই বাগিয়ে নেন জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামীলীগের সহ সভাপতি সাইফুজ্জামান পিকুল ও তার ছেলে জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানজিব নওশাদ পল্লব। প্রায় ৫০ কোটি টাকা মুল্যের এসব গাছ মাত্র সাড়ে ৫ কোটি টাকার মুল্যে কিনে নেন পিকুল ও তার ছেলে। একই ভাবে যশোর -নড়াইল ও যশোর- চুকনগর সড়কের গাছের টেন্ডারও নিজেদের নামে বেনামে ক্রয় করেন বাপ-বেটা। নিজ ক্ষমতাবলে সরকারী টেন্ডারের টাকা জেলা পরিষদের হিসাবে জমা না দিয়েই বের করে নেন ওয়ার্ক অর্ডার। এর পর ওই ওয়ার্ক অর্ডার ৩৫ কোটি টাকায় বিক্রি করে দেন যশোরের লোন অফিস পাড়ার মেসার্স বাবলু এন্ট্রারপ্রাইজসহ ২/৩জন ঠিকাদারের কাছে। এখানেই শেষ নয়। যশোর-বেনাপোলসহ বিভিন্ন আঞ্চলিক সড়কের গাছও লুটপাট করেছেন দেদারছে। সব জানলেও সে সময় কারোর মুখ খোলার বা লেখার সাহস ছিল না। চুন থেকে পান খসলেই পিকুল ও তার ছেলের ক্যাডাররা অস্ত্র হাতে গর্জে উঠতো। সর্বশেষ চলতি বছরের মার্চ মাসে তৃতীয় দফায় জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান তার পছন্দের স্টাফ সার্ভেয়ার আল-আমিনকে কাজে লাগিয়ে শার্শা-গোগা সড়ক, শার্শা-গোড়পাড়া সড়ক, ঝিকরগাছা-বাকড়া সড়ক,ঝিকরগাছা- কায়েককোলা সড়ক, চৌগাছা মহেশপুর সড়ক,চৌগাছা-কোটচাঁদপুর সড়ক, চৌগাছা- যশোর সড়ক, পুলেরহাট- ত্রিমোহিনী সড়ক,সদর উপজেলার হৈবতপুর-পরানপুর সড়ক ও শার্শার গোড়পাড়া- ব্যাঙদা সড়কের ৫০৯টি রেইন্ট্রি ও মেহগণী গাছ বিক্রির দরপত্র আহবান করে। গত ২৯ এপ্রিল এই টেন্ডারের ওয়ার্ক অর্ডার দেন দুই গ্রুপে ভাগ করে।১নং গ্রুপে মেসার্স মিলন এন্টার প্রাইজের স্বত্বাধিকারী মহিদুল ইসলাম মিলন ভ্যাট আইটিসহ মোট ১৮ লাখ ৯৯ হাজার টাকা মুল্যে ২৫৬টি জীবিত গাছ ক্রয় করেন। আর ২নং গ্রুপের মৃত ও ঝুকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত ২৫১ টি গাছ ভ্যাট আইটিসহ ৫ লাখ ১৫ হাজার টাকায় ক্রয় করেন মেসার্স জাহান এন্ট্রারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী আওয়ামীলীগ নেতা শহরের কাজীপাড়ার তৌফিক জাহান। কিন্তুু মজার বিষয় হচ্ছে মেসার্স জাহান এন্ট্রারপ্রাইজের নামে ওয়ার্ক অর্ডার দেওয়া হলেও টেন্ডারের বিষয়ে কিছুই জানেন না তৌফিক জাহান। তিনি সাংবাদিকদের জানান,জেলা পরিষদ কবে ,কখন, কোথায় , কিসের টেন্ডার দিয়েছে বা কি কাজের ওয়ার্ক অর্ডার দিয়েছে তা আমার জানা নেই। আমি জেলা পরিষদের কোন গাছের টেন্ডারে অংশ গ্রহণ করিনি। কাগজপত্রে যা করা হয়েছে তার সবই করেছেন জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান সাইফুজ্জামান পিকুল ও জেলা পরিষদের প্রকৌশলী এবং সিইওি ও এও সাহেব। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই ২ নং গ্রুপের টেন্ডারের কেবল মাত্র আনুষ্ঠানিকতা করা হয়েছে কাগজপত্রে। কাজ হয়েছে সবই চেয়ারম্যানের নির্দেশে।
এদিকে মেসার্স জাহান এন্ট্রারপ্রাইজের নামে শার্শার জনৈক রুবেল নামের এক যুবলীগ নেতা গত কয়েক মাস ধরে ওই কাগুজে ওয়ার্ক অর্ডার বলে যশোর জেলার বিভিন্ন আঞ্চলিক সড়ক থেকে শত শত গাছ কেটে বিক্রি করে দিচ্ছেন। ওয়ার্ক অর্ডারে মৃত ও ঝুকিপূর্ণ গাছ কাটার নির্দেশ থাকলেও সে দেদারছে জীবিত ও শতবর্ষী সব রেইন্ট্রি ও মেহগণী গাছ কেটে বিক্রি করছে। খোঁজ খবর নিয়ে জানা গেছে,সরকার পতনের পর কয়েকদিন গাছ কাটা বন্ধ থাকলেও গত ১৬ আগষ্ট থেকে রুবেল ফের লোকজন লাগিয়ে বিভিন্ন রাস্তার জীবিত গাছ কাটা শুরু করেন। খবর পেয়ে সরেজমিন যশোরের নাভারণ-বাগআচড়া ও শার্শা -গোড়পাড়া এবং শার্শা-জামতলা সড়কে গিয়ে দেখা যায়,এসব সড়কের বিভিন্ন স্থান থেকে ১৭৫টি গাছ কাটা হয়েছে। যার মধ্যে ১৫৬টিই জীবিত এবং ওয়ার্ক অর্ডারের বাইরের গাছ। বিষয়টি অবহিত হওয়ার পর জেলা পরিষদের সহকারী প্রকৌশলী ওয়াহিদুজ্জামান, ওএও লুৎফর রহমান সাথে নিয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন এবং গাছ চুরির ঘটনাটি সরেজমিন তদন্ত করেন। এসময় তারা প্রাপ্ত অভিযোগের শতভাগ সত্যতা প্রাপ্তির পর ঠিকাদার রুবেলের সাথে কথা বলেন। রুবেল জানান, তিনি প্রকৃত ঠিকাদার নন। তিনি ২০ লাখ টাকায় জনৈক বকুল ও মনু মিয়ার কাছ থেকে এই গাছ কিনে নিয়েছেন। তাকে যেভাবে জেলা পরিষদের সার্ভেয়ার আল আমিন দেখিয়ে দিয়েছেন তিনি সেই ভাবেই গাছ কাটছেন। এ বিষয়ে সার্ভেয়ার আল আমিনকে জিঙ্গাসা করলে তিনি কোন সদুত্তর দিতে পারেননি। সূত্র বলছে, এই গাছ কাটার সাথে ও অর্থ লেনদেনের সাথে জেলা পরিষদের অনেক কর্মকর্তাই জড়িত। কারন এখন চেয়ারম্যান তো নেই । ৫ আগষ্টের পর চেয়ারম্যান ও তার ছেলে পালিয়ে গেছে। এখন ১৬ আগষ্ট থেকে কিভাবে কোন প্রকার কাগজপত্র ছাড়াই রুবেল কোটি কোটি টাকা মুল্যের সরকারী গাছ দেদারছে কাটছে। জেলা পরিষদের সার্ভেয়ার ও স্টাফদের উপস্থিতিতে যখন এসব মহামুল্যবান গাছ কাটা হচ্ছে তখন সাধারণ লোকের তো কিছু বুঝতে বাকি থাকে না।
এব্যাপারে যোগাযোগ করা হলেও জনৈক বকুল ও মনু মিয়ার কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি। মেসার্স জাহান এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী তৌফিক জাহান বলেন, তিনি গাছেন কোন টেন্ডার দেননি। কোন ওয়ার্ক অর্ডার পাননি। কোন পে -অর্ডার জমা দেননি। তিনি মনু ও বকুল নামে কাউকে চেনেন না। ফলে বকুল ও মনু নামের কারোর কাছে ওই গাছ বিক্রি করার প্রশ্নই আসে না।
এ বিষয়ে যোগযোগ করা হলে যশোর জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান বলেন, যে সব তথ্য পেয়েছেন তা রিপোর্ট করে দেন। আমি নিজেও এতোদিন খুবই অসহায় ছিলাম। যশোর জেলা পরিষদে গত ৫/৭ বছরে যে সব অন্যায় অনিয়ম হয়েছে তা ভাষায় বলা সম্ভব নয়। সব জেনেও কোন প্রতিকার করতে পারিনি। আপনারা সাংবাদিকরা এখন সুযোগ পেয়েছেন হাত খুলে লেখেন। বর্তমান সরকার উপযুক্ত ব্যবস্থা নেবেন।
জেলা পরিষদের প্রশাসক ও যশোরের ডিসি আবরাউল হাসান মজুমদারের সাথে এসব গাছ চুরির বিষয়ে কথা বললে তিনি বলেন, সব ঘটনা শুনেছি। কি করে এসব হচ্ছে তা তো বুঝতে পারছি না। ঘটনা তদন্ত করে ২ কার্য দিবসের মধ্যে রিপোর্ট দাখিল করতে সিইওিকে নির্দেশ দিয়েছি। তদন্ত রিপোর্ট না পাওয়া পর্যন্ত জেলা পরিষদের সব গাছের টেন্ডারের কার্যক্রম স্থগিত ও গাছ কাটা বন্ধ করার আদেশ দিয়েছি। রিপোর্ট হাতে পেলেই পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। মনে রাখবেন দূর্নীতি করে কেউ এখন আর ছাড় পাবে না। সে সরকারী স্টাফ হোক আর বাইরের ক্ষমতাধর ঠিকাদার হোক।