সিরাজুল ইসলাম : আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহর জন্য পবিত্র রমজান মাস জুড়ে সিয়াম সাধনা তথা রোজাকে ফরজ করেছেন। রোজা শুধু ইসলামের অনুসারি উম্মাতে মুহাম্মাদির ওপরই ফরজ হয়নি বরং পৃথিবীর শুরু থেকেই এ রোজার প্রচলন ছিল। অনেক নবি-রাসুলের ওপর তা ছিল ফরজ।
কুরআনে পাকের যে আয়াত দ্বারা উম্মাতে মুহাম্মাদির জন্য রোজাকে ফরজ করা হয়েছে, সে আয়াতেই আল্লাহ তাআলা পূর্ববর্তীদের ওপর রোজা ফরজ হওয়ার বিষয়টি জানিয়ে দেন। আল্লাহ তাআলা বলেন-
‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর সিয়াম বা রোজা ফরজ করা হয়েছে; যেভাবে তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর ফরজ করা হয়েছিল; যাতে তোমরা তাকওয়া (আত্মশুদ্ধি) অর্জনে করতে পার। (সুরা বাকারা : আয়াত ১৮৩)
আলোচ্য আয়াত থেকে জানা যায় যে, আল্লাহ তাআলা সব যুগের নবি-রাসুলদের জন্য রোজা রাখাকে আবশ্যক করে দিয়েছিলেন। ইসলামের আগে নবি-রাসুলদের রোজার কিছু তথ্য তুলে ধরা হলো-
হজরত আদম আলাইহিস সালামের রোজা প্রসঙ্গে ফতহুল বারিতে এসেছে, ‘তিনি যখন আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে জান্নাতে ফল খেয়েছিলেন এবং আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করায় তার কাছে ৩০ দিন পর্যন্ত তাওবা করেছিলেন। ৩০ দিন পর হজরত আদম আলাইহিস সালামের তাওবা আল্লাহ কবুল করেন। তারপর থেকে তাঁর সন্তানদের জন্য ৩০টি রোজা ফরজ করে দেয়া।
প্রথম রাসুল হজরত নূহ আলাইহিস সালামের যুগেও সিয়াম বা রোজা রাখার প্রচলন ছিল। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘হজরত নূহ আলাইহিস সালাম শাওয়াল মাসের প্রথম দিন এবং জিলহজ মাসের ১০ম দিন ছাড়া সারা বছর রোজা রাখতেন।’ (ইবনে মাজাহ)
হজরত নূহ আলাইহিস সালামের পর সর্বাধিক পরিচিত নবি ছিলেন হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম। আল্লাহ তাআলা তাকে খলিল তথা বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেন। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, তাঁর যুগেও ৩০টি রোজা রাখা আবশ্যক ছিল।
হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামের পরের যুগকে বৈদিক যুগ বলা হতো। সে ধারাবাহিকতায় বেদের অনুসারী ভারতীয় হিন্দুদের মধ্যেও ব্রত তথা উপবাস প্রথা চালু ছিল। তারা প্রত্যেক হিন্দি মাসের ১১ তারিখে ব্রাহ্মণদের ওপর একাদশী’র উপবাস করতো।
হজরত মুসা আলাইহিস সালামের অনুসারী ইয়াহুদিদের মধ্যেও রোজা ছিল ফরজ ইবাদত। হজরত মুসা আলাইহিস সালাম তুর পাহাড়ে ক্ষুধা ও পিপাসায় ৪০ দিন অতিবাহিত করেছিলেন। সে হিসেবে হজরত মুসা আলাইহিস সালামের অনুসারীরা ৪০ দিন পর্যন্ত রোজা পালনকে উত্তম বলে বিবেচনা করতেন।
৪০তম দিনে রোজা রাখাকে তারা ফরজ তথা আবশ্যক মনে করতো। আর তা ছিল তাদের সপ্তম মাসের (তাশরিন) দশম তারিখ। আর এ দশম দিন ছিল তাদের কাছে আশুরা।
এ আশুরার দিনে আল্লাহ তাআলা হজরত মুসা আলাইহিস সালামকে ১০ আহকাম দান করেছিলেন। আর এ কারণেই তাওরাতে ১০ তারিখ রোজা পালনের জন্য জোর তাগিদ করা হয়। এছাড়াও ইয়াহুদিদের অন্যান্য ছহিফাগুলোতেও অন্যান্য দিনে রোজা পালনের হুকুম পাওয়া যায়।
হজরত মুসা আলাইহিস সালামের পর আসমানি কিতাবের অধিকারী ছিলেন হজরত দাউদ আলাইহিস সালাম। তাঁর যুগেও ছিল রোজার প্রচলন। তিনি একদিন পর একদিন রোজা রাখতেন। (বুখারি, মুসলিম, মিশকাত) সে হিসেবে আল্লাহর নবি হজরত দাউদ আলাইহিস সালাম বছরের অর্ধেক সময় রোজা রেখে অতিবাহিত করতেন।
হজরত ঈসা আলাইহিস সালাম দীর্ঘ ৪০ দিন পর্যন্ত রোজা রেখেছিলেন। আর খ্রিস্টান ধর্মমতে এখনও রোজা রাখার প্রভাব বিদ্যমান রয়েছে।
হজরত ঈসা আলাইহিস সালামের সমসাময়িক নবি ছিলেন হজরত ইয়াহইয়া আলাইহিস সালাম। তিনি নিজে রোজা রাখতেন এবং তার অনুসারীগণের মধ্যেও রোজা রাখার রীতি বিদ্যমান ছিল।
হজরত ঈসা আলাইহিস সালামের কাছে তার অনুসারীরা জিজ্ঞাসা করতো যে, আমরা আমাদের অপবিত্র আন্তরসমূহকে পূতপবিত্র করতে পারি বা কিভাবে অপবিত্র অন্তরসমূহেক দূর করে দিতে সক্ষম হবো?
হজরত ঈসা আলাইহিস সালাম তাদেরকে বলেছিলেন, ‘অন্তরসমূহের কলুষতা ও অপবিত্রতাকে রোজা এবং দোয়া ছাড়া দূর করার কোনো উপায় নেই।
রোজার গুরুত্ব ও তাৎপর্য তুলে ধরে প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি সিয়াম পালন করেও মিথ্যা কথা বলা, পরনিন্দা ও অন্যান্য পাপাচার থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারলো না; তার পানাহার পরিত্যাগ করা আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই।’ (বুখারি)
এ কারণে পূর্ববর্তী যুগের সব নবি-রাসুলদের সময়ও এ কথার ঘোষণা ছিল যে, তোমরা যখন রোযা রাখবে তখন লোক দেখানো মনোবৃত্তি নিয়ে মানুষের মত নিজেদের মুখমন্ডলকে উদাস করে রাখবে না। কেননা, এই শ্রেণীর মানুষ নিজেদের মুখমন্ডলের আসল রূপ বিকৃত করে রোজাদারের ভাগ গ্রহণ করতো। যাতে মানুষ মনে করে যে তারা রোজাদার।
প্রাক ইসলামি যুগে আরবাসীরাও রোজা সম্পর্কে ওয়াকিফহাল এবং তা পালনে সক্রিয় ছিল। মক্কার কুরাইশরা জাহেলিয়াতের যুগে ১০ মহররম রোজা রাখতো। এ দিনে পবিত্র কাবায় নতুন কিসওয়া বা গিলাফ পরিধান করাতো। (মুসনাদে আহমদ)
মদিনার ইয়াহুদিরাও পৃথক পৃথকভাবে আশুরার উৎসব ও রোজা পালন করতো। (বুখারি) তাদের রোজা পালনের দিনক্ষণ ছিল তাদের নিজেদের গণনার সপ্তম মাসের ১০মস দিন। প্রিয়নবি মদিনায় হিজরতের পরও ইয়াহুদিরা রোজা পালন করতেন।
রোজা হলো মুসলিম উম্মাহর জন্য রহমত বরকতম মাগফেরাত নাজাতসহ দুনিয়ার যাবতীয় কল্যাণ লাভের সেরা মাস। এ মাসের রোজা পালনে আত্মা হয় পরিশুদ্ধ।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে রমজান মাসের রোজা পালনের মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি অর্জন করার তাওফিক দান করুন। রহমত বরকত মাগফেরাত ও নাজাতে লাভের তাওফিক দান করুন। আমিন।
রমজানের রোজার উচ্চ মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্যের কারণ
রহমত বরকত নাজাতের সুসংবাদ নিয়ে আজ সন্ধ্যা থেকেই মুসলিম উম্মাহর দুয়ারে কড়া নাড়বে দুনিয়ার যাবতীয় অন্যায়-অনাচার ও গোনাহ থেকে মুক্তির মহিমান্বিত মাস রমজান। যদিও এ মাসকে রহমত ক্ষমা ও মুক্তির আলাদা দশকে ভাগ করা হয়েছে। মূলত এ মাসের প্রতিটি দিনই আল্লাহ তাআলা বান্দাকে দান করেন রহমত, বরকত, মাগফেরাত এবং নাজাত। কুরআন-সুন্নাহর আলোকে এমনটিই অনুমিত।
হাদিসের ঘোষণা অনুযায়ী আজ থেকে মুসলিম উম্মাহর জন্য জান্নাতের দরজা খুলে দেয়া হবে, জাহান্নামের দরজা বন্ধ করে দেয়া হবে, বিতাড়িত শয়তানের সব ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত থেকে মুক্তি পাবে মুসলিম উম্মাহ।
আবার রোজা পালনের মাধ্যমে যারাই রাতে বেলায় নামাজ আদায় করবে, আল্লাহ ওই সব বান্দার বিগত জীবনের সব গোনাহ ক্ষমা করে দেবেন।
সিয়াম সাধনার মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহ লাভ করবে আত্মিক পরিশুদ্ধতা ও প্রশান্তি। নিজেদের নৈতিক উন্নতি সাধনেও রয়েছে রোজার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
এ কারণেই প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুসলিম উম্মাহকে সতর্ক করে ঘোষণা করেছেন, ‘এ পবিত্র মাসে যারা রোজা রেখে মিথ্যা বলা, পরনিন্দা (গিবত) ত্যাগ ও অন্যান্য পাপাচার থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারবে না; তাদের দিনভর উপবাসে আল্লাহ তাআলার কোনো প্রয়োজন নেই।’
আর যারা নীতি-নৈতিকা ও আত্মিক পরিশুদ্ধতার জন্য রোজা পালন করবে, তাদের মুখের গন্ধ আল্লাহর কাছে মেশক আম্বরের চেয়েও বেশি সুগন্ধি মনে হবে।’
কুরআন-সুন্নাহর আলোকে যারা পবিত্র রমজানের সিয়াম সাধনায় নিজেদের আত্মনিয়োগ করবে, সময় মতো নামাজ, সাহরি, ইফতার ইত্যাদি কাজগুলো যথাযথ পালন করবে; মুসলিম উম্মাহর বছরের বাকী দিনগুলো সুন্দর, সুশৃঙ্খল ও নিয়মতান্ত্রিক পরিবার ও সমাজ তৈরি সহজ হয়ে যাবে।
সুতরাং রমজান মাস ও রোজা মুমিন বান্দার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে অনেক বড় নেয়ামত। প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাদিসে কুদসিতে এ ঘোষণাই দিয়েছেন, আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘মানুষের প্রতিটি কাজ তার নিজের জন্য হয়ে থাকে; কিন্তু রোজা শুধু আমার জন্য (রাখা হয়) আর আমি তার (রোজার) প্রতিদান দেব। (সহিহ মুসলিম)
এ কারণেই মুসলিম উম্মাহ আল্লাহর নৈকট্য লাভে ব্যক্তি, সমাজ, পাড়ায়, মহল্লায় সেমিনার সিম্পোজিয়াম, সভা-সমাবেশ করে রমজানকে স্বাগত জানিয়ে সবাইকে এ বার্তাই পৌছে দেয় যে, রহমত মাগফেরাত ও নাজাতের মাস রমজান সবার দরজায় সমাগত। স্বাগত হে মাহে রমজান।
সমাজের প্রতিটি স্তরে পবিত্র রমজানকে বরণ করতে তথা রমজানের পবিত্রতা রক্ষা ও সুষ্ঠুভাবে কর্ম সম্পাদনে সচেতনা তৈরি করতে বিশ্ব মুসলিমের কাছে পবিত্র রমজানের গুরুত্ব ও তাৎপর্য তুলে ধরে ঈমানের একান্ত অপরিহার্য দাবি।
রমজানের প্রতিটি দিন ও ক্ষণ হোক গোনাহমুক্ত জীবন লাভে পাথেয়। মহান রাব্বুল আলামিনের কাছে এ তাওফিক কামনায় রহমত মাগফেরাত ও নাজাতের মাস রমজানকে জানাই শুভেচ্ছা ও সুস্বাগতম।