By using this site, you agree to the Privacy Policy and Terms of Use.
Accept

প্রকাশনার ৫২ বছর

দৈনিক জন্মভূমি

পাঠকের চাহিদা পূরণের অঙ্গীকার

  • মূলপাতা
  • জাতীয়
  • আন্তর্জাতিক
  • রাজনীতি
  • খেলাধূলা
  • বিনোদন
  • জেলার খবর
    • খুলনা
    • চুয়াডাঙ্গা
    • বাগেরহাট
    • মাগুরা
    • যশোর
    • সাতক্ষীরা
  • ফিচার
  • ই-পেপার
  • ALL E-Paper
Reading: লোনা পানিতে কাজ: স্বাস্থ্যঝুঁকিতে উপকূলের নারীরা
Share
দৈনিক জন্মভূমিদৈনিক জন্মভূমি
Aa
  • মূলপাতা
  • জাতীয়
  • জেলার খবর
  • ই-পেপার
অনুসন্ধান করুন
  • জাতীয়
  • জেলার খবর
  • আন্তর্জাতিক
  • খেলাধূলা
  • বিনোদন
  • ই-পেপার
Have an existing account? Sign In
Follow US
প্রধান সম্পাদক মনিরুল হুদা, প্রকাশক আসিফ কবীর কর্তৃক জন্মভূমি প্রকাশনী লি: ১১০/২,সাংবাদিক হুমায়ুন কবীর বালু সড়ক, খুলনা থেকে মূদ্রিত ও প্রকাশিত
দৈনিক জন্মভূমি > জেলার খবর > সাতক্ষীরা > লোনা পানিতে কাজ: স্বাস্থ্যঝুঁকিতে উপকূলের নারীরা
সাতক্ষীরা

লোনা পানিতে কাজ: স্বাস্থ্যঝুঁকিতে উপকূলের নারীরা

Last updated: 2025/12/21 at 2:57 PM
জন্মভূমি ডেস্ক 17 hours ago
Share
SHARE

সাতক্ষীরা প্রতিনিধি : সুন্দরবনের কোলঘেঁষে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জের জেলেপাড়া। সাগরপাড়ের এই এলাকার মাটি নোনা জলের। জেলেপাড়ার দীপালি রাণীর স্বামীকে বাঘে খেয়েছে ২৩ বছর আগে। এক ছেলে এক মেয়ে। ছেলের আয়ে সংসার চলে না। আগে ক্ষেতে-খামারে কাজ করতেন। কিন্তু ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলার পর এলাকায় কাজের ক্ষেত্র কমে যায়। বাধ্য হয়ে সুন্দরবন সংলগ্ন মালঞ্চ নদীতে রেণু পোনা ও কাঁকড়া আহরণ করেন। সকাল-বিকাল দুই জোয়ারে সাত থেকে আট ঘণ্টা নদীতে নেমে রেণু সংগ্রহের জন্য জাল টানেন। নদী থেকে আহরিত রেণু প্রতি পিস ৫০ পয়সা বিক্রি করে কোনও রকম সংসার চলে তার। দীর্ঘ সময় নদীতে কাজ করার ফলে শরীরে ঘা-পাচড়াসহ বিভিন্ন সমস্যায় ভুগছেন দীপালি।
সাতক্ষীরা উপকূল ঘুরে দেখা গেছে, শ্যামনগরের মুন্সিগঞ্জ, গাবুরা, পদ্মপুকুর, বুড়িগোয়ালিনী, কৈখালি ও রমজাননগরসহ উপকূলবর্তী ইউনিয়নগুলোর অধিকাংশ নারী সুন্দরবন সংলগ্ন নদীগুলোতে সাত-আট ঘণ্টা রেণু পোনা ও কাঁকড়া আহরণ করেন। উপকূলীয় এলাকার অধিকাংশ নারীকে সংগ্রাম করে সংসার চালাতে হয়। ফলে তাদের জরায়ুসহ বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়।
বিশেষজ্ঞদের অভিমত, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সাতক্ষীরা উপকূলীয় এলাকার মাটি ও পানিতে বেড়েছে লবণাক্ততা। এতে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়েছে এলাকার মানুষ। বিশেষ করে সুন্দরবন সংলগ্ন নদীতে মাছধরা ও বনজীবী নারীরা জরায়ু সমস্যাসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।
চিকিৎসকদের তথ্যমতে, লবণাক্ত পানির জন্য নারীদের অকাল গর্ভপাত ঘটছে। জাতীয়ভাবে দেশে জন্মের হার ১ দশমিক ৩৭ শতাংশ হলেও শ্যামনগর উপজেলায় জন্মের হার শূন্য দশমিক ৮৯ শতাংশ।
সাতক্ষীরা এবং উপজেলার ক্লিনিকগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কয়েক বছর ধরে জরায়ু অপারেশন বেড়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর পাঁচ লাখ ৭০ হাজার নারী জরায়ু ক্যানসারে আক্রান্ত হন এবং প্রায় তিন লাখ ১০ হাজার নারী এই ক্যানসারে মারা যান।
২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত  হয় সাতক্ষীরা উপকূলীয় এলাকা। এরপর শুরু হয় সুপেয় পানির সংকট। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের পর ২০টির অধিক ঝড় এই উপকূলে আঘাত হানে। সুপেয় পানির অভাবে এসব এলাকায় বাড়ছে নানা রোগ। নোনা পানির কারণে ফসল হচ্ছে না। মরে যাচ্ছে গাছপালা। ফলে এলাকার মানুষ জীবিকার তাগিদে চলে যাচ্ছেন অন্যত্র। কাজের অভাবে নারীদের নদীতে রেণু পোনা আহরণ করতে হচ্ছে। লবণাক্ত পানির জন্য নারীদের অকাল গর্ভপাত ঘটছে। পাশাপাশি লবণাক্ত পানিতে নারীদের পোশাক বেশি টিকছে না, দ্রুত বদলাতে হচ্ছে।
গাবুরা ইউনিয়নের ডুমুরিয়া এলাকার আলেয়া বেগম (ছদ্মনাম) বলেন, ‘লবণাক্ত পানিতে অধিক সময় কাজ করলে বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। অনেক নারীর জরায়ুসহ বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিচ্ছে। জরায়ু কেটে ফেলতে হচ্ছে অনেকের। আতঙ্কে আছি কিন্তু করার কিছু নেই। কাজ না করলে খাবো কী? এলাকায় কাজের অভাব। সবকিছু জেনেও লবণাক্ত পানিতে নেমে রেণু পোনা ধরতে হচ্ছে।’
তার সঙ্গে কাজ করেন এমন বেশ কয়েকজন নারীর জরায়ু কেটে ফেলতে হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন আলেয়া বেগম। তিনি বলেন, ‘আমার এক প্রতিবেশী ২৪ বছর বয়সে জরায়ু কেটে ফেলতে বাধ্য হয়েছেন। জরায়ু কাটার ফলের অনেকের স্বামী তাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে জরায়ু কেটে ফেলার পরও সুস্থ হতে পারছে না। দিন দিন আরও অসুস্থ হয়ে পড়ছে। এছাড়া এসব কারণে এই অঞ্চলে ডিভোর্সের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। নারীদের স্বাস্থ্য চিকিৎসার জন্য উপকূলীয় এলাকার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দেওয়ার দাবি জানাই।’
গাবুরা ইউনিয়নের ডুমুরিয়া এলাকার ধাত্রী আসমা উল হুসনা বলেন, ‘শিশু ডেলিভারি করতে গিয়ে দেখছি শতকরা ৯৯ শতাংশ নারী জরায়ু সমস্যায় ভুগছেন। সাদা স্রাব ভাঙতে ভাঙতে ক্ষত বা ঘা হয়ে যায়। বিয়ের আগে থেকেই সমস্যা হয়। প্রথম শিশুর ডেলিভারি করাতে গিয়েও দেখেছি ওই নারীর জরায়ুতে সমস্যা। লবণাক্ত পানির কারণে মাসিক আগেই হয় এই এলাকার মেয়েদের। এসব কারণে সাংসারিক অশান্তি দেখা দেয়। স্বামীর মন রক্ষা করতে পারছে না, সংসারে কাজ করতে পারছে না। সন্তান লালন-পালন করতে কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আর মাত্রাতিরিক্ত এসব লোনা পানির দৈনন্দিন ব্যবহারের ফলে জরায়ু সংক্রান্ত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। সেজন্য অল্প বয়সে জরায়ু কেটে ফেলতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। এই এলাকার অধিকাংশ নারী এসব নিয়ে সংকোচবোধ করেন। স্বামীর সঙ্গেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে চান না। দিন দিন পানিতে লবণ বেড়েই চলছে। শীতের সময় পানি মুখে দিলে মুখ জ্বালাপোড়া করে। গোসলের পানিরও সমস্যা।’
সাতক্ষীরা জলবায়ু পরিষদের সমন্বয়কারী অধ্যক্ষ আশেক-ই-এলাহী বলেন, ‘নদীর লবণাক্ত পানিতে দীর্ঘ সময় কাজ এবং ব্যবহারের ফলে নারীদের গর্ভপাতের মতো ঘটনা ঘটছে। স্বামী ছেড়ে গেলে এই অঞ্চলের অনেক নারী বাধ্য হয়ে রেণু পোনা আহরণ করেন। ২০০৯ সালের পর এই এলাকায় জনসংখ্যা খুব বেশি বাড়েনি। কাজের সন্ধানে পুরুষরা এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছেন। ফলে বেড়েছে নারীর সংখ্যা।’
গাবুরা ইউনিয়নের ডুমুরিয়া কমিউনিটি ক্লিনিকের হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার হেলেনা বিলকিস বলেন, ‘এখানে ১০ বছর ধরে কর্মরত আছি। এই এলাকার অধিকাংশ মানুষ চর্মরোগ, ডায়রিয়া ও আমাশয়সহ পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত। অধিকাংশ নারী জরায়ুসহ বিভিন্ন শারীরিক সমস্যায় ভুগছেন। এই ইউনিয়নের চারদিকে নদী হওয়ায় নদীপথে যেতে হয়। সে কারণে উন্নত চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত এই এলাকার নারীরা।’
তিনি আরও বলেন, ‘এই এলাকায় যে পরিমাণ চাহিদা তার তুলনায় খুবই কম ওষুধ সরবরাহ করা হয়’। ওষুধের সরবরাহ বাড়াতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি।
শ্যামনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিক্যাল অফিসার ও গাইনি বিশেষজ্ঞ ডা. আঞ্জুয়ারা বেগম বলেন, ‘বেশিরভাগ নারী চুলকানি, প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া, গায়ে ব্যথা ও বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আমাদের কাছে আসেন। লবণ পানির কারণে যে নারীদের গর্ভপাত হচ্ছে, এটি গবেষণা ছাড়া বলা সম্ভব না। তবে সম্প্রতি এই এলাকার নারীদের গর্ভপাত বেশি হচ্ছে। লবণ পানিতে কাজ করায় গর্ভপাত হচ্ছে কিনা তা নিয়ে গবেষণা করতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘জরায়ু মুখে ক্যানসার হচ্ছে কিনা, এর পরীক্ষার ব্যবস্থা সরকারি হাসপাতালে আছে। কিন্তু বায়োপসি পরীক্ষার ব্যবস্থা আমাদের সব জায়গায় নেই। লবণাক্ততার কারণে জরায়ু ক্যানসার বাড়ছে কিনা, এ বিষয়ে আমাদের আরও বেশি গবেষণা দরকার।’
গাবুরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মাসুদুল আলম বলেন, ‘লবণাক্ত পানিতে কাজ করার ফলে নারীদের বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা হচ্ছে। জরায়ু কেটে ফেলার ঘটনা অনেক শোনা যাচ্ছে। এসব কারণে স্বামী ছেড়ে চলে যাচ্ছে। অধিকাংশ মানুষ শারীরিকভাবে খুবই দুর্বল। এছাড়া এই এলাকায় দ্রুত বিয়ে দেওয়ার প্রবণতা বেশি। তালাকের সংখ্যা বেড়েছে কয়েকগুণ। এলাকায় কাজ নেই। ফলে কাজের সন্ধানে পুরুষরা এলাকা ছাড়ছেন। অভাবের কারণে লবণ পানিতে কাজ করায় অনেক নারীর অকালে গর্ভপাত হচ্ছে।’
পরিবেশ গবেষক পাভেল পার্থ বলেন বলেন, ‘আমরা গবেষণা চালিয়ে দেখেছি দীর্ঘ সময় লবণ পানিতে কাজ করায় নারীদের বিভিন্ন শারীরিক সমস্যার পাশাপাশি তাদের শাড়ি বা কাপড় বেশি নষ্ট হয়।’
বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের দাতিনাখালী এলাকার ধাত্রী শেফালী বেগম বলেন, ‘নদীতে যেসব নারী জাল টানে তাদের শরীরের বিভিন্ন স্থানে এলার্জি এবং ঘা-পাঁচড়া, প্রস্রাবে জ্বালাপোড়াসহ টিউমার হচ্ছে। অকাল গর্ভপাতের ঘটনা ঘটছে। বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছে অনেক নারী। আমাদের অঞ্চলে জরায়ু কেটে ফেলার ঘটনা ঘটছে অহরহ। অধিকাংশ নারীর গর্ভকালীন, প্রসবকালীন এবং সন্তান জন্মের পর জটিলতা দেখা দেয়। অধিক সময় লবণ পানিতে কাজ করার ফলে নবজাতক ও মায়ের বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যা তৈরি হচ্ছে।’
স্বেচ্ছাসেবী নারী উন্নয়ন সংগঠন পরিচালক শম্পা গোস্বামী বলেন, ‘এই অঞ্চলে প্রতিদিনের ব্যবহারের ৮০ ভাগ পানিই লবণাক্ত। এর কারণে এই এলাকার নারীদের নানা রকম সংক্রামণ তৈরি হয়। দুষিত ও লবণাক্ত পানি ব্যবহারের ফলে জরায়ু রোগসহ নানা রকম সমস্যা দেখা দিচ্ছে। ফলে সন্তান ধারণক্ষমতা হারিয়ে ফেলছেন অনেক নারী। আগের তুলনায় অধিকাংশ নারী এখন সন্তান জন্ম দিতে পারছেন না। অনেক চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, সন্তান হচ্ছে না। এরকম সমস্যা আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিগত কয়েক বছরের তুলনায় নদীতে লবণাক্তার পরিমাণ অনেক বেড়েছে। আগে কর্মজীবী নারীদের ৪০ শতাংশ মাছ ধরার কাজ করতেন। এলাকায় কর্মস্থানের অভাবে সেটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭০ শতাংশে। এই এলাকার ৪০ শতাংশ নারী পরিবারের প্রধান। কারণ তাদের স্বামী চলে গেছেন, না হয় মারা গেছেন। সে কারণে বাধ্য হয়ে নদীতে মাছ ধরতে হয়। অনেক সময় সুন্দরবন সংলগ্ন নদীতে রেণু ধরার ফলে নারীদের নানা রকম শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়।’
শম্পা গোস্বামী বলেন, ‘সমস্যা সমাধান করতে হলে টেকসই বেড়িবাঁধ প্রয়োজন। পানির সময় পানি ধরে সেগুলো দিয়ে থালা-বাসন মাজাসহ নানাবিধ ব্যবহারে এই সমস্যা কমানো সম্ভব। এছাড়া যেসব নারী জীবিকার তাগিদে নদীতে মাছ ধরেন। তাদের মাসিক চলাকালীন আটকানো গেলে অনেক সমস্যা কমানো সম্ভব। এছাড়া সেফটি কোনও পোশাকের মাধ্যমে নারীর স্বাস্থ্য ভালো রাখা যেতে পারে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থাকে এগিয়ে আসতে হবে।’
জেলা নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক আনিসুর রহিম বলেন, ‘বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা লবণাক্ত পানি ব্যবহারের কারণে এই অঞ্চলের নারীরা জরায়ুসহ নানা শারীরিক সমস্যায় ভুগছেন বলে দাবি করলেও, দুঃখের বিষয় সরকারিভাবে কোনও জরিপ করা হয়নি।’
তিনি আরও বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে উপকূলের নারীদের শুধু স্বাস্থ্যের ক্ষতি হচ্ছে তা নয়, তারা আর্থিকভাবেও ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। যেটা হয়তো চিকিৎসার মাধ্যমে ভালো হওয়া সম্ভব ছিল। কিন্তু কিছু ক্লিনিকের দালাল টাকার লোভে উপকূলীয় এলাকার নারীদের ভয়ভীতি দেখিয়ে জরায়ু কেটে ফেলতে বাধ্য করছে।’ এই কাজে জড়িতদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানান তিনি।
তিনি আরও বলেন, ‘উপকূলীয় এলাকায় পর্যাপ্ত পরিমাণ প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবার উপকরণ, ওষুধ ও চিকিৎসা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। কিশোরী ও নারীরা যাতে পরিবার এবং চিকিৎসকের কাছে নিরাপদে সমস্যার কথা তুলে ধরতে পারেন; এরকম সচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে।’
বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট সাতক্ষীরা উপকেন্দ্রের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. বাবুল আক্তার বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যে চ্যালেঞ্জগুলো রয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- উপকূলীয় এলাকায় দিন দিন লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়া অসময়ে বৃষ্টিপাত হচ্ছে, জলমগ্ন হয়ে পড়ছে বিস্তীর্ণ অঞ্চল। মার্চ-এপ্রিলের পর থেকে ২০-২৫ ডিএস মিটার লবণাক্ততা দেখা গেছে। এপ্রিলের আগে ১০-১২ ডিএস মিটার লবণাক্ততা পাওয়া যায়। উপকূলীয় এলাকায় ৮ ডিএস মিটারের নিচে কখন নামে না। নিয়মিত এই মাত্রার লবণাক্ততার মধ্যে মানুষ বসবাস করলে শারীরিকভাবে বিভিন্ন সমস্যা তৈরি হওয়া স্বাভাবিক।’
সাতক্ষীরার সিভিল সার্জন এই প্রতিবেদককে ‌বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত সাতক্ষীরা উপকূলের মানুষ। সুপেয় পানির অভাব ও লবণাক্ত পানিতে কাজ করার ফলে উপকূলের নারীরা বিভিন্ন শারীরিক সমস্যায় ভুগছেন। অনেক নারীর জরায়ু সমস্যা নিয়ে স্থানীয় ক্লিনিকগুলোতে গেলে তারা সেগুলো অপারেশন করে দিচ্ছে অনেকে অভিযোগ করেছেন। বিষয়টি জন-গুরুত্বপূর্ণ ও জনস্বাস্থ্যের বিষয়। শ্যামনগর উপকূলে লবণাক্ততা ও নারীর স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি নিয়ে গবেষণা প্রয়োজন। আমাদের চিকিৎসকদেরও গবেষণা কাজে আরও বেশি যুক্ত হওয়া দরকার। আমাদের পক্ষ থেকে জরিপ করার উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার। জরায়ু কাটার যে অভিযোগ তোলা হচ্ছে। এই বিষয়ে নজর রাখবো।’
১৫ অক্টোবর, আন্তর্জাতিক গ্রামীণ নারী দিবস পালিত হয়। যখন বিশ্বজুড়ে গ্রামীণ নারীর অবদানকে সম্মান জানানো হচ্ছে, তখন বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলের নারীরা লড়ছেন এক কঠিন বাস্তুসংস্থানের বিরুদ্ধে। জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার এই অঞ্চলের নারীরা একদিকে যেমন প্রাকৃতিক দুর্যোগে হারাচ্ছেন ঘরবাড়ি, তেমনি অন্যদিকে লোনা জলের অভিশাপ তাঁদের স্বাস্থ্য ও নিরাপদ মাতৃত্বকে ঠেলে দিচ্ছে চরম ঝুঁকিতে। গবেষণায় দেখা যায়, উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় (১৯৮০ সালের তুলনায় প্রায় তিনগুণ) ৩% বেশি নারী ইউটিআই (ইউরেনারী ট্রাক ইনফেকশন)ও গাইনোকলজিক্যাল সমস্যায় ভুগছেন।
​তবে এই প্রতিকূলতার মধ্যেও কেউ কেউ হার মানেন না। আজ তেমনই এক সংগ্রামী নারী, খুলনার কয়রা উপজেলার মহারাজপুর ইউনিয়নের বাঘবিধবা হালিমা খাতুনের ঘুরে দাঁড়ানোর অবিশ্বাস্য গল্প।
​জীবনের কঠিনতম সংগ্রাম:
মাত্র ১২ বছর ৩ মাস বয়সে বিয়ে, আর তার ৭ মাসের মাথায় সুন্দরবনের বনজীবী স্বামী আলমগীর বাঘের আক্রমণে নিহত। ৩ মাসের অন্তঃসত্ত্বা হালিমা তখন নিজেই যেন এক শিশু। স্বামীর মৃত্যু, অনাগত সন্তানের ভার এবং শ্বশুরবাড়িতে আশ্রয় না-পাওয়া—অবর্ণনীয় এক কষ্টের পাহাড় চাপা পড়েছিল তাঁর ওপর। জীবন ও জীবিকার তাগিদে খুলনা শহরে গিয়েও মারাত্মক সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে গ্রামে ফিরতে বাধ্য হন।
​উপজেলা সদরে একটি ছোট্ট ঘর ভাড়া করে হালিমা অন্যের বাসাবাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে মেয়েকে বড় করার স্বপ্ন দেখছিলেন। কিন্তু নিয়তির খেলা এখানেই শেষ নয়। কিছুদিনের মধ্যেই হার্টের সমস্যা ধরা পড়লে তিনি ভারী কাজ ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। মাথার ওপর যেন পুরো আকাশ ভেঙে পড়ে। স্বাবলম্বী হতে ছোটখাটো উদ্যোগ বা ব্যবসার জন্য ঋণ বা সহযোগিতার আশায় ছুটতে শুরু করেন। কিন্তু এই পথচলা ছিল অন্ধকারময়, কারণ কোনো প্রতিষ্ঠানই এই সুবিধাবঞ্চিত হালিমার পাশে দাঁড়ায়নি।
​আইসিডি’র হাত ধরে ভাগ্যের চাকা ঘোরা:
ঠিক এই চরম হতাশার মুহূর্তে হালিমার পাশে দাঁড়ায় উপকূলের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘ইনিশিয়েটিভ ফর কোস্টাল ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন’ (আইসিডি)। এই সহযোগিতা তাঁর জীবনে নিয়ে আসে নতুন ভোর। সামাজিক অবহেলা ও বঞ্চনাকে পায়ে মাড়িয়ে হালিমা ফিরে পেয়েছেন সামাজিক মর্যাদা। আজ তিনি আর ঝিয়ের কাজ করেন না। কয়রা বাজারে তাঁর ছোট চায়ের দোকান এখন আয়ের উৎস।
​বাঘবিধবা হালিমা খাতুন বলেন, “এখন প্রতিদিন চায়ের দোকান থেকে ভালো আয় হচ্ছে। ঠিকমতো দু’মুঠো ডাল-ভাত খেতে পারি এবং সঞ্চয়ও করছি। এলাকার মানুষ এখন আমাকে সম্মান করে। আমার ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প যখন মানুষের মুখে শুনি, খুব ভালো লাগে। হার্টের সমস্যার পর যখন ঝিয়ের কাজ হারালাম, তখন চরম দুশ্চিন্তা আর হতাশার মাঝে আইসিডি আমার পাশে দাঁড়িয়েছে।”
​গ্রামীণ নারীর ক্ষমতায়ন ও ভবিষ্যতের ভাবনা:
হালিমা খাতুন এখন উপকূলের অসংখ্য নারীর জন্য এক অনুপ্রেরণার নাম, একটি ‘রোল মডেল’। একসময় যাঁরা তাঁকে ঝিয়ের কাজের বিনিময়ে পচাবাসী খাবার দিতেন, আজ তাঁরাই তাঁর চায়ের দোকানের নিয়মিত ক্রেতা।
​তবে হালিমার মতো ঘুরে দাঁড়ানোর প্রবল স্পৃহা থাকা সত্ত্বেও উপকূলের অসংখ্য নারী আজ অবহেলিত ও সুবিধাবঞ্চিত। আন্তর্জাতিক গ্রামীণ নারী দিবসে তাই কেবল নারীদের অংশগ্রহণের নিশ্চয়তা নয়, বরং তাঁদের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য টেকসই পদক্ষেপ গ্রহণ করা অপরিহার্য। উপকূলীয় নারী স্বাস্থ্যের সুরক্ষার পাশাপাশি কর্মসংস্থানের স্থায়ী ব্যবস্থা করতে হবে। হালিমার মতো নারীদের খুঁজে বের করে পাশে দাঁড়াতে পারলে গ্রামীণ নারীদের ক্ষমতায়ন এবং তাঁদের অধিকার ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রকৃতির চেহারা বদলে যাচ্ছে বিশেষ করে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের। পরিবেশ সংরক্ষণে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রতি বছর ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালিত হয়। প্রতিনিয়ত উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জীবনজীবিকা এক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হচ্ছে। টিকে থাকতে হচ্ছে সংগ্রাম করে। প্রকৃতির গতিপ্রকৃতি পাল্টে যাওয়ায় জনজীবনে এসেছে পরিবর্তন। প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে টিকে থাকতে হচ্ছে তাদের। প্রাকৃতিক বৈরী প্রভাবের ফলে জীববৈচিত্র্যও ধ্বংসের মুখে পতিত হচ্ছে। সময়ের বিবর্তনে উপকূল অঞ্চলের জীবনধারায় এসেছে নানা পরিবর্তন। প্রতিটি মানুষের পেশা বদলে যাচ্ছে। বছরের পর বছর যারা মাছ বিক্রি করত তারা অন্যান্য পেশার দিকে ঝুঁকছে।
কেউ কেউ শহরের দিকে পা বাড়াচ্ছে। কৃষক আর চাষাবাদের দিকে এগোয় না। চাষাবাদের মাধ্যমে দেনাপাওনা পরিশোধ করা কষ্টকর হয়ে ওঠে। তারা পিতৃভূমি হারিয়ে ফেলছে। ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলে নিঃস্ব হয়ে পড়ছে। প্রাকৃতিক সম্পদ হ্রাস পাচ্ছে। বিশুদ্ধ খাবার পানিরও সংকট দেখা দিচ্ছে। দেশের উপকূলের ১৯ জেলায় ৪ কোটির বেশি মানুষের বসবাস; যা দেশের আয়তনের শতকরা ৩২ ভাগ। উপকূল অঞ্চলের একটি সম্প্রদায় মুন্ডা। ধারণা করা হয়, জঙ্গল পরিষ্কারের জন্য ভারত থেকে ৩০০ বছর আগে এ ভূখণ্ডে আসে তারা। বর্তমানে এদের অবস্থান খুলনা বিভাগের বেশ কয়েকটি জায়গায়। তার মধ্যে খুলনার কয়রা ও ডুমুরিয়া এবং সাতক্ষীরার দেবহাটা ও তালা উপজেলা উল্লেখযোগ্য। পেশা হিসেবে এরা বেশিরভাগই দিনমজুরি করে। অনেকে আবার সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল। সুন্দরবনের ওপর নির্ভর বলতে মূলত মধু সংগ্রহ, মাছ শিকার এসব। তবে বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য তাদের স্বাভাবিক জীবনে অনেক পরিবর্তন এসেছে।
প্রতিকূল পরিবেশে কঠোর পরিশ্রম করতে পারায় তৎকালীন শাসকরা সুন্দরবনের গাছ কেটে বসতি গড়তে মুন্ডাদের এ দেশে এনেছিল বলে জনশ্রুতি রয়েছে। তারপর আর ফিরে যাওয়া হয়নি তাদের। আজও সুন্দরবন ঘিরেই তাদের জীবনমরণ। তবে ভালো নেই তারা। সুন্দরবনসংলগ্ন সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার কালিঞ্চি, ভেটখালী, তারানিপুর, সাপখালী, ধুমঘাট, মুন্সিগঞ্জ, কাশিপুর, কচুখালী এলাকায় বসবাস করে মুন্ডারা। জেলার দেবহাটা ও তালা উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে মুন্ডাদের বসতি। সাতক্ষীরা উপকূলে মুন্ডা জনগোষ্ঠী রয়েছে আড়াই সহস্রাধিক। এ ছাড়া খুলনার কয়রা ও ডুমুরিয়া উপজেলায় তাদের বসতি রয়েছে। বাংলাদেশের বৃহত্তর ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনেও এদের বসতির চিহ্ন মেলে। কম্পাট মুন্ডা, খাঙ্গার মুন্ডা, খাড়িয়া মুন্ডা, পাথর মুন্ডা, দেরগে মুন্ডা, সাঙ্কা মুন্ডা ও মাঙ্কী মুন্ডা- বাংলাদেশে এ সাত মুন্ডা গোষ্ঠীর উল্লেখ পাওয়া যায়। সুন্দরবন এলাকার মুন্ডাদের জীবনজীবিকা বনের ওপরই নির্ভরশীল।
মুন্ডা পরিবারের ৯৫ শতাংশ ভূমিহীন। অশিক্ষা, অজ্ঞতা ও অভাব পুঁজি করে সৃষ্টি হয়েছে এ সম্প্রদায়ের কষ্টের জীবন। জমিজমা যা ছিল তা-ও হারিয়েছে নানা কারণে। বর্তমানে দিনমজুরের কাজ করে সংসার চালাতে হয় অধিকাংশকে। আগে মুন্ডাদের প্রধান জীবিকা ছিল সুন্দরবনের গাছ কাটা। বিশেষ করে গোলপাতা ও গরান কাঠ কাটা ছিল তাদের অন্যতম কাজ। বর্তমানে অনেকে আদি পেশা ছেড়ে ভিন্ন পেশায় যুক্ত। বাঙালির মতো মুন্ডারা কৃষিকাজে নিয়োজিত হলেও অধিকাংশই ভূমিহীন। তাই এ অঞ্চলের মুন্ডারা দিনমজুরির ভিত্তিতে মাছ ধরে। অন্যের জমিতে বেতনভুক কাজ, নৌকা নির্মাণ, কাঠমিস্ত্রির কাজ করে। পরিবেশের বিপর্যয়ে প্রভাব পড়েছে মুন্ডা নারীদের জীবনেও। মুন্ডা নারীরাও আজ ঘরের বাইরে নানা কাজ করে। জাল বোনা, সুন্দরবনের নদী-খালে মাছ- কাঁকড়া ধরা, মৌ সংগ্রহসহ সব ধরনের কাজে দেখা যায় মুন্ডা নারীদের। এ ছাড়া গৃহপালিত পশুর দেখভাল, কৃষি থেকে শুরু করে নানা কাজে অংশ নেয় তারা।
‘ইটভাটার কাজ কী আমরা জানতাম না, আইলার পর আমাদের চারপাশের অনেকেই এখন ইটভাটায় কাজ করি। কার ইচ্ছা করে বলুন নিজের বাড়ি ছেড়ে দূরে কাজ করতে যেতে। তাও আমাদের যেতে হয়, পেটের ক্ষুধা তো কারও কথা শোনে না। আগে কত ভালো সময় ছিল, আমরা চাষাবাদ করতাম। যদিও অন্যের জমিতে ফসল ফলাতাম তাও পরিবারের সঙ্গে থাকতে তো পারতাম। আমাদের সম্প্রদায়ের যারা এ অঞ্চলে থাকি, তাদের বেশিরভাগেরই সেই অর্থে চাষের জমি নেই। যতটুকু আছে, আমরা চেষ্টা করতাম ফসল ফলাতে। আমরা প্রতিদিন মজুরির ভিত্তিতে কাজ করি, সেটা হতে পারে কৃষিকাজ, মাছ চাষ কিংবা অন্য কোনো টুকিটাকি কাজ। আর সেজন্যই আমরা এ এলাকায় দিনমজুর হিসেবে পরিচিত।
এখনও কিন্তু আমরা দিনমজুরি করি, তবে আমাদের এখানে ফসল উৎপাদন কম কারণ কয়েক দিন পরপর ঘূর্ণিঝড়, বন্যার প্রকোপ ঘটে। আর এসব কিছু মানেই আপনারা জানেন আমাদের লোকালয়ে লবণপানির প্রবেশ। পুরো এলাকায় আপনি যেখানে যাবেন সেখানে অতিরিক্ত লবণাক্ততার জন্য জমির ফসল হয় না, এ গল্প শুনবেন। আমাদের এ অঞ্চলের চারদিকে নদীতে যখন বন্যা হয়, পাড় ভেঙে গিয়ে লবণপানি লোকালয়ে প্রবেশ করে। তবে অনেকে আবার চিংড়ি চাষের জন্য নিজেরাও নালা কেটে লবণপানি প্রবেশ করায়। এ সমস্যা না হয় আমরা কিছু একটা করে বন্ধ করতে পারি, কিন্তু দিনে দিনে নদীর পানির সঙ্গেও তো লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে, এ সমস্যা কী করে সমাধান করব, তা জানা নেই। আর সমস্যা তো একটা না, ওই আইলার পর থেকে নানান ধরনের রোগ আমাদের দেখা দিচ্ছে। চুলকানি থেকে শুরু করে পেটের রোগ, জ্বর কী নেই তার মধ্যে। আমাদের মেয়েরা আরও বেশি ধুঁকছে বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক সমস্যায়। এ অঞ্চলে শুধু আমরা মুন্ডারা না, সব মেয়ের বাচ্চা জন্মানোর সময় সিজার করতে হয়। যাতে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মও বিপদের মুখে। আর এসবের ফলস্বরূপ আমাদের ছেলেমেয়েরাও ঠিকমতো পড়াশোনা করতে পারছে না, হয়তো তারাও ভবিষ্যতে আমাদের মতো দিনমজুর হবে।’ কথাগুলো বলছিলেন শরৎ মুন্ডা, যার বাস খুলনার কয়রা উপজেলার টোপখালী। পেশায় দিনমজুর।
পোড়াকাটলা এলাকার বাসিন্দা মিতা রানী (৪৫) বলেন, ‘আমার তলপেট খুব ব্যথা করে, কোমরের অংশ অবশ হয়ে যায়, মনে হয় পেটের ভেতর থেকে কিছু একটা ছিঁড়ে নিচে নেমে আসছে। তা ছাড়া প্রচণ্ড সাদা স্রাব হয় আর চুলকায়। ঘন ঘন প্রস্রাব হয়। আর প্রসাব করতেও খুব কষ্ট হয়। গ্রামের ডাক্তাররা জরায়ু কেটে ফেলার পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু এ বয়সে অপারেশন করাতে স্বামী রাজি হননি। আপাতত চিকিৎসা নিচ্ছি। কিন্তু খুব বেশি হলে ১০-১৫ দিন ভালো থাকি।’
শেফালী বেগম (৩৮) বলেন, ‘আমার আমার বাড়ি সাতক্ষীরার দাতিনাখালী। ফলে জন্ম থেকেই নোনা পানির সঙ্গে বসবাস। তবে আগের তুলনায় যেন নোনাভাব বেড়েছে। আস্তে আস্তে নোনাভাব এত বাড়ে যে পুকুরের পানি মুখেই নিতে পারি না। অথচ তাতেই গোসলসহ সব কাজ করতে হয়। আমাদের চর্মরোগ ও জরায়ুতে সমস্যা হচ্ছে।’
ঘূর্ণিঝড়ের সতর্কসংকেত পেলেই ঘর ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ছুটতে হয় উপকূলের মানুষকে
পরিবেশকর্মীদের একাধিক গবেষণায় দেখা যায়, উপকূলীয় এলাকায় নোনা পানিতে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে নারীরা। এতে তাদের জরায়ুতে নানা রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, অনিয়মিত ঋতুস্রাব, গর্ভকালীন খিঁচুনি, গর্ভপাত এমনকি অপরিণত শিশু জন্মের হার বেড়েছে। এ ছাড়া দৈনন্দিন গৃহস্থালি কাজ, গোসল, কৃষি, গবাদি পশু পালন, চিংড়ির পোনা ধরাসহ অন্যান্য অর্থনৈতিক কাজে লবণাক্ত পানি ব্যবহারের কারণে নারীরা লিউকোরিয়াসহ সাধারণ পানিবাহিত বিভিন্ন রোগ ও চর্মরোগে আক্রান্ত হচ্ছে। স্থানীয় বাসিন্দা, স্বাস্থ্যকর্মী এবং বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত সাতক্ষীরাসহ উপকূলীয় অঞ্চলের অনেক নারীকে অল্প বয়সে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে জরায়ু অপসারণ করতে হচ্ছে।
তারা বলছেন, বাংলাদেশের এ অংশে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়া এবং সে লবণাক্ত পানির অত্যধিক সংস্পর্শের ফলে এ সমস্যা বেড়েই চলেছে। শারীরিক নানা অসুস্থতার কারণে বাড়ছে বিবাহবিচ্ছেদ। আবার কম বয়সে মুখে কালো ছোপ পড়া এবং শরীরের রঙ কালো হয়ে যাওয়ায় বাল্যবিবাহ বেড়েছে। মেয়েকে বিয়ে দিয়ে বোঝামুক্ত হতে চান অভিভাবকরা, সাতক্ষীরার অনেক গ্রামেই অবিবাহিত কোনো কিশোরী নেই বললে চলে।
করোনাকালে স্কুল বন্ধ থাকার সময় বাড়ির কাজ আর খেলাধুলা করেই কাটছিল হাওয়ালভাঙ্গি আটুলিয়ার মনিরা খাতুনের (১৩)। হঠাৎ এক সন্ধ্যায় আত্মীয়ের বাড়িতে নেওয়া হয়। সে জানতে পারে একটু পরই তার বিয়ে। এ উপকূলে তার মতো বাল্যবিবাহের শিকার আছিয়া খাতুন (১৭), কারিশমা (১৬), সোনিয়া খাতুন (১৫), লাকি আক্তার (১৭) ও তানিয়া (১৬)।
বাল্যবিবাহের এ চিত্র বাংলাদেশের দুর্যোগপ্রবণ উপকূলীয় অঞ্চলে বিশেষ করে দক্ষিণ-পশ্চিম খুলনায় খুবই সাধারণ। দারিদ্র্য এবং নিরাপত্তাহীনতার কারণে বাল্যবিবাহের সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। করোনা মহামারির পর তা বহুগুণে বেড়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলের অন্যতম সাতক্ষীরায় বাল্যবিয়ে প্রায় ঘরে ঘরে। তা ছাড়া লবণাক্ততার কারণে কৃষিজমি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় পুরুষের বড় একটা অংশকে পরিবার ছেড়ে শহরে কাজ করতে যেতে হয়। যাদের সে সামর্থ্য নেই, তারা গ্রামে অলস সময় কাটায়।
২০১৪ সালে পরিচালিত বিশ্বব্যাংকের সমীক্ষা অনুসারে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ২০৫০ সালের মধ্যে নদী ও ভূগর্ভস্থ পানির লবণাক্ততা নাটকীয়ভাবে বেড়ে যাবে, ।

জন্মভূমি ডেস্ক December 21, 2025
Share this Article
Facebook Twitter Whatsapp Whatsapp LinkedIn Email Copy Link Print
Previous Article শ্যামনগরে হত্যা মামলায় পাঁচ নারীসহ গ্রেফতার ৯
Next Article মোঘল সাম্রাজ্যে জনজীবন কেমন ছিল

দিনপঞ্জি

December 2025
S M T W T F S
 123456
78910111213
14151617181920
21222324252627
28293031  
« Nov    
- Advertisement -
Ad imageAd image
আরো পড়ুন
সাতক্ষীরা

সাতক্ষীরায় আওয়ামী লীগের ২ নেতা গ্রেফতার

By জন্মভূমি ডেস্ক 3 hours ago
সাতক্ষীরা

মোঘল সাম্রাজ্যে জনজীবন কেমন ছিল

By জন্মভূমি ডেস্ক 4 hours ago
সাতক্ষীরা

লোনা পানিতে কাজ: স্বাস্থ্যঝুঁকিতে উপকূলের নারীরা

By জন্মভূমি ডেস্ক 17 hours ago

এ সম্পর্কিত আরও খবর

সাতক্ষীরা

সাতক্ষীরায় আওয়ামী লীগের ২ নেতা গ্রেফতার

By জন্মভূমি ডেস্ক 3 hours ago
সাতক্ষীরা

মোঘল সাম্রাজ্যে জনজীবন কেমন ছিল

By জন্মভূমি ডেস্ক 4 hours ago
সাতক্ষীরা

শ্যামনগরে হত্যা মামলায় পাঁচ নারীসহ গ্রেফতার ৯

By জন্মভূমি ডেস্ক 20 hours ago

প্রতিষ্ঠাতা: আক্তার জাহান রুমা

প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক: হুমায়ুন কবীর বালু

প্রকাশনার ৫২ বছর

দৈনিক জন্মভূমি

পাঠকের চাহিদা পূরণের অঙ্গীকার

প্রতিষ্ঠাতা: আক্তার জাহান রুমা

প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক: হুমায়ুন কবীর বালু

রেজি: কেএন ৭৫

প্রধান সম্পাদক: লে. কমান্ডার (অব.) রাশেদ ইকবাল, প্রকাশক: আসিফ কবীর কর্তৃক জন্মভূমি প্রকাশনী লি: ১১০/২,সাংবাদিক হুমায়ুন কবীর বালু সড়ক, খুলনা থেকে মূদ্রিত ও প্রকাশিত

Developed By Proxima Infotech and Ali Abrar

Removed from reading list

Undo
Welcome Back!

Sign in to your account

Lost your password?