
সাতক্ষীরা প্রতিনিধি : জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে সাতক্ষীরা-২ আসনে দেখা দিয়েছে ভিন্ন মাত্রার রাজনৈতিক উত্তাপ। দীর্ঘদিন জোট রাজনীতির প্রভাবে নিয়ন্ত্রিত এই আসনে এবার আর পুরোনো সমীকরণ নেই। একসময় যারা একই মঞ্চে দাঁড়িয়ে ভোট চেয়েছিলেন, সেই বিএনপি ও জামায়াত এখন একে অন্যের প্রধান প্রতিপক্ষ। এ ছাড়া জাতীয় পার্টির নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্তে আসনটি ত্রিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতার কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। যদিও বিএনপি থেকে মনোনয়নবঞ্চিত এক নেতা কিছুদিন আগেও এই আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। গতকাল সোমবার তিনি এমন সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন।
সাতক্ষীরা সদর উপজেলার সঙ্গে এবার দেবহাটা উপজেলার সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে সাতক্ষীরা-২ আসন। আসনটি দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের রাজনীতিতে ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। স্বাধীনতার পর অনুষ্ঠিত ১২টি সংসদ নির্বাচনের মধ্যে জামায়াত মনোনীত প্রার্থীরা এই আসনে চারবার জয় পেয়েছিলেন। অতীতে বিএনপি-জামায়াত জোট থাকায় বিএনপির শক্তিশালী ভোটব্যাংক জামায়াতের প্রার্থীর জয়ের ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। একইভাবে মহাজোটের সময় আওয়ামী লীগের সমর্থন জাতীয় পার্টির প্রার্থীদের জন্য সুবিধাজনক অবস্থান তৈরি করেছিল।
তবে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে সাতক্ষীরা-২ আসনের সমীকরণও বদলে যায়। জোট রাজনীতির সেই পুরোনো বন্ধন ভেঙে গিয়ে মাঠে নামে আলাদা আলাদা শক্তি। ফলে একসময় ‘জামায়াতের আঁতুড়ঘর’ হিসেবে পরিচিত এই জনপদে এখন কোনো পক্ষই নিশ্চিতভাবে সুবিধাজনক অবস্থানে নেই। তবে জামায়াতের শক্তিশালী সাংগঠনিক কার্যক্রম এবং জাতীয় পার্টির পরিচিতি উভয় দলকে কিছুটা অবস্থান তৈরি করে দিয়েছে। স্বাধীনতার পর প্রথমবার সাতক্ষীরা-২ আসনে বিএনপির জন্য বড় সুযোগ তৈরি হলেও স্বতন্ত্র প্রার্থীর চ্যালেঞ্জ দলটির সামনে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। যদিও পরে সেই সমস্যার সমাধান হয়।
বিএনপি থেকে এই আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন দলটির জেলা শাখার সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক আব্দুর রউফ। সদর উপজেলার আলিপুর ইউনিয়নের সাতবারের চেয়ারম্যান তিনি। অন্যদিকে জামায়াতের মনোনয়ন পেয়েছেন দলটির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সেক্রেটারি ও সাবেক জেলা আমির আব্দুল খালেক। দলীয় সূত্রে বলা হচ্ছে, সাতক্ষীরার চারটি আসনের মধ্যে সাতক্ষীরা-২ আসনেই জামায়াতের সাংগঠনিক ভিত্তি সবচেয়ে শক্তিশালী।
অন্যদিকে জাতীয় পার্টির মনোনয়নপ্রত্যাশী দলটির জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক আশরাফুজ্জামান আশু। তিনি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসন থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন। বর্তমানে তিনি তার আগের কর্মকাণ্ড ও সংসদীয় অভিজ্ঞতার ওপর ভরসা রেখে মাঠে নেমেছেন। দলটির পক্ষে আসনটিতে তিনি একক মনোনয়নপ্রত্যাশী।
আসনটিতে বিভিন্ন দলের প্রচারেও ভিন্নতা দেখা যাচ্ছে। বিএনপি তৃণমূল থেকে জেলা পর্যন্ত প্রতিটি ইউনিটকে সুসংগঠিত ও সক্রিয় করেছে, ওয়ার্ড কমিটিগুলো কার্যকর হয়েছে। এ ছাড়া সহযোগী সংগঠনগুলোও পূর্ণ উদ্যমে মাঠে কাজ করছে। জামায়াত তাদের ঐতিহ্যবাহী ভোটব্যাংক ধরে রাখতে ধর্মীয় ও সামাজিক নেটওয়ার্ক ব্যবহার করছে। জাতীয় পার্টির প্রার্থী আনুষ্ঠানিকভাবে এখনও মাঠে না নামলেও ইউনিয়ন পর্যায়ে নেতা-কর্মীদের মাধ্যমে ভোটারদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন।
সাতক্ষীরা পৌরসভার জামায়াত অফিস এলাকার বাসিন্দা মুকুল হোসেন বলেন, ‘এবারের নির্বাচনে অনেক দলই মাঠে আছে। আমরা চাই ভোট শান্তিপূর্ণ হোক। এবার দল নয়, প্রার্থীর গ্রহণযোগ্যতা দেখে সিদ্ধান্ত নেব।’ দেবহাটার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী খায়রুল ইসলাম বলেন, ‘নদীভাঙন আর লবণাক্ততার কারণে ব্যবসা ও কৃষি দুটিই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যিনি এগুলোর বাস্তব সমাধান দেবেন, তাকেই আমরা ভোট দেব।’ নতুন ভোটার সাদিয়া পারভীন বলেন, ‘শিক্ষার মান উন্নয়ন, নিরাপদ পানি, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও তরুণদের কর্মসংস্থান—এই বিষয়গুলো আমাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।’
প্রার্থীরাও নিজেদের পরিকল্পনা বিস্তারিতভাবে তুলে ধরছেন। সাতক্ষীরা-২ আসনের বিএনপির প্রার্থী আব্দুর রউফ বলেন, ‘আমি দীর্ঘদিন জনপ্রতিনিধি হিসেবে মানুষের সঙ্গে কাজ করেছি। এবারের নির্বাচনে আমাদের লক্ষ্য শুধু জয় নয়— বরং মানুষের আস্থা পুনর্গঠন করা। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে অবকাঠামোগত উন্নয়ন, ইউনিয়ন পর্যায়ে দ্রুত সেবা নিশ্চিত করা এবং যুবকদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করাই আমার প্রধান অগ্রাধিকার।’
জামায়াত প্রার্থী আব্দুল খালেক বলেন, ‘এই এলাকার মানুষ আমাদের দীর্ঘদিন ধরে চেনেন। আমরা শুধু নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনীতি করি না, সংকটে মানুষের পাশে থাকি।’ তিনি বলেন, ‘আমরা ঘরে ঘরে যাচ্ছি, মানুষের সমস্যার কথা শুনছি। ভোটারদের বিচার করতে হবে— কে শুধুই প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে আর কে বাস্তবায়নের সক্ষমতা রাখে।’
জাতীয় পার্টির মনোনয়নপ্রত্যাশী আশরাফুজ্জামান আশু বলেন, ‘আমি আগেও এই এলাকার মানুষের প্রতিনিধিত্ব করেছি। অবকাঠামো উন্নয়ন, যোগাযোগব্যবস্থা ও সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমে আমার ভূমিকা মানুষ জানে। সেই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই ভোটাররা সিদ্ধান্ত নেবেন বলে আমি বিশ্বাস করি। এবারও ধারাবাহিক উন্নয়ন নিশ্চিত করাই আমার লক্ষ্য।’
অন্যদিকে সাতক্ষীরা জেলা বিএনপির সাবেক সদস্যসচিব আব্দুল আলীম এর আগে ফেসবুকে লিখেছিলেন, আসন্ন সংসদ নির্বাচনে তিনি বিএনপির চূড়ান্ত মনোনয়নপ্রত্যাশী। গত ২০ ডিসেম্বর রাতে তিনি সাংবাদিকদের জানান, শেষ মুহূর্তে দলীয় মনোনয়ন না পেলে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করার কথা ভাবছেন। তবে গতকাল সোমবার সন্ধ্যা সোয়া ৭টায় ফেসবুকে দেওয়া পোস্টে আব্দুল আলীম বলেন, ‘সম্প্রতি কিছু স্থানীয় নিউজ পোর্টাল ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এমনভাবে প্রকাশিত হচ্ছে যে, আমি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করব। যেটি বিভ্রান্তিকর। চূড়ান্ত মনোনয়ন প্রকাশের আগে স্বতন্ত্র নির্বাচন করার কোনো সুযোগ নেই। মনোনয়ন ঘোষণার পর দলীয় শৃঙ্খলা ও রাজনৈতিক বাস্তবতা বিবেচনায় পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’

