
সিরাজুল ইসলাম শ্যামনগর : বিপন্নপ্রায় বক পাখির ওড়াউড়ি প্রকৃতির নিসর্গের এই দৃশ্য এখন চোখে পড়ে কালেভদ্রে। ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, তিস্তা, ধরলা নদীর পাড়ে বক পাখিদের ছিল নিরাপদ অভয়ারণ্য। শীত বসন্তে বক পাখিরা কখনো দলবেঁধে উড়ে কখনো মাছ শিকারে ব্যস্ত থেকে নদী ও বিলকে সৌন্দর্যে ভরে দিত। ভাওয়াইয়া গানে যে ধরলা নদীতে ফাঁদের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে সেই ধরলা বককুলের স্মৃতির নদী। শিকারিদের থাবা এখন সব নদী বিল ও চরে। বককে ভ্রান্তিতে ফেলতে নানা ধরনের ফাঁদ এঁটে অপেক্ষায় থাকে। ফাঁদে ধরা না পড়তে দিশেহারা হয়ে বককুল আশ্রয় খুঁজে বেড়াচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের নিজ ভুবনের আপন পাখি বক। বকের এখন ক্রান্তিকাল। বকেরা আশ্রয় নেয় গাছের শাখায়, কাশবন, বাঁশবাগান বড় বৃক্ষে। এখন কাশ বনের কাঠি ব্যবহার হচ্ছে গৃহস্থালি উপকরন বানানোর কাজে। বাঁশ বাগান কেটে সাফ। নগরায়নের অসামঞ্জস্য থাবায় গাছেরাও উধাও হয়ে যাচ্ছে। এর ওপর বৈশি^ক উষ্ণতা বেড়ে জলবায়ুর পরিবর্তনের ধারায় মনুষ্যকুলের সঙ্গে বককূলেরও ত্রাহীমধুসূদন অবস্থা। বকেরা এখন যায় কোথায়। নিকট অতীতে নদী বিলে ঝিলে বকদের সারি মন ভরিয়ে দিত। মনে হতো বক পাখিদের মিলনমেলা। উড়াউড়ি করে শাখায় বসে ক্লান্তি কাটিয়ে ফের উড়াল দিত। শীত মৌসুমে চরে অতিথি পাখিদের পাশপাশি থাকে দেশী কানি বক, গো বক, মঝলা বগা, ধূপানি বক। চলনবিল, হাকালুকির হাওড়, মনপুরার চর, পাতারচর, সোনাদিয়ার চর এবং বড় নদ নদীর চরে বকেরা অতিথি পাখিদের সঙ্গ দেয়।ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন নেচার (আইইউসিএন) জানায়, আর্ডেইডি গোত্রের মিঠা পানির মৎস্যভোজী জলচর প্রাণী বক। পৃথিবীতে বক পাখির প্রজাতি অন্তত ৬৪। বাংলাদেশে ১১ প্রজাতির বকের মধ্যে চারটি প্রজাতি বিপন্নপ্রায়। এগুলো বাঘা বক, রঙ্গিলা বক, নিশী বক ও কোদালি বক। নদী ও বিলের তীরে যাদের বাস তারা রাতে নিশি বকের ওয়াক ওয়াক ডাক শোনে। দেশে কানি বক সবচেয়ে বেশি পরিচিত। এই বককে নিয়ে ছড়া ‘ওই দেখা যায় তাল গাছ ওই আমাদের গাঁ, ওইখানেতে বাস করে কানি বকের ছা।’। সাদা ধবধবে বকের পাশাপাশি গলায় ছাই রঙের, কিছুটা ধূসর বর্ণের বক আছে।
তীক্ষ ঠোঁট, লম্বা গলা, লম্বা পা, মাথায় ঝুলে থাকা সোনালি ঝুঁটি এমন ধরন সকল বকের মধ্যেই আছে। গ্রামে কখনো বকের পরিচিতি দেওয়া হয় বগলা ও বগা নামে। বকের চোখের জ্যোতি বেশি। জলের গভীরে ও ডাঙায় দূরের জিনিস দেখতে পায়। কোনো কিছু হারিয়ে খুঁজে পাওয়ার পর উপমায় বলা হয়-বকের চোখ। বড় আকৃতির কিছু বক বিশে^র দেশে দেশে পরিচিতি পেয়েছে কিং স্টর্ক (সারস বা বড় বক) নামে। ধবধবে সাদার উপমায় বলা হয়-বকের পালকের মতো সাদা। সুন্দর পালকের এই বকের বাস বাংলাদেশে এবং নিরক্ষীয় ও ক্রান্তীয় অঞ্চলে। ভাওয়াইয়া স¤্রাট আব্বাস উদ্দিনের কণ্ঠে ধরলা নদীর পাড়ের বককে নিয়ে সেই করুণ গান ‘ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে রে’ মতোই অবস্থা আমাদের দেশী পাখি বকের। খাবার সংগ্রহ করতে গিয়ে নিজেই মানুষের খাবার টেবিলে যাচ্ছে। অতি নিরীহ এই বক পাখির কাছে মানুষের শেখার আছে অনেক। বককূলের যে কোনো প্রজাতির বিপদে উড়ে এসে উদ্ধারে ঝাঁপিয়ে পড়ে এরা। এই দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়েছে চতুর (বুদ্ধিমান নয়) মানুষ। ঝাউগাছের মতো এক ধরনের ফাঁদ বানিয়ে তার ওপর একটি বন্দি বক রেখে দেয়। উড়ে আসা বক বন্দি বককে উদ্ধার করতে এসে চতুর শিকারির কৌশলে নিজেই বন্দি হয়। ছেলে বেলার বাঘ ও বকের সেই গল্পে বক লম্বা ঠোঁটে বাঘের গলায় ফোটা হাড় বের করে দেয়। পরে বাঘ প্রাণ নেয় উপকারী বকের। নিরীহ বকের গল্প নানাভাবে উঠে এসেছে। বক বিপন্ন হওয়ার কয়েকটি কারনের মধ্যে অন্যতম কারনগুলো হলো : জলাভূমি ব্যবহারে অসচেতনতা। রাসায়নিক সার প্রয়োগের মাত্রা বেশি। দেশী বৃক্ষ রোপন কম ও গাছ কেটে ফেলা। বকের মাংস খাওয়ার প্রবনতা বেড়ে যাওয়া। উত্তরাঞ্চলের নদ নদী, খাল বিল,পূর্বাঞ্চলের হাওড়, দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের এলাকা এবং সুন্দরবনে বকের সংখ্যা কমেছে। ছয় ঋতু বৈচিত্রের এই দেশে বক পাখিরা স্বাচ্ছন্দ্যে বাস করে। সেই হিসেবে বক বাংলাদেশের আপন ভভুবনের পাখি। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায় বাংলাদেশ থেকে বক পাখির প্যাটেন্ট কেড়ে নেওয়ার প্রবণতা শুরু হয়েছে। বকেরা কি এখন নিজভূমে পরবাসী হয়ে থাকবে ! শিকারির ভয়ে চেনা পথ ছেড়ে উড়াল দিয়ে খুঁজে ফিরবে নিরাপদ কোন অভয়ারণ্য।

