সিনহা রাশেদ নিহতের ঘটনায় কক্সবাজারের পুলিশ সুপার বিএম মাসুদ, টেকনাফের বরখাস্ত ওসি প্রদীপ কুমার, ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলী, অভিনেতা ইলিয়াস কোবরাসহ মোট আটজনের ব্যাংক হিসাব স্থগিত করেছে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট।
সোমবার বিএফআইইউ থেকে দেশে কার্যরত সব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে একটি চিঠি পাঠিয়ে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। একইসঙ্গে চিঠি ইস্যু করার দিন থেকে তিন দিনের মধ্যে স্থগিত করা হিসাবগুলোর নাম, নম্বর, স্থিতি এ সংক্রান্ত তথ্যাদি (হিসাব খোলার ফরম, কেওয়াইসি প্রোফাইল ফরম, হালনাগাদ লেনদেনের বিবরণী) পাঠাতে বলা হয়েছে।
চিঠিতে যে ৮ জনের ব্যাংক হিসাব স্থগিত ও তথ্য চাওয়া হয়েছে, তাদের মধ্যে এসপি মাসুদ ও ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ছাড়াও বাংলা সিনেমার অভিনেতা ইলিয়াস কোবরা, চুমকী কারান, প্রতীম কুমার দাশ, প্রতুশ কুমার দাশ, লিয়াকত আলী ও দিলীপের নাম রয়েছে। চিঠিতে প্রত্যেকের নামের পাশে জন্ম তারিখ ও জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর উল্লেখ করা হয়েছে।
বিএফআইইউয়ের প্রধান বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর আবু হেনা মো. রাজী হাসান চিঠির বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে মঙ্গলবার দুপুরে বলেন, বিএফআইইউর বিধি অনুযায়ী সরকারি কোনো সংস্থা বা গণমাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে সেই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের ব্যাপারে তথ্যের জন্য ইউনিট তাদের ব্যাংক হিসাব তলব, স্থগিত করাসহ অন্য যে কোনো তথ্য চাইতে পারে। বরাবরই এমনটি করে আসছি আমরা।
উল্লেখ্য, গত ৩১ জুলাই ঈদুল আজহার আগের রাত সাড়ে ১০টার দিকে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান। ঘটনার পর পুলিশ বাদী হয়ে টেকনাফ থানায় দুটি মামলা করে। আর রামু থানায় একটি মামলা করে। পরে ৫ আগস্ট কক্সবাজার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হত্যা মামলা করেন সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানের বড় বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস। এতে ৯ জনকে আসামি করা হয়।
আসামিরা হলেন-টেকনাফ থানার বরখাস্ত হওয়া ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশ, টেকনাফের বাহারছড়া শামলাপুর পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের প্রত্যাহার হওয়া পরিদর্শক লিয়াকত আলী, উপপরিদর্শক (এসআই) নন্দদুলাল রক্ষিত, সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) লিটন মিয়া, পুলিশ কনস্টেবল সাফানুর রহমান, কামাল হোসেন, আবদুল্লাহ আল মামুন, মো. মোস্তফা ও এসআই টুটুল। এদের মধ্যে আসামি মোস্তফা ও টুটুল পলাতক। এর মধ্যে রিমান্ড মঞ্জুর হওয়া পুলিশের চার সদস্য এবং এ ঘটনায় পুলিশের দায়ের করা মামলার তিন সাক্ষীকে গত শুক্রবার থেকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছে র্যাব। যাদের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে তারা হলেন-সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) লিটন মিয়া, কনস্টেবল সাফানুর রহমান, কামাল হোসেন, আবদুল্লাহ আল মামুন, পুলিশের দায়ের করা মামলার সাক্ষী মো. নুরুল আমিন, মো. নেজামুদ্দিন ও মোহাম্মদ আয়াছ।
\ এপিবিএনের ৩ সদস্য গ্রেফতার \
অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যা মামলায় আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) ৩ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে র্যাব।
মঙ্গলবার সকালে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক আশিক বিল্লাহ গণমাধ্যমকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
গ্রেফতারকৃতরা হলেন-এপিবিএনের সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) শাহজাহান, কনস্টেবল রাজীব ও আব্দুল্লাহ। ঘটনার দিন তারা এপিবিএনের চেকপোস্টে দায়িত্ব পালন করেন। এই নিয়ে এ ঘটনায় ১০ জনকে গ্রেফতার করা হলো।
প্রসঙ্গত, গত ৩১ জুলাই টেকনাফের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ। এ ঘটনায় তার বোন বাদী হয়ে ৯ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন।
\ ওসি প্রদীপসহ ৩ পুলিশ র্যাবের রিমান্ডে \
অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যা মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য টেকনাফ থানার বরখাস্ত ওসি প্রদীপ কুমার দাশসহ তিন পুলিশ সদস্যকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডে নিয়েছে র্যাব। মঙ্গলবার সকালে তাদের রিমান্ডে নেয় পুলিশের এই এলিট ফোর্সটি।
যে তিনজনকে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে তারা হলেন- টেকনাফ থানার বরখাস্ত হওয়া ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, পরিদর্শক লিয়াকত আলী ও উপ-পরিদর্শক (এসআই) নন্দ দুলাল রক্ষিত।
গত সোমবার র্যাবের গণমাধ্যম শাখার প্রধান লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ তিনজনকে রিমান্ডে নেয়ার কথা জানিয়েছিলেন। প্রেস ব্রিফিংয়ে র্যাবের এই কর্মকর্তা বলেছিলেন, ইতোমধ্যে র্যাবের তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের চার সদস্য ও সন্দেহভাজন তিন আসামিকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। আমরা তাদের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছি। দক্ষ ও পেশাদারির মাধ্যমে এই মামলা তদন্ত করছে র্যাব। তদন্ত শেষ হলে পুরো বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে।
এছাড়া গতকাল সিনহা হত্যা মামলায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি প্রদীপ কুমার দাশসহ তিন আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। অন্য চার পুলিশ সদস্য ও তিন সাক্ষীদের আগেই জিজ্ঞাসাবাদ শেষ করেছিল তদন্ত কমিটি।
\ ওসি প্রদীপের বিরুদ্ধে আরো একটি হত্যা মামলা \
সাময়িক বরখাস্ত হওয়া টেকনাফ থানার সাবেক অফিসার ইনচার্জ (ওসি) প্রদীপসহ ২৮ জনের বিরুদ্ধে কক্সবাজার সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আরও একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে।
মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে মামলাটি দায়ের করেন টেকনাফ উপজেলার হ্নীলা ইউনিয়নের মৌলভী বাজার এলাকার সুলতান আহমদের স্ত্রী গোল চেহের।
কক্সবাজার সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আমলী আদালত-৩ (টেকনাফ) এর বিচারক মো. হেলাল উদ্দিন মামলাটি আমলে নিয়ে এএসপি সমমানের পুলিশ কর্মকর্তার মাধ্যমে তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য সিআইডিকে নির্দেশ দিয়েছেন।
বাদী পক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট ইনসাফুর রহমান জানিয়েছেন, গত ৪ জুলাই সকালে বাদী গোল চেহেরের দুই সন্তান সাদ্দাম হোসেন ও মো. জাহেদ হোসেনকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। পরে তাদেরকে ছেড়ে দেবে বলে ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। অন্যথায় তাদের লাশ প্রদান করা হবে বলে হুমকি দেন টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মশিউর রহমান।
তিনি বলেন, পরে পৃথকভাবে পাঁচ লাখ টাকা প্রদান করা হয়। কিন্তু তাদের ছেড়ে না দিয়ে জাহেদকে মিথ্যা অভিযোগে আদালতে সোপর্দ করলেও সাদ্দামকে গুলি করে হত্যা করে।
ইনসাফুর বলেন, এ মর্মান্তিক ঘটনায় মশিউর রহমানকে এক নম্বর ও প্রদীপ কুমার দাশকে দুই নম্বর আসামি করে ২৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে।