সিরাজুল ইসলাম, শ্যামনগর : ‘মাথায় চেরণ দিবি নে। চুলে খোঁপা দিয়ে থাকবি। তেল দিবিনে মাথায়। ঘরে লেপন দিবিনে। পর পুরুষের সঙ্গে কথা কওয়া বারণ’। ‘সবই তো মেনে ছিলাম। তাও স্বামীডারে বাঘে ধরে নিয়ে গেল। আর এখন আমারে রাক্ষুসী বানিয়ে শাশুড়ি তাড়িয়ে দিল’। সাতক্ষীরার সুন্দরবন উপকূলের গ্রামের বাঘবিধবা শরবানু খাতুন এভাবেই জানালেন তার করুণ আর্তি।
সাতক্ষীরার সুন্দরবন উপকূলের গ্রামগুলোতে বাঘবিধবাদের এমন করুণ আর্তি মানুষের হৃদয়কে নাড়া দেয়। স্বামী মারা যাওয়ার পরপরই শাশুড়ি ননদ বউয়ের দোষ খোঁজে। কোনো উত্তর দিলে ঝাঁটাপেটা করে।
সাতক্ষীরার শ্যামনগরের মুন্সীগঞ্জের ঘেন্না দাসীর জীবনও কাটছে এমন দুঃসময়ের মধ্য দিয়ে। ঘেন্না দাসীর স্বামীকে বাঘে খেয়েছিল। কিছুদিন পর দেবরের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল ঘেন্নার। বাঘ তাকেও ছাড়েনি। দ্বিতীয় স্বামীকেও বাঘ খেয়ে ফেলায় ঘেন্না দাসী দ্বিতীয়বার বিধবা হন। ঘেন্নার একমাত্র ছেলে বনে মাছ কাঁকড়া ধরত। মানুষখেকো বাঘ তাকেও ধরে নিয়ে যায় কিছুদিনের মাথায়। তার লাশও খুঁজে পায়নি ঘেন্না দাসী।
সুন্দরবন উপকূলের গ্রামগুলোতে এমনিভাবেই গড়ে উঠেছে বাঘবিধবা পল্লী। এসব পল্লীতে বিধবা নারীদের করুণ আর্তি ভাসে বাতাসে। নানা সময়ে তাদের সহায়তা দেওয়ার কথা বলা হলেও বাস্তবে তারা কেউই পুনর্বাসিত হননি। গাবুরা ইউনিয়নের সোরা গ্রামের বাঘবিধবা শরবানু খাতুনের মতে, বনে কাঠ কাটতে গেলে তার স্বামী রফিকুল ইসলামকে বাঘে খেয়েছিল। তার দেহ খুঁজে পাওয়া যায়নি। শাশুড়ি তাকে রাক্ষুসী বলে তাড়িয়ে দিয়েছিল স্বামীর ভিটা থেকে। বাঘবিধবা শরবানু এখন একজন দিন মজুর। শরবানু জলবায়ু সম্মেলন ও কার্বনদূষণ কমানোর দাবিতে বিশ্বের পাঁচটি দেশ সফর করে বাংলাদেশের পক্ষে জলবায়ু ক্ষতিপূরণ দাবিতে জোরালো স্লোগান দিয়েছেন। শরবানু ও অন্যান্য বাঘবিধবারা ‘বাঘ বিধবা সমিতি’ গড়ে নিজেদের সংগঠিত করার চেষ্টা করছেন। শ্যামনগরের মুন্সীগঞ্জ, বুড়িগোয়ালিনী, গাবুরা, পদ্মপুকুর, কৈখালি, রমজাননগরসহ বেশ কয়েকটি ইউনিয়নে প্রায় ১ হাজার ১৫০টি বাঘবিধবা পরিবার রয়েছে। স্বামীহারা এসব নারীর জীবনে নেমে এসেছে চরম বিভীষিকা।
মানুষখেকো বাঘের শিকার উপকূলের রনজিত, রজব আলি, কওসার মোড়ল, ইসমাইল, কালাম তরফদার, মাজেদ গাজী, মজিদ শেখ, শাহবাজ গাইন, সাত্তার মোড়ল, আবদুল মজিদ, মুজিবর, আজিবর ও আবদার আলির বিধবা স্ত্রীদের জীবন এখন কাটে দুঃখ কষ্টে। তাদের হেঁসেলে চুলো জ্বলে না। শীতে গরম কাপড় জোটে না। ওদের কেউ মাটি শ্রমিক। কেউ ইটভাটা শ্রমিক। কেউ নদীতে পোনা ধরে। কাঁকড়া ধরে। এভাবেই চলে তাদের জীবন। তাদের জীবনে আসে না ঈদ পূজা পার্বণ। অভাবের কারণে ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া না করে মার সঙ্গে কাজ করে। বেঁচে থাকার নিরন্তর লড়াইয়ের শামিল তারাও। এরপরও পেটের জ্বালায় তারা জীবন বাজি রেখে বনে যায়। কাঁকড়া ধরে, পোনা ধরে, ঝিনুক কুড়ায়।
বাঘের পেটে গেছে কওসার আলি, রমেশ, আইউব আলি, করিম, শাহনেওয়াজ, জহুরউদ্দিন, শহর আলি, আমজাদ, সোহরাব হোসেনসহ কত মানুষ। সম্প্রতি দক্ষিণ তালপট্টিতে বন বিভাগের পাস নিয়ে মাছ ধরার সময় একই স্থানে পৃথক ঘটনায় দুই বছরের ব্যবধানে বাবা ও ছেলেকে বাঘে খেয়েছে। তাদের বিধবা স্ত্রীরা এখন সামাজিক ও পারিবারিক নির্যাতনের মুখে অসহায় অবস্থায় রয়েছেন। কেউ আশ্রয় পেয়েছে বাবা ভাইয়ের বাড়িতে। কেউ হয়েছে ছিন্নমূল।
ভামিয়া গ্রামের বাঘবিধবা বিলকিস খাতুনের স্বামী সামাদ গাজীকে বাঘে খেয়েছিল ২০০৫ সালের ১৭ মে। নীলডুমুর গ্রামের বাঘবিধবা জাহানারা খাতুনের স্বামী মোকসেদ আলী বাঘের পেটে যায় ১৯৯০ সালের ১০ অক্টোবর। সরদার বাড়ির বাঘবিধবা জহুরা খাতুনের স্বামী আব্দুল মজিদ বাঘের কবলে প্রাণ হারান ২০০৯ সালের ১ ফেব্রুয়ারি। ২০০৮ সালের ১৬ অক্টোবর মনু মোল্লাকে বাঘে খেলে তার স্ত্রী রাশিদা খাতুন বিধবা হন। মনু মোল্লাকে কয়েকবছর আগে একবার বাঘ ধরে নিয়ে গেলে তিনি গুরুতর আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেন। দ্বিতীয় দফায় বনে গেলে তিনি আর রক্ষা পাননি। ঢালীপাড়ার বাঘবিধবা মঞ্জিলা খাতুনের স্বামী আবু হাসানকে বাঘে খেয়েছিল। এছাড়া কাজীবাড়ির বাঘবিধবা পারভিনের স্বামী জিয়াউলকে বাঘে নিয়ে যায় ২০১১ সালের ১৮ মার্চ। তাদের পরিবারগুলো এখন অসহায় অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে।
বাঘবিধবাদের নিয়ে কেউ আলাদা করে ভাবছে না। কেবল সুযোগ এলে জনপ্রতিনিধিরা তাদের হাতে কিছু সহায়তা দেন। বন বিভাগের পাস পারমিট নিয়ে বনে যাওয়া জেলে মাঝি মৌয়াল, বাওয়ালি ও কাঠুরেদের সরকারি নিয়ম অনুযায়ী সাহায্য পাওয়ার কথা থাকলেও বাস্তবে তাও পাননি এসব বাঘবিধবা।