সিরাজুল ইসলাম (শ্যামনগর), সাতক্ষীরা : ১৯৭২ সাল পর্যন্ত সুন্দরবনে বাঘকে উপদ্রব বলে গণ্য করা হত। তখন অনুমোদনপ্রাপ্ত যে কোন শিকারী বাঘ মেরে চামড়া ও মাথার খুলি বন অফিসে জমা দিলে তাঁকে অর্থ পুরস্কার দেওয়া হত। ১৯৭৩ সালে জারীকৃত বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী বনে এখন সকল প্রকার প্রাণী শিকার নিষিদ্ধ, বন দফতর থেকে ‘মানুষখেকো’ বলে কাগজেপত্রে ঘোষণা করলে তবেই কেবল সেই বাঘ মারা যায়। পচাব্দী গাজীর শিকার জীবন ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বিস্তৃত। এর মধ্যে তিনি ৫৭ টি বাঘ মেরেছে। ফ্রান্স, জার্মানী, মধ্যপ্রাচ্য ও জাপানের পত্র-পত্রিকা ও টেলিভিশনে শিকারী পচাব্দী গাজীর কৃতিত্বের কাহিনী প্রচারিত হয়।
বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় সেবা প্রকাশণী থেকে ১৯৮০ সালে। বিখ্যাত শিকারি পচাব্দী গাজীর জবানিতে বইটি লিখেছেন হুমায়ুন খান। বইয়ে ৭টি অনুচ্ছেদ আছে। ১. আঠারোবেকির বাঘ, ২. দুবলার চরের মানুষখেকো, ৩. গোলখালীর বিভীষিকা, ৪. সুন্দরবনের ভয়ঙ্কর, ৫. শিকারী জীবনের বিচ্ছিন্ন স্মৃতি, ৬. সুপতির মানুষখেকো, ৭. তালপট্টির বিভীষিকা।
বাগেরহাটের শরণখোলা রেঞ্জের অধীনে দুবলা বহু মাইলব্যাপী এক বিশাল চর। সমুদ্ররেখার বরাবর সুন্দরবনের ঠিক মাঝখানে অবস্থিত এই দ্বীপ। এর একদিক দিয়ে পশুর আর আরেক দিকে মরজত নদী বয়ে গিয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। প্রত্যেক বছর কার্তিক থেকে চৈত্র এই ছয় মাস প্রধানতঃ চট্টগ্রাম এবং অন্যান্য এলাকার অন্ততঃ ৩০ থেকে ৪০ হাজার হিন্দু-মুসলমান ও মগ জেলে এসে দুবলার চরে অস্থায়ী বসত গড়ে। তারা নদীর মোহনা এলাকা ধরে ও সাগরে মাছ ধরে, চরেই শুঁটকি দেয় ৷ বহু তাজা মাছ সাম্পান আর যান্ত্রিক ট্রলার বোঝাই হয়ে সরাসরি চালান যায় চট্টগ্রামে, কক্সবাজারে, সেখানে সাগরতীরে বড় এলাকাজোড়া শুঁটকি দেওয়া হয়। লটিয়া, লাক্কা, ছুরি, রূপচান্দা, ইলিশ, বাইন, জাবা, ভেটকি, দাঁতনী, ভোলা, চিংড়ি, এবং আরো নানা জাতের মাছ, মগ জেলেরা হাঙর মাছও ধরে শুঁটকি দেয়।
ফাল্গুন মাস এলে হাওয়া ঘুরে যায়, সমুদ্র আবার উত্তাল হয়ে উঠে, জেলেরা তখন জাল গুটিয়ে বড় বড় সাম্পানে শুঁটকি বোঝাই করে নিয়ে চলে যায়। তারপর থেকে একেবারে আশ্বিনের শেষাশেষি পর্যন্ত দুবলা দ্বীপ একেবারেই জনশূন্য পড়ে থাকে। পরের কার্তিকে উত্তরের হাওয়া বইতে শুরু করলে সমুদ্র আবার শান্ত হয়ে যায় এবং কয়েক হাজার জেলেও আবার দুবলার চরে এসে গোলপাতার চালাঘর বেঁধে ব্যাপকভাবে মাছ ধরার প্রস্তুতি নেয়। সুন্দরবনের এই এক বিরাট অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। ছোট ছোট নৌকা করে মাছ ধরছে, বড় বড় ট্রলারে করে সব নিয়ে যাচ্ছে। দেখতে বড় আকর্ষণীয় ।
সবাই বড় বড় মটকি ভরে মিঠা পানি নিয়ে আসে। শুধু জেলেরাই নয়, মাঝি, জোংড়াখুটা, বাওয়ালী ও মৌয়াল যারা সারা বছর ধরে শত শত মাইল বিস্তৃত সুন্দরবনে কাজ করে তারা সবাই খাবার পানি সঙ্গে নিয়ে আসে। কারণ সুন্দরবনের সব নদীর পানিই লোনা–পানের অযোগ্য। নিতান্ত বিপদে আপদে চর খুঁড়লে কিছু মিঠা পানি পাওয়া যায়, কিন্তু সে পানির জন্যে কেউ সময় নষ্ট করে না বা তা যথেষ্টও নয় ।
দুবলার চরের জেলেদের কাজ তদারক করার জন্যে, এবং জেলেদের কাছ থেকে নির্ধারিত কর আদায়ের জন্যে বন দফতর সেখানে চার মাসের অস্থায়ী অফিস করে। একটি বড় ভাসমান বোটের মধ্যেই সেই অফিস, সেখানে একজন কর্মকর্তা আর অন্যান্য কর্মচারীগণ থাকেন। সুন্দরবনের এই দক্ষিণের চর অঞ্চলেই ফোঁটা হরিণ সবচেয়ে বেশী দেখা যায় খুব ভোরে আর ভরসন্ধ্যায় শত শত সুন্দর হরিণ যখন একসঙ্গে জড়ো হয় তখন সে দৃশ্যের তুলনা হয় না। আবার সুন্দরবনের যে ময়াল বা অজগর সাপের কথা সবাই জানেন সেই বিশাল আকারের ময়ালও এই চর এলাকায়ই বেশী বাস করে। এক একটা এক মণ, দেড় মণ পর্যন্ত ওজনের হয় এবং ইঁদুর, খরগোশ ও ছোট আকারের শূয়োর বা হরিণ আস্ত গিলে ফেলে। সুযোগ পেলে মানুষকেও আক্রমণ করে।
নদীতে ও সাগরে বড় ভয় দুইটির, কামোট ও কুমীরের। কেউ গোসল করতে কি কোন কাজে পানিতে নেমেছে, হঠাৎ পায়ে তীক্ষ্ণ খোঁচা লাগল, সেই পায়ে আর ভর করতে পারে না। হাতে খোঁচা লাগল, সেই হাতে আর বল পায় না, কামোট বা হাঙরে নিয়ে গেছে। প্রত্যেক বছর সমগ্র সুন্দরবন এলাকায় বহু লোক কামোটের দাঁতে হাত-পা হারায়। কুমীরের পেটেও যায় পাঁচ-দশজন। কুমীর কমোটের মত হাত-পা কেটে নেয় না, পানি থেকে গোটা মানুষই ধরে নিয়ে টুকরা টুকরা করে খেয়ে ফেলে। বাঘ একজন মানুষ খায় দুই দিনে কিন্তু কুমীর পরের দিনের জন্যে কিছু রাখে না। সুন্দরবনের সব কুমীরই মানুষ খায়।
কিন্তু চর এলাকার শুধু চর এলাকার নয়, সমগ্র সুন্দরবন এলাকারই-জেলেদের সবচেয়ে বড় শত্রু হল বাঘ। কারণ সাবধান সচেতন থাকলে তারা কামোট-কুমীরের মুখ থেকে বাঁচতে পারে, কিন্তু বাঘের মুখ থেকে নয় বাঘ থাকে বনে-বনের সর্বত্র তার বিচরণ, তার মুখ থেকে বাঁচার উপায় নেই। দুবলার চর এবং সুন্দরবনের অন্যান্য চরগুলো আসলে এক একটি ছোট ব-দ্বীপ সবগুলোই বনজঙ্গলে ঢাকা। জঙ্গল কোথাও গভীর একেবারে দুর্ভেদ্য ও অগম্য, আবার জায়গায় জায়গায় কিছুটা ফাঁকা। বাংলা ১৩৫৮ সালের অগ্রহায়ণের শেষাশেষি এই চরে যখন একটি মানুষখেকো বাঘের উপদ্রব হয় তখন এখানে অন্ততঃ দুই হাজার হিন্দু-মুসলমান মগ জেলে মাছ ধরছিল । বাঘের বিরুদ্ধে সেই হতভাগ্যদের আত্মরক্ষার কোন ব্যবস্থাই ছিল না বলে মানুষখেকোটি একের পর এক জেলেকে নিয়ে যেতে থাকে।
বন কর্মকর্তা ও শিকারীগণ বোট নিয়ে, নৌকা নিয়ে জেলেদের বস্তির কাছাকাছি জঙ্গলে গিয়ে বাঘ মারার চেষ্টা করেন, কিন্তু ধূর্ত বাঘের ভয়ঙ্করতা তাঁদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে দেয়, মানুষখেকো হলে তখন বাঘের ধূর্তামিও অনেক বেড়ে যায়। কিছুদূর পরে পরে জেলে বসতি, চারদিকেই জঙ্গল; অসহায় জেলেদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। শিকারীগণের প্রহরা ও অনুসন্ধান সত্ত্বেও এই মানুষখেকোটি দুবলার চরে মাত্র এক মাস সময়ের মধ্যে যে তেরজন জেলেকে ধরে খেয়েছিল আমি তাদের মধ্যে দুই-তিনটির সাধারণ উল্লেখ করব।
দশ-পনের হাত দূরে দূরে চারজন জেলে দাও দিয়ে গরানের চারা কাটছিল। খটি বা চালাঘর থেকে তারা তখন মাত্র শ-খানেক হাত দূরে এবং বেলা আন্দাজ আটটা । হঠাৎ একপাশ থেকে বাঘ গর্জন করে একজনের উপরে লাফ দিয়ে পড়ে, মাথায় কামড় দিয়ে ধরে মুখে তুলে নিয়ে যেতে থাকে। সঙ্গী জেলেরা প্রথমে মাটিতে শুয়ে পড়েছিল, কিন্তু চোখের সামনে তাকে নিয়ে যাচ্ছে দেখে কিছুক্ষণের মধ্যে সাহস ফিরে পায়। তারা চীৎকার করতে থাকে, অল্পক্ষণের মধ্যে লাঠিবাড়ি নিয়ে আরো কয়েকজন আসে। সকলে মিলে হৈ-চৈ করতে করতে জঙ্গলে এগুতে থাকে। প্রায় শ দুই হাত দূরে গিয়ে এক ঝোপের পিছন থেকে তারা হতভাগ্যের লাশ উদ্ধার করে আনে। এ ছিল হিন্দু, চরেই তার মৃতদেহের সৎকার করা হয় ।
জেলেরা গরান গাছ কাটে কষের জন্যে। সরু সরু গরানের ছাল টুকরা টুকরা করে জ্বাল দিয়ে যে কষ পাওয়া যায় তা তারা জালে লাগায়, শুকালে জাল মজবুত হয়। বাংলাদেশের অন্যান্য জায়গার জেলেরা গাবের কষ দেয়, সুন্দরবনে গাব গাছ নেই। চরের জেলেরা যে বাঘের মুখে যায় তাদের অনেকেই এই গরান গাছ কাটার সময়ে সেই ঘটনার ঠিক পরের দিন। গরান গাছ কেটে বিকাল বেলা দুই জনে মুগুর দিয়ে পিটিয়ে ডাল থেকে ছাল আলগা করছিল। জায়গাটা তাদের চালাঘর থেকে খুব বেশী দূরে নয়। খালের পাড়ে জঙ্গল, তারই এক প্রান্তে দুইজন সামনা সামনি এবং অপেক্ষাকৃত খোলা জায়গাতে বসা ছিল। হঠাৎ পিছন থেকে এসে বাঘ একজনকে ধরে। জেলের ঘাড়ে-মাথায় কামড় দিয়ে ধরে দুইটা ঝট্কা মারে এবং ভয়ে আধমরা দ্বিতীয় জেলের সামনেই তাকে নিয়ে জঙ্গলে চলে যায়। সম্বিৎ ফিরে পেয়ে দ্বিতীয় জেলে দৌড় দেয়, ঘরের ভিতরে গেলে তবে তার মুখ থেকে চীৎকার বের হয় এবং সকলকে সে মর্মন্তুদ ঘটনার কথা জানাতে সক্ষম হয়।
বিশ-পঁচিশজন লোক হৈ-চৈ করতে করতে জেলেকে উদ্ধার করতে রওনা হয়। কিন্তু তখন বেলা পড়ে গেছে, জঙ্গলের ভিতরে বেশীদূর এগুনো সম্ভব হয়নি। অগত্যা তারা সেদিনের মত ফিরে আসে। সকালে প্রায় পঞ্চাশ-ষাটজন রওনা হয়। কুড়াল, দা, লাঠি, কাঠ যার যা ছিল সঙ্গে নিয়ে চলল। বাঘের পারা, রক্তের চিহ্ন ধরে জঙ্গলের ভিতরে প্রায় সিকি মাইল যেতেই হঠাৎ বাঘের গর্! গর্! চাপা গর্জন শুনতে পায়, আর তাদের পক্ষে সামনে এগুনো সম্ভব হয়নি। এই জেলের লাশ বা হাড়-গোড় আর কেউ আনতে যায়নি; এ ছিল মুসলমান।
রাত্রে ভাত খেয়ে একজন জেলে পিছনের খটিতে তার এক আত্মীয়কে দেখতে যায় ৷ এটা কোনো অস্বাভাবিক কিছু নয় । জেলেদের খটি বা চালাঘরগুলো কোন কোন এলাকাতে বেশ ঘন ঘন থাকে এবং একটি থেকে হয়ত বা পাঁচ-ছয় বিঘা জায়গা পরেই আরেকটি চালাঘর। সারাদিন তারা নদীতে ও সাগরে মাছ ধরে, শুঁটকি করে, জাল শুকায়, তখন কর্মব্যস্ততার দরুন আত্মীয়-স্বজনের ভাল-মন্দের খবর নেওয়া সম্ভব হয় না; রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার পরেই কেবল তাদের জীবনে সামাজিক সম্পর্ক রক্ষার সুযোগ এই জেলের খটি থেকে মাত্র কয়েক শ হাত হালকা জঙ্গল পার হলেই অপর খটি, সেখানে তার আত্মীয় থাকে। বের হয়ে যাওয়ার পর রাত্রে সে আর ঘরে ফিরেনি। তাদের ঘরের অন্য সবার মনে সন্দেহ হয়–স্বভাবতঃই যে, মাত্র ককেদিনের মধ্যে এই চরের আটজন মানুষকে বাঘে নিয়ে গেছে। অবশ্য তারা কেউ কোন বাঘের গর্জন শুনতে পায়নি ।
সন্দেহ আর ভয়ের মধ্যে দীর্ঘ রাত পার হয়। সকাল বেলা কয়েকজন মিলে পিছনের খটিতে খবর নিতে যায়, আধা রাস্তায় যেতেই তারা বাঘের পারা আর রক্ত দেখতে পায়। চীৎকার করে ডাকাডাকিতে দুই খটির জেলেরা সকলে সেখানে জড় হয় এবং ঘটনা বুঝতে পারে। তারা স্থির করে যে শুধু নিরস্ত্র অবস্থায় জঙ্গলে না ঢুকে বন অফিসের বোটের একজন শিকারীকে সঙ্গে নিয়ে যাবে, নতুবা মৃতদেহ উদ্ধার করে আনতে যারা যাবে তাদের মধ্য থেকে আরো একজন না একজন বাঘের মুখে পড়বে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই বোট থেকে দুইজন শিকারীকে গিয়ে নিয়ে আসা হয়। তাঁদের পিছনে পিছনে বেশ অনেক লোক সিকি মাইলের মত জঙ্গল পার হয়ে গিয়ে এক আঁটো জায়গাতে লাশ পায় ! অর্ধেকই খেয়ে ফেলেছে। জেলেরা সেই আধা-খাওয়া দেহ এনে জানাজা পড়ে চালাঘরের সামনেই মাটি দেয়, শিকারী দুইজন সন্ধ্যা পর্যন্ত দুবলার জঙ্গলে বাঘের ব্যর্থ সন্ধান করেন।
মাত্র এক মাসের মধ্যে দুবলার চরের তেরজন জেলে অসহায়ভাবে বাঘের মুখে গেল। বন দফতরে নিযুক্ত শিকারীগণ, বোটের ফরেস্টার, বনপ্রহরী এবং ভাড়া করে আনা শিকারী সেই সময়ের মধ্যে বাঘের কোন মোকাবিলা করতে পারলেন না। কেউ একটি গুলি করার সুযোগও পাননি। কোন কোন দেহ জঙ্গল থেকে উদ্ধার করে সৎকার বা কবর দেওয়া গিয়েছিল কোনটা তাও পারা যায়নি। দুবলার জেলেদের অনেকেই যেহেতু সুদূর চট্টগ্রাম এলাকা থেকে আগত তাই কারো মৃত্যু হলে তাকে আর বাড়ীতে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না, চরেই পোড়াতে হয় বা কবর দিতে হয় দ্বীপের অবস্থা অতি শোচনীয় পর্যায়ে গিয়ে পৌছায়। জেলেরা যে কোথাও যাবে সে উপায় নেই, আবার মানুষখেকো বাঘের কিছু যে করবে সেই শক্তিও নেই। বোটের শিকারীগণ যথাসাধ্য চেষ্টা করেও প্রাণহানি রোধ করতে পারলেন না।
দুবলার অস্থায়ী বোট অফিসের দায়িত্বে তখন ছিলেন রেঞ্জার কাজী করীম সাহেব দিন দিনই অবস্থা বেশী শোচনীয় হচ্ছে এবং সকলের আয়ত্বের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে তিনি আর স্থানীয় শিকারীগণের উপরে নির্ভর করে থাকতে পারলেন না। নিজেই লঞ্চ নিয়ে দীর্ঘ নদীপথ পার হয়ে আমার গ্রামের বাড়ী সোরাতে এসে উঠলেন। দুবলা হল। সুন্দরবনের সর্বদক্ষিণ প্রান্তে সমুদ্রের কিনারায়, আর আমার বাড়ী হল বনের উত্তর পশ্চিম প্রান্তে ।
হাজার হাজার জেলের অসহায় অবস্থা, ধূর্ত নরখাদকের ভয়ঙ্করতা এবং প্রাণনাশের ঘটনাগুলো কাজী সাহেবের মুখ থেকে শোনার পরে আমি আর স্থির থাকতে পারলাম না। তখনো আমি বন দফতরে চাকরী নিইনি, পেশাদার বাঘ শিকারীরূপে বন বিভাগের স্বীকৃতিপত্র নিয়ে বনে গিয়ে শিকার করে থাকি। কিন্তু ঘটনাগুলো শোনার পরমুহূর্তের চেতনাবোধহেতু লঞ্চের ইঞ্জিন ঠাণ্ডা হবার আগেই আবার চালু করতে হল; নিজেদের কোন একজনকে সঙ্গী হিসাবে না নিয়েই আমি তৎক্ষণাৎ লঞ্চে উঠে বসলাম। আমার স্ত্রী আপত্তি করলেন এবং বলতে পারব না কেন, আমার মা ক্ষ্যান্ত বিবি, যিনি সুন্দরবনের দুর্জয় সাহসী, স্বনামধন্য বাঘ শিকারী মেহের গাজীর সংসার করেছেন, সেই মা-ও বললেন, ‘এখন যেয়ো না’। কিন্তু তাঁদের বাধা ঠেলেই আমি দুবলা রওনা হয়ে গেলাম; এবং তারপর সেখান থেকে যে আতঙ্কজনক অভিজ্ঞতা নিয়ে আবার বাড়ীতে ফিরে এলাম তা, ঘটনার এতদিন পরে, আজও মাঝে মাঝে আমার মনে জাগে এবং আমি যেন শুধু দুঃস্বপ্ন দেখতে থাকি৷
বাড়ী থেকে সন্ধ্যার পরে পরে রওনা হয়ে পরদিন সকাল সাতটায় আমরা দুবলা গিয়ে পৌঁছলাম । চরের অস্থায়ী অফিস আমাকে সকল রকম সুযোগ-সুবিধা দিল; একটি বড় বোট, সঙ্গে মজবুত ডিঙি, তিনজন বোটম্যান বা বনমাঝি এবং আরো একজন পাহারাদার, আর সকলের জন্যে যথেষ্ট খাবার। বিপদের মোকাবিলার জন্যে সুন্দরবনের সকল বন অফিসেই বন্দুক থাকে, দুবলার চরের ভাসমান অফিসেও ছিল। যে বন্দুক তাঁরা আমকে দিয়েছিলেন তা ছিল একটি দোনলা বেলজিয়াম। আগের দিনই বন অফিসে খবর পৌঁছেছিল যে মানিকখালীতে একজন জেলেকে বাঘে নিয়ে গেছে। কাজেই দুবলার অস্থায়ী বন অফিসের বোটে একবেলার বেশী দেরী করলাম না। জেলের দেহাবশেষ উদ্ধার করার এবং একটা সম্ভাব্য সুযোগের আশায় আমরা রওনা হলাম।
বিকাল তিনটায় দুবলা থেকে বোট ছেড়ে রাত বারোটায় মানিকখালী গিয়ে পৌছলাম। বাকী রাতটা বোটেই আধা-ঘুমা আধা-জাগা অবস্থায় কাটিয়ে দিলাম এবং সকাল সাতটার মধ্যেই নাশ্তা করে একটি ডিঙি নিয়ে বের হয়ে গেলাম, দুইজন বোটম্যান ডিঙি বাইতে লাগল আর মাঝখানে বন্দুক হাতে বসলাম আমি মানিকখালীর জেলেদের জিজ্ঞেস করে সঠিক জায়গা চিনে নিলাম যে কোনখান থেকে দুইদিন আগে গরান গাছ কাটার সময়ে জেলেকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। জেলেদের কাছেই শোনলাম যে, ঘটনার কিছুক্ষণের মধ্যে তারা সবাই তাকে উদ্ধার করে আনতে গিয়েছিল, কিন্তু জঙ্গলের ভিতরে কিছুদূর যেতেই এক ঝোপের পিছন থেকে গভীর গর্! গর্! শব্দ শুনতে পায় এবং তখন সবাই প্রাণভয়ে ফিরে আসে। পঞ্চাশ-ষাটজন লোকের হৈ-চৈকেও বাঘ ভয় করে না এবং মুখের শিকার না খেয়ে সে ছাড়বে না জেলের দেহ আর উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি ।
সাধারণ বাঘ মানুষকে ভয় পায়, সামনে দেখলে বিদ্যুৎবেগে ছুটে পালায়। কিন্তু মানুষখেকো হলে তখন সেই বাঘের আর ভয় থাকে না, পাঁচ-দশজনের মধ্যে একজনকে আক্রমণ করে বসে, এমন কি সাঁতার কেটে নৌকায় উঠে ঘুমন্ত জেলে মাঝিদের পর্যন্ত মুখে তুলে নিয়ে যায়। কিন্তু অর্ধভুক্ত দেহ উদ্ধার করতে আসা পঞ্চাশজনের উদ্ধারকারী দলকে গর্! গর্! ডাক দিয়ে ভয় দেখিয়ে পিছিয়ে দেওয়া এমন কি মানুষখেকো বাঘের জন্যেও অস্বাভাবিক ।
গত একমাসে এই বাঘ গড়ে প্রতি তিন দিনে একজন করে মানুষ খেয়েছে; দুইদিন আগে ধরা শিকার নিশ্চয়ই এর মধ্যে সে খেয়ে ফেলেছে এবং আজ অবশ্যই খাবারের অন্বেষণে বের হবে; জেলেদের মধ্যে যারা জাল নিয়ে গাঙে ও সাগরে গেছে তারা নিরাপদ, যারা চালাঘরে কাজ করছে—শুঁটকি দিচ্ছে বা খোলা যায়গাতে বসে জালে কষ লাগাচ্ছে তারাও কিছুটা নিরাপদ; কিন্তু যারা গরান গাছ কাটতে বের হয়েছে তাদেরই বেশী ভয় ৷
আমি স্থির করলাম, দুইদিন আগে গরান গাছ কাটার সময়ে যেখান থেকে জেলেকে নিয়ে গেছে আগে সেখানে যাব, মরির যদি কিছুমাত্রও থাকে তবে—যদিও সে সম্ভাবনা কম—তাহলে মরির উপরেই আগে বসব। জেলেরা আমাদেরকে যে জায়গাটা দেখিয়ে দিল সেটা আমাদের বোট থেকে আধ মাইল.হবে না, খালের উল্টাপাড়ে। পাড় সেখানে সামান্য উঁচু এবং একবারে কিনারা থেকেই গভীর বন। মিনিট বিশেকের মধ্যে আমরা ডিঙি নিয়ে সেই স্থানে পৌছলাম।
গত দুইদিন বৃষ্টি হয়নি, সুন্দরবনে শীতকালেও মাঝে মাঝে বৃষ্টি হয়—কাজেই রক্তের চিহ্ন নিশ্চয়ই মুছে যায়নি, বাঘের পারাও থেকে থাকবে-যদিও পঞ্চাশজন লোক সেখান দিয়ে হেঁটে গেছে—তাই উদ্ধারকারী দল যেখান দিয়ে এগিয়েছিল সেই চিহ্ন ধরতে আমার অসুবিধা হবে না। পাছার মাঝি ডিঙি ঘুরিয়ে পাড়ে লাগাল আর বন্দুকের দুই নলে টোটা ভরে আমি লাফ দিয়ে টানে উঠলাম।
জঙ্গলের কিনারায় পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাঘ আমাকে আক্রমণ করল। ‘হুঙ্ক!’ গর্জন শোনার আগেই কি শক্তিবলে যে আমি দুই হাত পিছনে সরে এসেছিলাম তা বলতে পারব না, বাঘ ঠিক আমার দুই হাত সামনে পড়েই গা-গা করে পিছনের দুই পায়ের উপরে খাড়া হয়ে উঠল, হাতের আন্দাজে নিশানা করে ট্রিগার টানলাম, কিন্তু গুলি ছুটল না। তখন বিকট হা মেলে গাঁ-গা করতে করতে বাঘ আমার মাথা লক্ষ্য করল। আমি বন্দুকের নল বাঘের ব্যাদান করা মুখের বরাবর ধরে ট্রিগার টানতে লাগলাম, কিন্তু গুলি ছুটল না! গুলি ছুটল না! গুলি ছুটল না! গলা ফাটিয়ে চীৎকার করতে লাগলাম। বাঘ হঃ! হঃ! ডাক ছেড়ে আমাকে কামড়ে ধরতে এল, বাঘের মুখের লালা আমার গায়ে আর মুখে ছিটকে পড়তে লাগল। চারটি ভয়ঙ্কর দাঁত আর গোঁফ যেন আমার হাতে লাগল। বন্দুকের নল তার দাঁত-মুখ বরাবর ধরে আমি বাঘের পাল্টা হাঁক ছাড়তে লাগলাম আর লাফিয়ে লাফিয়ে পিছে হঠতে লাগলাম! লালায় আমার শরীর ভরে গেল। একদলা ফেনা নাকে আর কপালে এসে ছিটকে পড়ল, সরাতে পারলাম না। আবার হঃ! হঃ! করে বাঘ তার বিশাল শরীরটা ঝাঁকাতে লাগল। আমার মনে হল গোটা দুনিয়া যেন থর্ থর্ করে কাঁপছে, আমি জমিনের নীচে চলে যাচ্ছি, মনে হল আমার শরীরটা নেই, আত্মা যেন হাড়ের সঙ্গে লেগে আছে। বাঘ আবার হঃ! হঃ! করে উঠতেই একসঙ্গে একদলা লালা ছিটকে এল, আমি আবার নিজের শরীরটা বোধ করলাম । হাঃ! হাঃ! যাঃ! যাঃ! ডাক ছেড়ে বন্দুকের নল একেবারে মুখের হা বরাবর ঠেলে দিলাম। বাঘ তার শরীর পিছনে সঙ্কুচিত করল, আমি একপাশে সরে যেতেই খালের পানিতে পা পড়ল, লাফ দিয়ে খালে পড়ে ডুব দিলাম ।
মাথা তুলতে দেখি খালের চারভাগের তিনভাগ পার হয়ে গেছি, আরেক ডুবে পাড়ে পৌছলাম । উঠে ছুটে কয়েক হাত দূরে একটা গাছের গোড়ায় গিয়ে পিছনে তাকালাম, দেখি বাঘ লাফ দিয়ে পানিতে যে পড়েছিল এখন গোঁ গোঁ করতে করতে আবার পাড়ে উঠছে। বন্দুকের টোটা খুলে পকেট থেকে অন্য দুইটি ভিজা টোটা ভরে বাঘের বুক বরাবর নিশানা করে আবার ট্রিগার টানলাম কিন্তু তবু গুলি ছুটল না। বেলজিয়াম বন্দুক, কিন্তু সেই বন্দুকটা ভাল ছিল না। ওপারে বাঘ পানি থেকে পাড়ে উঠে কয়েকবারই আমার দিকে তাকিয়ে মুখ খিঁচাল, তারপর জঙ্গলে ঢুকে গেল। জঙ্গলাকীর্ণ একেবারে জনশূন্য চর, পিছনে দেখতে দেখতে বেহুঁশের মত ছুটলাম আর এতক্ষণে দুই চোখ ফেটে পানি এল আমার।
পাড়ে বাঘের গর্জন শোনামাত্র বোটম্যান দুইজন আমাকে ফেলে ডিঙি ভাসিয়ে দিয়ে নিজেদের প্রাণ দুইটি নিয়ে তাড়াতাড়ি বোটে চলে এসেছিল। আমি বাঘের মুখ থেকে রক্ষা পেয়ে চর পার হয়ে বেহুঁশের মত ছুটে গিয়ে যখন বোটে উঠব ঠিক সেই মুহূর্তেও তারা অন্যদের কাছে বর্ণনা করছিল যে কেমন করে হঠাৎ বাঘ আমার উপরে লাফ দিয়ে পড়ে আমার মাথাটা গিলে ফেলে এবং আরপর আমার শরীরটা এক ঝটকায় পিঠে তুলে নিয়ে জঙ্গলের ভিতরে চলে যায়; তারা কোন সাহায্য করারই সুযোগ পায়নি।
আমি বন্দুক হাতে বোটের গলুইয়ে পা দিতেই বোটটা দুলে উঠল আর ভিতরে ওরা ‘বাবা গো, খেয়ে ফেলল!’ বলে আর্তনাদ করে উঠল। ভাবল, যে-সঙ্গীকে বাঘের মুখে ফেলে পালিয়ে এসেছে সেই পচাব্দী গাজীকে খেয়ে বাঘ এবার অবশ্যই তাদেরকে খাবার জন্যে লাফ দিয়ে বোটে উঠেছে। আমি পর পর পাঁচ গেলাস পানি খেলাম, কথা বলতে পারলাম না, বন্দুকটা ফেলে পাটাতনের উপরেই শুয়ে পড়লাম। সারা শরীর থর্ থর্ করে কাঁপতে লাগল ।
সেইদিনই আমি দুবলার অস্থায়ী বন অফিসে ফিরে গিয়ে অকেজো বন্দুকটি জমা দিলাম এবং বাঘ শিকার করতে অস্বীকার করলাম। বোটের রেঞ্জার কাজী সাহেবসমেত সবাই আমার অভিজ্ঞতার কাহিনী শুনে ভয়ে বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেলেন। কিন্তু অবস্থা বিবেচনা করে আবার বললেন যে বন্দুক আরো রয়েছে এবং আমি চলে যাওয়ার অর্থ হবে দুবলার চরের হতভাগ্য জেলেদেরকে মানুষখেকোর মুখের খোরাক করেই রেখে যাওয়া। তাঁরা অনেক আশা করেই আমাকে বাড়ী থেকে আনিয়েছিলেন; আর বাঘ শিকার করতে এসে বিখ্যাত মেহের গাজীর ছেলে পচাব্দী গাজী বাঘের মুখে পড়েছিল, অতঃপর প্রাণভয়ে বাড়ী চলে গেছে, এই কথাটি প্রচারিত হবার সঙ্গে সঙ্গে দুবলার চরের হাজার হাজার জেলের মধ্যে একেবারেই অবশ কর্মহীনতা সৃষ্টি হয়ে যাবে। কিন্তু তাঁদের কথা বিবেচনা করার মত মানসিক অবস্থা তখন আর আমার ছিল না। বললাম, ‘বাড়ী যাই, যদি বাঘ শিকার করতে হয় তবে আমার নিজের লোক সঙ্গে নিয়ে এসে করব।’
দুবলার চর থেকে একটি মাছের নৌকা করে সেই রাত্রেই আমি খুলনা গেলাম এবং সেখান থেকে লঞ্চে করে পরদিন বিকালে আমার বাড়ী শ্যামনগর থানার সোরা গ্রামে পৌছলাম । পরের বারোদিন বাড়ীতে মা, স্ত্রী-ছেলেমেয়ে ও অনেক আপনজনের মাঝে বেশ হাসিখুশীতেই কাটালাম। ততদিনে মনের আতঙ্ক ও অস্বাভাবিকতা অতিক্রম করে আবার মজবুত হয়ে উঠলাম। কিন্তু তারপরেই আবার দুবলার চরের হাজার হাজার অসহায় মানুষদের কথা মনে করে আমি কেমন যেন অস্থির হয়ে পড়লাম দিনরাত কাদের যেন ডাক, কাদের যেন আর্তনাদ, হাহাকার আমাকে অস্থির করে তুলল ।
আমরা শিকারী বংশের মানুষ, যত ছোটই হই না কেন ভয়ঙ্কর মানুষখেকোকে সামনা সামনি মোকাবিলা করে বনের জেলে-বাওয়ালীদের রক্ষা করার গৌরব আমাদের রক্তে মিশে আছে। আমার দাদার ভাই দাদা, শিকারী ইসমাইল গাজী বাঘের মুখে প্রাণ দিয়েছিলেন, আমার বিখ্যাত বাবা, শিকারী মেহের গাজী পঞ্চাশটির বেশী বাঘ মেরে বাঘের কামড়ে মারা যান, আমার চাচা নিজাম্দী গাজীর একটা হাত বাঘে নিয়ে গেছে। যত ধূর্ত, যত ভয়ঙ্করই হোক না কেন, বাঘের কাছে আমি হার মানতে পারি না। সুন্দরবনের যেখানে মানুষখেকো বাঘ সেখানেই আমাদের ঠিকানা।
এবারে মা ‘না’ বললেন না, স্ত্রীও কিছু বললেন না; ছোট ভাই হাশেম আলীকে আর শ্যালককে সঙ্গে নিয়ে আমার নিজের নৌকা করে আবার দুবলার ভাসমান বন অফিসের বোটে গিয়ে হাজির হলাম। কাজী করীম সাহেবের, বন বিভাগের অন্যান্য কর্মকর্তা ও লোকজনদের খুশীর আর শেষ রইল না। তাঁরা যেন জানতেন যে আমি আবার সেখানে যাব এবং মানুষখেকোকে শেষ পর্যন্ত আমিই মারব। কয়েকটা বন্দুকই এগিয়ে দিলেন, আমার যেটা পছন্দ । আমি আরেকটা দোনলা বেলজিয়াম বন্দুকই নিলাম, দুইটি কার্তুজ ভরে এবার আগেই শূন্যে গুলি করে দেখে নিলাম।
সেই বারোদিনে আরো দুইজন বাঘের মুখে গেছে। জেলেরা এমনি সাহস হারিয়ে ফেলেছে যে অনেকে মিলে গিয়ে যে উদ্ধার করে আনবে তাও করতে পারেনি। এর মধ্যে অন্যান্য শিকারীগণও চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু কেউ বাঘকে গুলি করার সুযোগ পাননি পরবর্তী তিনদিন ধরে আমরা তিনজনে ডিঙি নিয়ে সন্ধান করতে থাকলাম। সারাদিন খালে খালে, বনের ধারে, বনের ভিতরে বাঘের সন্ধান করলাম, কিন্তু বাঘ যদিও একেবারে নিশ্চিত সেই এলাকাতেই ছিল।
এর মধ্যে দুবলার চরের সকল জেলেদের বলে দেওয়া হল যে, কোনখানে কেউ বাঘ দেখলে, কি বাঘে কোথাও কাউকে আক্রমণ করলে তা যেন তৎক্ষণাৎ বন অফিসের বোটে বা আমকে জানানো হয়। দুইদিন এক রাতের মধ্যে কোনখান থেকে খবর পাওয়া গেল না বা আমরাও কোনখানে বাঘ দেখতে পেলাম না। কিন্তু আমি নিশ্চিত জানতাম যে কোনখানে কোন একজন জেলের অসাবধানতার সুযোগ এই মানুষখেকো বাঘ অবশ্যই নিবে; তাই আমাকে একটু ক্ষান্ত হলে চলবে না।
দেখলাম না, তৃতীয় দিনে বন অফিসের বোট থেকে আমরা তখন প্রায় দুই মাইল দূরে। আমার ভাই হাশেম আর শ্যালক-রাত প্রায় বারোটা পর্যন্ত সজাগ থেকে তারপর ছৈ-এর নীচে ঘুমাতে গেল। আমি অর্ধেক শরীর ছৈ-এর ভিতরে এবং অর্ধেক বাইরে হয়ে বসে সকাল পর্যন্ত একাই জেগে থাকব স্থির করলাম। তখন মাঘ মাসের শুরু, কিন্তু সমুদ্রের কাছাকাছি চর এলাকায় শীত খুব বেশী ছিল না। পুর্ণিমার তিন দিন বাকী ছিল বলে প্রায় সারা রাতই চাঁদের আলো থাকবে, সেই আলোতে অন্ততঃ চল্লিশ হাতের মধ্যেও বাঘ এলে আমি দেখতে পাব এবং আমার গুলি সম্ভবতঃ লক্ষ্যভ্রষ্ট হবে না।
ফজরের ওয়াক্ত পর্যন্ত বনে শুয়োরের শব্দ পেলাম দুই-তিনবার, হরিণের ডাকও শোনলাম, কিন্তু সেগুলোর কোনটাকেই ভয়ার্ত ডাক বলে মনে হল না এবং সারা রাতের মধ্যে বাঘের কোন চিহ্নও দেখলাম না। পূবের আকাশ ফর্সা হলে তখন হাশেম আলী ও আমার শ্যালককে জাগালাম, হাশেমের হাতে বন্দুক দিয়ে নামাজ পড়লাম এবং শুধু ক্লান্তি নিয়েই ঘুমিয়ে পড়লাম । সকাল আটটার সময়ে গরম ভাত খেয়ে আমরা আবার নৌকা ছাড়ব, এমন সময়ে দেখি একটি ডিঙি নৌকা খুব জোরে বেয়ে আমাদের দিকে আসছে। আমরা নৌকা কিনারায় ভিড়িয়ে একটু দেরী করলাম। ডিঙিতে তিনজন জেলে, তাদের মধ্যে একজন তরুণ যুবক, আমার সামনে খালের পাড়ে শুয়ে পড়ে হাউমাউ করে বলতে লাগল, ‘আমার ভাই ভালয়ে গেছে! আমার ভাই ভালয়ে গেছে!’ তার আর কোন কথাই বুঝা গেল না, শোকে, আঘাতে সে এমন হয়ে গেছে যে, বারবারই কেবল বলছে, ‘আমার ভাই ভালয়ে গেছে!’ তার সঙ্গী দুইজনের কাছ থেকে আমরা অতি দুঃখজনক ঘটনার বর্ণনা শোনলাম।
মাত্র এক ঘন্টারও কম সময় আগে বাঘ যেখান থেকে একজন জেলেকে নিয়ে গেছে সে জায়গাটা আমাদের নৌকা থেকে আরো আধা মাইল এবং দুবলা বোট অফিস থেকে প্রায় তিন মাইল দূরে। খটি থেকে কিছু দূরে তারা চারজন গরান গাছ কাটতে গিয়েছিল। অল্প কয়েকটিমাত্র চারা গাছ কাটতেই হঠাৎ একপাশ থেকে বাঘ একজনের উপরে লাফ দিয়ে পড়ে এবং তাকে মুখে নিয়ে জঙ্গলের ভিতরে চলে যায়। যে হতভাগ্য বাঘের মুখে গেছে সে এই ক্রন্দনরত যুবকের আপন বড় ভাই।
আমি বললাম, ‘বন অফিসে পরে যাবে, আগে চল ওকে নিয়ে আসি।’ দুই নৌকা করে আমরা তক্ষুণি রওনা হলাম এবং আধ ঘন্টার মধ্যেই ঘটনাস্থলে গিয়ে পৌছলাম। বাঘের হিংস্রতার এক মর্মান্তিক চিহ্ন দেখলাম। জঙ্গলের কিনারায়ই তারা গরান চারা কাটছিল। চারজন একই জায়গায় প্রায় পাশাপাশি ছিল, অর্থাৎ কেউ কারো থেকে বিচ্ছিন্ন বা দূরে নয়। দশ-পনের মিনিটমাত্র গাছ কাটতেই বাঘ একটা গর্জন করে জেলেকে ধরে এবং তার ঘাড়ে কামড় দিয়ে ধরে টেনে নিয়ে যেতে থাকে। কিন্তু জেলে তখনো মরেনি, গোঙাতে গোঙাতে হাত-পা আছড়াতে থাকে, একটা ছোট চারাগাছ সে আঁকড়ে ধরে। শিকার নড়াচড়া করছে দেখে হাত দশেক নিয়ে গিয়ে বাঘ তাকে মাটিতে থোয়, আবার ঘাড়ে গলায় কামড়ে ধরে দুইটা হ্যাচকা ঝাঁকুনি দিয়ে মেরে ফেলে, তারপর মুখে তুলে নিয়ে যায়। যেখানে বাঘ জেলেকে প্রথমে ধরেছিল সে জায়গায় রক্ত পড়েছিল আর হাত দশেক দূরে যেখানে নিয়ে কামড় ছেড়ে দিয়ে আবার ধরেছিল, যখন হতভাগ্যের মুখ থেকে একটা ‘ক্যাক!’ শব্দ হয়ে গোঙানি থেমে যায়, সেখানে অনেক রক্ত।
আমরা ছয়জন বাঘের পারা আর রক্ত দেখে দেখে এগুতে লাগলাম। কিছুদূর যেতেই তার কাপড় পেলাম-একটা চারা গাছের সঙ্গে আটকে আছে— তারপর আর মাত্র হাত পঞ্চাশেক যেতেই জেলেকে পেলাম, গরান বনের ভিতরে কতকটা খোলা জায়গাতেই পড়ে রয়েছে। পা দুইটি গুটানো, মাথাটা একদিকে কাত অবস্থায়, চোখ খোলা, যেন চেয়ে আছে; বাঘ কাছে ধারে আছে বলে মনে হল না। জেলের শরীর থেকে এক খাবলা গোশত খায়নি। এমন হতে পারে যে তার ভাইয়ের চীৎকারে বিরক্ত হয়ে শিকার এ পর্যন্ত এনে কাছেই কোথাও অপেক্ষা করছিল, এখন আমাদের আওয়াজ পেয়ে সরে গেছে। গত তিন দিনে বাঘ কোন মানুষ খায়নি, আজ নিশ্চয়ই খুব বেশী ক্ষুধার্ত হবে, কেবল নিরাপত্তার অভাবেই শিকার খেতে শুরু করেনি।
জেলের ভাই তক্ষুণি মৃতদেহ নিয়ে যেতে চাইল, কিন্তু আমি এবং বাকী সবাই বুঝিয়ে বলাতে সে আধাবেলার জন্যে রাখতে রাজী হল। সেই আধাবেলার মাঝেই গুলি করার একটা নিশ্চিত সুযোগ পাবে বলে আশা করলাম। বাঘ অবশ্যই বেশী দূরে কোথাও যায়নি, অতি ক্ষুধার্ত থাকাতে, একটু নিরিবিলি পেলে এই এখনিও আসতে পারে।
মরি থেকে প্রায় বিশ হাত সোজা পশ্চিমে একটা বিশাল বাইন গাছের আট-নয় হাত উপরে একটি ডাল মোটামুটি বসার উপযোগী ছিল, সেটাতেই উঠে বসলাম। আমার শ্যালক খালি হাতেই উঠে বসল গিয়ে আমার উপরের ডালে। হাশেম আলী তিনজন জেলেকে নিয়ে হাত ধরাধরি করে, জোরে কথা বলতে বলতে নৌকায় চলে গেল আমার শ্যালক প্রায় সোজা আমার মাথার উপরে আড়াল করে বসল, আর মাটি থেকে আট-নয় হাত উপরে মোটা ডালে পাতার আড়াল করে কাণ্ডের গায়ে পিঠ ঠেকিয়ে বসলাম আমি। আমার বন্দুকের দুই নলই ভরা। জেলের মৃতদেহ আমার গাছের গুড়ি থেকে প্রায় বিশ হাত পূবে। এখন বাঘ যেদিক থেকেই আসুক না কেন, যদি মরির কাছে আসে তাহলে আমার গুলি করতে কোন অসুবিধা হবে না। আর বাঘ যদি ইতিমধ্যেই আমাদের দুইজনকে দেখে ফেলে থাকে এবং না আসে তাহলে আমার আজকের প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হবে।
কিন্তু আসার সময়ে অতি ক্ষুধার্ত ও ক্রুদ্ধ বাঘ সম্ভবতঃ তার ফেলে যাওয়া শিকার ছাড়া আর কোন কিছুই খুব সাবধানতার সঙ্গে খেয়াল করবে না। আমরা যখন বাইন গাছে উঠে বসি তখন বেলা ছিল এগারটা-সাড়ে এগারটা। তার পর থেকে বেলা একটা পর্যন্ত আধা-অন্ধকার বনে প্রায় স্তব্ধ নীরবতা বিরাজ করতে লাগল, বাতাসে পাতা নড়া ছাড়া আর কোন শব্দও শুনতে পেলাম না। সকল সতর্কতার সঙ্গে আমি লক্ষ্য রাখতে থাকলাম। মাঝে মাঝে উপরে তাকাই, প্রতিবারেই আমার শ্যালক হাত নেড়ে বা মুখ নেড়ে ইঙ্গিত করে জানায় যে কিছু চোখে পড়েনি। স্তব্ধতার মধ্যে সময় কাটতে লাগল ।
হঠাৎ পাতার চড়ু চড়ু শব্দ শোনলাম, প্রায় একশ হাত দূরে পূব-দক্ষিণ দিকে। সারা জীবন সুন্দরবনে কাটিয়ে ওই গুরুত্বপূর্ণ ছোট্ট শব্দের সঙ্গে আমি অতি পরিচিত ছিলাম, দূরের ক্ষীণ আওয়াজ হলেও আমার মনে সন্দেহমাত্র রইল না যে, বাঘ এসেছে ৷ এর পরের পাঁচ মিনিট সময় ধরে উত্তেজনায় আমার শরীরের সব লোম খাড়া হয়ে রইল, কিন্তু মরি থেকে প্রায় ত্রিশ হাত দূরে ঝোপের ভিতর থেকে বাঘ যখন বের হয়ে এল তখন আমার আর সাহসের অভাব হল না।
এদিক সেদিক কোথাও না তাকিয়ে বাঘ দাপটের সঙ্গে মরির দিকে এগিয়ে এল, জেলের ঘাড় কামড়ে ধরে তুলে নিয়ে যাবার জন্যে মুখটা উঁচু করল, আর সেই মুহূর্তে আমি বুক বরাবর গুলি করলাম ‘হৌক্ক!’ করে ডাক ছেড়ে বাঘ লাফ দিয়ে উঠল, মুখ থেকে জেলের দেহ শূন্যে ছুটে অন্ততঃ দশ হাত দূরে গিয়ে পড়ল আর গুলির আঘাতে বিশাল বাঘটা পিছন দিকে মাটিতে পড়ে চার পা দাবড়াতে দাবড়াতে শরীরটা একদিকে ঠেলতে লাগল। হাত পাঁচ-ছয় সে রকম ঠেলে ঠেলে বাঘের মাথাটা যখন একটা ঝোপের ভিতরে চলে গেছে কিন্তু বাকী শরীর বাইরে—তখন কোমরে দ্বিতীয় গুলি লাগতেই মুখের গোঙানি আর চার পায়ের মাটি দাবড়ানি সব থেমে গেল। বিশাল বাঘটা পিছনের একটা পা শূন্যে তোলা অবস্থায় আধা-চীৎ আধা কাত হয়ে পড়ে রইল। আমি গাছ থেকে ‘আল্লা! আল্লা!’ বলে ডাক দিলাম, সঙ্গে সঙ্গে নৌকা থেকে হাশেম আলী ডাক দিল, ‘আল্লা! আল্লা! আল্লা! আল্লা! আল্লাহ!’
এক নৌকায় বাঘ আরেক নৌকায় জেলের দেহ নিয়ে বেলা আনুমানিক তিনটার সময়ে আমরা দুবলার চরের অস্থায়ী বন অফিসে বোটের কাছে পৌছলাম এবং নৌকা কিনারায় ভিড়ানোর আগে শূন্যে একটা গুলি করলাম। শোকাহত দীর্ঘদিনের আতঙ্কগ্রস্ত হাজার হাজার জেলে এই শূন্যে একটা গুলির জন্যেই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে ছিল, এক ঘন্টা সময়ের মধ্যে প্রায় এক হাজার জেলে এসে বাঘের চারদিকে জড় হল ।
সেদিন তারা কিছুতেই চামড়া ছোলাই করতে দিল না, তাই সারারাত বাঘ রাখতে হল বোটের সামনে চরে। চাঁদনী রাত ছিল, রাতভরই লোক আসতে লাগল। মানুষখেকো বাঘ মারা পড়েছে, এখন আর কোন ভয় নেই, দল বেঁধে এবং একজন একজন করেও চাঁদের আলোয় দুবলার চরের চারদিক থেকে জেলেরা কেবল আসতে লাগল। মাঘ মাসের সারারাত ধরে এমন চলল ৷ পরদিন সকালে সব লোকের উপস্থিতিতে বাঘের চামড়া ছাড়ানো হয়। সাড়ে দশ ফুট লম্বা বাঘের সামনের চারটা দাঁত ছিল না, অর্থাৎ মানুষখেকো ছিল বুড়া বাঘ।
হারানো আত্মীয়-স্বজন ও সঙ্গীর শোকে অনেক জেলেই তখন কান্নাকাটি করছিল। দুবলার চরের মানুষখোকোর ষোল নম্বর এবং শেষ শিকার ছিল যে জেলে, তার ভাই বারবারই শুধু বলছিল, ‘আমার ভাইকে মারলি, তুইও মরলি!’
সুন্দরবনের বিখ্যাত পচাব্দী শিকারির ৫৭ টি মানুষখেকো বাঘ হত্যা
Leave a comment