
সিরাজুল ইসলাম, শ্যামনগর: নতুন প্রযুক্তির কাছে হার মেনে গ্রামোফোন বা কলের গান বেশ কয়েক দশক আগেই বাঙালির জীবন থেকে বিদায় নিয়েছে। কিন্তু রেখে গেছে সংগীত-সংস্কৃতির অমূল্য সম্পদ – ঐতিহ্যের এক প্রাণময় ধারা।কলের গান এ দেশের সাধারণ মানুষের কাছে পাক ভারত উপ মহাদেশের বিখ্যাত শিল্পীদের গান শোনার সুযোগ করে দিয়েছিলেন সংগীত ও সংস্কৃতির জগতে যা চির স্মরনীয় ঘটনা। সংগীতকে রাজা বাদশাদের জলসা ঘরের বাইরে সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌছে দিতে গ্রামোফন বা কলেরগান এক যুগান্তকারী আবিষ্কার। গ্রামোফোন আবিষ্কারের পর আমাদের এই বাংলাদেশে ভারতীয় বিখ্যাত শিল্পিদের কন্ঠে গাওয়া গান গুলি শোনার সুযোগ সৃষ্টি হয়। সুধির লাল চক্রবর্তীর গাওয়া “খেলাঘর মোর ভেঙ্গে গেছে হায়-নয়নেরও যমুনায়, সাপমোচন ছবিতে হেমন্ত মুখার্জীর গাওয়া “ বসে আছি পথ চেয়ে-ফাগুনের গান গেয়ে,যত ভাবি ভূলে যাবো মন মানেনা” লতাজির কিশোরী কন্ঠে গাওয়া “প্রেম একবার এসেছিল নিরবে-আমারই এ দুয়ার প্রান্তে, “আকাশ প্রদীপ জ্বলে দুরের তারার পানে, “ একটি নাম না বললেই নয় গীতা দত্ত যার কন্ঠে “নিশি রাত বাঁকা চাঁদ আকাশে, চুপি চুপি বাঁশি বাজে বাতাশে বাতাশে,। জগন্ময় মিত্র, শ্যামলমিত্র, আঙুরবালা দেবী, ইন্দোবালা দেবী,সতিনাথ মুখপাধ্যায়, মোহাম্মদ রফি, কিশোর কুমার, আশা ভোষলে,উষা মঙ্গেষ্কার, আরো অনেক শিল্পীর গান কলের গানে শোনা যেত। আমাদের রংপুরের ভাওয়াইয়া গান যার মধুর কন্ঠে বিভিন্ন গানে ফুটে উঠতো বিরহী নারীর হৃদয় উজার করা কথা মালা সেই আব্বাস উদ্দীন। তার গাওয়া “ ওকি গাড়িয়াল ভাই, “ আমায় এত রাতে কেনে ডাক দিলি, “নদীর কুল নাই, হেমলতা ও আব্বাছ উদ্দীনের দ্বৈত কণ্ঠে গাওয়া “ নাইয়র ছাইরা দেওরে বন্ধু-নাইয়র ছাইরা দেও,ইত্যাদি। একই সময়ে পল্লীর মানুষের মন কাড়া শিল্পী আব্দুল আলীমের গান শুনতে কলের গানের চার পাশে ভিড় জমাতো গ্রামের নারী পুরুষ সব বয়সের মানুষ। ভাটিয়ালী, পল্লগিীতি কলের গানে বেজে চলতো গ্রাম বাংলার বাড়ী ঘর দোকান পাট আনাচে কানাচে। “রুপালী নদীরে রুপ দেইখা তোর হইয়াছি পাগল, “ সর্বনাশা পদ্মা নদী তোর কাছে শুধাই, “কেহই করে বেচা কেনা কেহই কান্দে-রাস্তার ধারে ধরবি যদি তারে, ইত্যাদি। গ্রামোফোন ডিক্সে গান রেকড করেছেন এমন অনেক গুনিশিল্পী ছিলেন যাদের নাম আমার জানানেই। স্মৃতির স্মরনিকায় যাদেরকে উপলদ্ধিতে পেয়েছি শুধু তাদের কয়েকজনের নামই আজকের এই লেখায় তুলে ধরতে চেষ্টা করেছি শুধু হারিয়ে যাওয়া কলেরগান নামের যন্ত্রটির তাৎপর্য এ প্রজন্মের কাছে পরিচিত করতেশব্দ সংরক্ষণের জনক টমাস আলভা এডিসন। তিনি ১৮৭৮ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি কাঠের বাক্সের ওপর চোঙা লাগানো এমন এক যন্ত্র আবিষ্কার করলেন । যার মধ্যে গোলাকৃতি এক বস্তুর ওপর চাকতির মধ্যে পিন লাগিয়ে ঘোরালে শব্দ উৎপন্ন হয়। এডিসন তার প্রিয় কবিতা ‘মেরি হ্যাড এ লিটল ল্যাম্প’ পাঠ করে রেকর্ডে ভরে উদ্বোধন করলেন যন্ত্রের। নাম দিয়েছিলেন ‘ফনোগ্রাফ।বছর দশেক পর জার্মানির বিজ্ঞানী বার্নিলার টিনফয়েল আধুনিক করে মোমের রেকর্ড বানিয়ে নাম দেন গ্রামোফোন। তারপর মাটির রেকর্ড থেকে প্লাস্টিকের সুতায় ঘূর্ণন রেকর্ড।এডিসনের পোষা প্রিয় কুকুরকে গ্রামোফোনের চোঙের সামনে বসিয়ে মনোগ্রাম করে নামকরণ হয় ‘হিজ মাস্টার্স ভয়েস’ সংক্ষেপে এইচএমভি।১৮৯৮ সালে জার্মানিতে গড়ে ওঠে বিশ্বের প্রথম গ্রামোফোন কোম্পানি।গত শতকের ষাটের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত মাগুরাসহ অনেক বনেদী পরিবারে গ্রামোফোন বাজত। এখন পুরনো কয়েকটি পরিবারের ড্রয়িংরুমে শো-পীচের জায়গা দখল করে আছে দু-একটি গ্রামোফোন রেকর্ড।গ্রামোফোনে গান শুনেছেন এমন প্রবীণ ব্যক্তিদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ‘দ’ আকৃতির একটি হ্যান্ডেল দিয়ে স্প্রিং চেপে রেখে নরম কাপড়ে মোড়ানো গোলাকার চাকতির ওপর রেকর্ড বসানোর পর ছোট মোটা গোলাকৃতি সাউন্ড সিস্টেমের ভিতর ছোট্ট পিন বসিয়ে রেকর্ড ঘুরিয়ে তার ওপর চেপে দিলেই গান বাজত।রেকর্ড চলার সময় স্প্রিং ধীরে ধীরে ফুলে উঠলে ফের পাম্প করতে হতো। রেকর্ড ঘূর্ণন কম হলে কণ্ঠের হেরফের হতো। রেকর্ড জোরে ও আস্তে ঘোরানো যেত। জোরে ঘোরালে কথা ও সুর এতই দ্রুত হতো যে হাসি পেত। আস্তে ঘোরালে উল্টো। পাম্প কমে গেলে কথা ও সুর হতো একেবারে ধীর গতিতে।ষাটের দশকে বেতারে গান প্রচারের সময় ঘোষক বলতেন ‘এখন শুনবেন গ্রামোফোন রেকর্ডে গান।’আন্দামান ও ভারত মহাসাগরকে অতিক্রম করে এই উপমহাদেশে কলের গানের প্রথম আগমন ঘটে ভারতের বোম্বে (মুম্বাই) ও কলকাতায়। তারপর আসে বাংলাদেশে।কে প্রথম গ্রামোফোন আনেন এ নিয়ে বিতর্ক আছে। তবে ১৮৯৫ সালে স্বামী বিবেকানন্দ তার বন্ধুর কাছ থেকে গ্রামোফোন উপহার পান।কলকাতার বেলিয়াঘাটায় এশিয়ার প্রথম রেকর্ড কারখানা স্থাপিত হয় ১৯০৮ সালের ১৯ জুন। সেখানে গ্রামোফোন যন্ত্র ও খুচরা পার্টসও তৈরি হতো। গান পিপাসুদের জন্য রবীন্দ্র সঙ্গীত, নজরুল গীতি, বাংলা গীত, নাটক, কৌতুক সবই রেকর্ড হতে থাকে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের নিজের কণ্ঠের গান রেকর্ড করা হয়।তখন বেশির ভাগ রেকর্ড ছিল প্রতি মিনিটে ৭৮ বার ঘূর্ণনের। এই রেকর্ডকে বলা হতো ৭৮ আরপিএম (রিভলভিং পার মিনিট)। এইচএমভি, কলাম্বিয়া, টুইন কোম্পানির রেকর্ড চলত বেশি।ঐতিহাসিক পালা সিরাজউদ্দৌলা, চাঁদ সওদাগর, শৈলজানন্দের শহর থেকে দূরে নাটকের রেকর্ড ব্যাপক প্রচার পায়। তবে উপমহাদেশে সবচেয়ে বেশি চলে বাট শেফার্ডের হাসির গানের রেকর্ড। ৫ লাখ কপি বিক্রি হয়।