জন্মভূমি রিপোর্ট : পেঁয়াজ, রসুন, আলু, বেগুন ও ইলিশের মতো দেশে উৎপাদিত পণ্যের দাম উর্দ্ধমূখী। গত এক বছরে পণ্যগুলোর দাম বেড়েছে অন্তত দুই-তিন গুণ। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের নিম্নমুখী কারণে মূল্যস্ফীতি কমেছে বিশ্বের দেশে দেশে। ব্যতিক্রম ছিল বাংলাদেশ। ২০২৩ সালজুড়ে উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে নাজেহাল ছিল দেশের সাধারণ মানুষ। বছর শুরুর মাস তথা জানুয়ারিতে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৮ দশমিক ৫৭ শতাংশ। আর নভেম্বরে এসে সে মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৪৯ শতাংশে দাঁড়ায়। মাঝে অক্টোবরে মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ পর্যন্ত উঠেছিল। তবে মূল্যস্ফীতির প্রকৃত হার সরকার প্রকাশিত এ পরিসংখ্যানের চেয়ে অনেক বেশি বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদদের অনেকে। তারা বলছেন, টাকার অবমূল্যায়ন ও ডলার সংকটে আমদানি কমে বিদেশ থেকে আনা পণ্যের দাম বেড়েছে। এর প্রভাব পড়েছে পেঁয়াজ, রসুন, আলু, বেগুন ও ইলিশের মতো দেশে উৎপাদিত পণ্যের বাজারেও। গত এক বছরে পণ্যগুলোর দাম বেড়েছে অন্তত দুই-তিন গুণ। নিত্যদিনের অপরিহার্য পণ্যের দাম বেড়ে চলায় চাপে পড়েছে সাধারণ মানুষের সঞ্চয়। আর অর্থনীতির ভিতকে দুর্বল করছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ক্রমাগত ক্ষয়। শ্লথ হয়ে এসেছে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের দুই প্রধান উৎস রফতানি আয় ও রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধিও। এতে প্রায় দুই বছর ধরে চলে আসা ডলার সংকট আরো তীব্র হচ্ছে। আমদানি ২০ শতাংশের বেশি কমিয়েও এ সংকট কাটাতে পারছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাংক খাতেও তীব্র হয়ে উঠেছে তারল্য বা নগদ টাকার সংকট। বেসরকারি বিনিয়োগ স্থবির। দেশী-বিদেশী উৎস থেকে ঋণ বাড়ছে সরকারের। বিপরীতে কমছে রাজস্ব আহরণ। অর্থ সংকটে পড়ে বিদ্যুৎ, সারসহ বিভিন্ন খাতের ভর্তুকি ও প্রণোদনার অর্থও পরিশোধ করতে পারছে না সরকার। চতুর্মুখী এসব সংকটের মধ্যে দেশের পুঁজিবাজারও গোটা বছর পার করেছে স্থবিরতায়।
বিদায়ী ২০২৩ সাল নিয়ে বিশেষজ্ঞদের পর্যবেক্ষণ হলো এ সময় অর্থনীতির অনেক সংকট আরো গভীর হয়েছে। বর্তমানে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে সৃষ্ট উদ্বেগজনক পরিস্থিতি। গ্রহণযোগ্য নির্বাচন প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের সঙ্গে সরকারের মতবিরোধ বাড়লে নতুন বছরে এ সংকট আরো তীব্র হয়ে ওঠার বড় আশঙ্কা রয়েছে। বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা বা বিধিনিষেধের মতো কঠোর কোনো পদক্ষেপ দেশের অর্থনীতিতে বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। তবে সবকিছুই নির্ভর করবে ২০২৪ সালের প্রথম প্রান্তিকের (জানুয়ারি-মার্চ) পরিস্থিতির ওপর। সরকার যদি নির্বাচন-পরবর্তী পরিস্থিতি সামাল দিতে পারে, তাহলে দেশের অর্থনীতিও ঘুরে দাঁড়াবে।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে অন্তত ৪০ শতাংশ ভোটারকে অংশ নিতে হবে। সেক্ষেত্রে সরকার এ নির্বাচনকে পশ্চিমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হিসেবে তুলে ধরার সুযোগ পাবে। আমার মনে হয়, সরকার সে চেষ্টাই করছে। নির্বাচন-পরবর্তী সংঘাত-সহিংসতা ঠেকানো সম্ভব না হলে দেশের অর্থনীতির জন্য ২০২৪ সাল হবে ভয়ংকর বছর।’
তিনি বলেন, ‘২০২২ সালে শুরু হওয়া অনেক সংকট ২০২৩ সালে এসে আরো গভীর হয়েছে। এর অন্যতম কারণ উচ্চ মূল্যস্ফীতি। বাংলাদেশ ব্যাংক এখন বাজার থেকে ডলার কিনে রিজার্ভ বাড়িয়েছে। আইএমএফের শর্ত পরিপালনের অংশ হিসেবে এটি করা হয়েছে। তবে আমরা দেখতে চাই, জানুয়ারিতে যাতে রিজার্ভে অস্বাভাবিক পতন না হয়। রিজার্ভ হলো যেকোনো দেশের অর্থনীতির মনস্তাত্ত্বিক শক্তি। রিজার্ভ বাড়লে বিদেশীদের আস্থা বাড়ে। অর্থনীতিও ঘুরে দাঁড়ানোর সাহস পায়।’
বছরজুড়েই ক্রমাগত ক্ষয় হয়েছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের। ২০২২ সাল শেষে দেশের গ্রস রিজার্ভ ছিল ৩৩ দশমিক ৯৩ বিলিয়ন ডলার। গত ১৩ ডিসেম্বর তা ২৪ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। তবে বছরের শেষ দুই সপ্তাহে বৈদেশিক ঋণ ও বাজার থেকে ডলার কেনার মাধ্যমে রিজার্ভ প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ২৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব হিসাবায়ন পদ্ধতি অনুযায়ী গ্রস রিজার্ভের পরিমাণ ২৬ দশমিক ৮২ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়। তবে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী (বিপিএম৬) দেশের গ্রস রিজার্ভ এখন ২১ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন ডলার। আর নিট রিজার্ভ রয়েছে ১৭ বিলিয়ন ডলারের ঘরে।
বিদায়ী বছরের পুরো সময়েই ডলার সংকটে ছিল দেশের ব্যাংক খাত। কার্ব মার্কেট বা খুচরা বাজারেও ছিল ডলারের হাহাকার। ফলে বছরজুড়েই ডলারের বিনিময় হার ছিল অস্থিতিশীল। কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনুমোদিত দর অনুযায়ী, ২০২৩ সালের প্রথম দিন তথা ১ জানুয়ারি দেশের ব্যাংক খাতে প্রতি ডলারের বিনিময় হার ছিল ১০৭ টাকা। আর ২৮ ডিসেম্বর ডলারের এ দর ১১০ টাকা বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে জানানো হয়েছে। যদিও ঘোষিত এ দরের সঙ্গে বাজার পরিস্থিতির কোনো সামঞ্জস্য নেই। ব্যাংকগুলো রেমিট্যান্স আনার ক্ষেত্রে ডলারপ্রতি ১২৪-১২৫ টাকা পর্যন্ত পরিশোধ করছে। আর আমদানিকারকদের কাছে ডলার বিক্রি করা হচ্ছে আরো বেশি দরে। কার্ব মার্কেটে প্রতি ডলার ১২৬-১৩০ টাকায় ওঠানামা করছে।
ডলার সংকট কাটাতে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করে আসছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০২২-২৩ অর্থবছরে আমদানি প্রায় ১৬ শতাংশ কমে গিয়েছিল। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) আমদানি আরো ২০ দশমিক ৫৪ শতাংশ কমেছে। গত অর্থবছরে দেশের মোট আমদানি ছিল ৬৯ দশমিক ৪৯ বিলিয়ন ডলার। এর আগে ২০২০-২১ অর্থবছরে রেকর্ড ৮৯ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছিল। ওই অর্থবছরের আমদানি আমলে নিয়ে চলতি অর্থবছরে দেশের আমদানি ব্যয় প্রায় ৪০ শতাংশ কমে গেছে। তার পরও বৈদেশিক লেনদেন ভারসাম্যের (ব্যালান্স অব পেমেন্ট বা বিওপি) ঘাটতি কমাতে পারছে না বাংলাদেশ ব্যাংক। অক্টোবর শেষে দেশের বিওপির ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৮৩ কোটি ডলারে।
দেশে যে পরিমাণ ডলার ঢুকছে, বেরিয়ে যাচ্ছে তার চেয়ে বেশি। এতে বড় হচ্ছে দেশের ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট বা আর্থিক হিসাবের ঘাটতিও। অক্টোবর শেষে এ ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৩৯৬ কোটি ডলারে। ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টের বড় ঘাটতি দেশের অর্থনীতিতে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষণ হলো বেসরকারি খাত থেকে স্বল্পমেয়াদি বিদেশী ঋণের উল্লেখযোগ্য অংশ চলে যাওয়া, নতুন করে বিদেশী ঋণ আসার প্রবণতা কমে যাওয়া, পুঁজিবাজার থেকে বিদেশী বিনিয়োগ প্রত্যাহার ও বিদেশী দান-অনুদান কমে যাওয়ার কারণেই এ ঘাটতি বড় হচ্ছে।
বিদেশী বিনিয়োগের প্রবাহে দেখা যাচ্ছে নিম্নমুখী প্রবণতা। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রকাশিত অর্ধবার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, গত জুনে সমাপ্ত ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে নিট প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ (এফডিআই) কমেছে আগের অর্থবছরের তুলনায় সাড়ে ৫ শতাংশ। আর নতুন বিদেশী মূলধনি বিনিয়োগ কমেছে প্রায় ৪১ শতাংশ। আবার ২০২৩ সালের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকেও দেশী-বিদেশী নতুন বিনিয়োগ প্রস্তাব নিম্নমুখী ছিল বলে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) সূত্রে জানা গেছে। শ্লথ হয়ে এসেছে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান দুই মাধ্যম রফতানি আয় ও রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধিও। চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) রফতানি আয়ে প্রবৃদ্ধির হার মাত্র ১ দশমিক ৩০ শতাংশ। আর একই সময়ে রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি আটকে রয়েছে দশমিক ১৭ শতাংশে। যদিও গত তিন বছরে দেশ থেকে প্রায় ২৫ লাখ বাংলাদেশী শ্রমিক অভিবাসী হয়েছেন। ডলার সংকটের পাশাপাশি দেশের ব্যাংক খাতে নগদ টাকার সংকটও এখন তীব্র হয়ে উঠেছে। এ সংকটের কারণে দেশের কলমানি বাজারের সুদহার সাড়ে ১২ শতাংশ পর্যন্ত উঠে গেছে। গত ২৮ ডিসেম্বর ওভার নাইট বা একদিন মেয়াদি ধারের সুদহার ছিল ৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ। কলমানি বাজারের বিদ্যমান সুদহার এক বছর আগের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ।
তবে উচ্চ সুদ ও তীব্র চাহিদা সত্ত্বেও প্রত্যাশা অনুযায়ী কলমানি বাজারে টাকা মিলছে না। এ কারণে বেশির ভাগ ব্যাংক রেপো, স্ট্যান্ডিং লেন্ডিং ফ্যাসিলিটি (এএলএস) ও লিকুইডিটি সাপোর্ট সুবিধার আওতায় বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছে। ২৮ অক্টোবর কলমানি বাজারে মোট লেনদেন ছিল ৪ হাজার ৫২৮ কোটি টাকা। একই দিন বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা ব্যাংকগুলো ধার করেছে। তিন মাস ধরেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে দেশের ব্যাংকগুলোর ধার নেয়ার প্রবণতা বাড়ছে। এক্ষেত্রে দৈনিক ধারের পরিমাণ ছিল ১৫ থেকে ২৫ হাজার কোটি টাকা। তারল্য সংকটের কারণে দেশের ব্যাংক খাতে ঋণের সুদহার ক্রমাগত বাড়ছে। ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে ২০২০ সালের ১ এপ্রিল থেকে ব্যাংক ঋণের সর্বোচ্চ সুদ ৯ শতাংশ নির্ধারণ করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ঋণপ্রাপ্তির শর্ত পূরণের অংশ হিসেবে চলতি বছরের মাঝামাঝি ৯ শতাংশের ঊর্ধ্বসীমা তুলে নেয়া হয়। এখন প্রতি মাসের শুরুতে সিক্স মান্থস মুভিং অ্যাভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিল বা স্মার্ট রেট ঘোষণা করা হচ্ছে। চলতি ডিসেম্বরের জন্য ঘোষিত স্মার্ট রেট ৭ দশমিক ৭২ শতাংশ। ব্যাংকগুলো এর সঙ্গে অতিরিক্ত ৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ সুদ যুক্ত করতে পারে। ফলে চলতি ডিসেম্বরে ব্যাংক ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার দাঁড়ায় ১১ দশমিক ৪৭ শতাংশে। আর গাড়ি-বাড়ি কেনা বা ভোক্তা ঋণের ক্ষেত্রে ঋণের সুদহার ১২ দশমিক ৪৭ শতাংশ। ২০২৪ সালের শুরুতে ব্যাংক ঋণের সুদহার আরো বাড়বে। কারণ এরই মধ্যে ট্রেজারি বিলের সুদহার ১১ শতাংশ ছাড়িয়েছে। ট্রেজারি বিলের গড় সুদহারের সঙ্গে অতিরিক্ত ৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ সুদ যুক্ত করলে ঋণের সুদহার ১৩ শতাংশ ছাড়াবে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি কমানোর কথা বলে ২০২৩ সালে কয়েক দফায় নীতি সুদহার বা রেপো রেট বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সর্বশেষ গত ২৬ নভেম্বরও রেপো রেট ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়ানো হয়। বর্তমানে রেপো রেট ৭ দশমিক ৭৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।
রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার পাশাপাশি ব্যাংকে ডলার ও তারল্য সংকটের কারণে দেশের বেসরকারি খাতের নতুন বিনিয়োগ থমকে আছে। ২০২২ সালের অক্টোবর থেকে চলতি বছরের একই সময় পর্যন্ত বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ। বেসরকারি খাতে বিদেশী বিনিয়োগও সংকুচিত হয়ে এসেছে। এ কারণে দেশে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে স্থবিরতা চলছে। বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমলেও দেশী-বিদেশী উৎস থেকে সরকারের ঋণ বাড়ছে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে বিদেশী উৎস থেকে সরকারের ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৭৫ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলার। আর অক্টোবর পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সরকারের ঋণ স্থিতি ৭ লাখ ৯২ হাজার ৩৩৬ কোটি টাকায় গিয়ে ঠেকেছে। এর মধ্যে ৩ লাখ ৬৮ হাজার ৩১৬ কোটি টাকার ঋণ নেয়া হয়েছে ব্যাংক খাত থেকে। প্রত্যাশা অনুযায়ী রাজস্ব বাড়াতে না পারলেও ঋণ পরিশোধে সরকারের ব্যয় বাড়ছে। এ ব্যয় এরই মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) ব্যয়কে ছাড়িয়ে গেছে বলে আইএমএফের পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের হিসাব বলছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে এডিপি বাস্তবায়নে সরকার ১ লাখ ৯৯ হাজার ৯৯ কোটি টাকা ব্যয় করেছে। আর আইএমএফের হিসাব অনুযায়ী, এ সময় দেশী-বিদেশী ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে সরকারের ব্যয় হয়েছে ২ হাজার ৩৩৩ কোটি ডলার। বাংলাদেশী মুদ্রায় এর পরিমাণ দাঁড়ায় ২ লাখ ৩১ হাজার ৯৬৭ কোটি টাকা (গত অর্থবছরে বাংলাদেশ ব্যাংক নির্ধারিত ডলারের গড় বিনিময় হার ৯৯ টাকা ৪৫ পয়সা হিসাব করে)। ঋণের কিস্তি ও সুদ পরিশোধে ব্যয় বাড়ায় উন্নয়ন খাতের প্রবৃদ্ধিতে লাগাম টেনে ধরতে হচ্ছে সরকারকে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে আগের হিসাব বছরের তুলনায় উন্নয়ন খাতে সরকারের ব্যয় বেড়েছে মাত্র ৮ হাজার ৭৬৭ কোটি টাকা। অন্যদিকে এ সময়ে পরিচালন খাতে সরকার ৩ লাখ ৬১ হাজার ২১ কোটি টাকা ব্যয় করেছে, যার মধ্যে ৮৩ হাজার ৯৪৪ কোটি টাকাই ব্যয় হয়েছে ঋণের সুদ পরিশোধে। ঋণসহ অন্যান্য খাতে সরকারের ব্যয় বাড়লেও রাজস্ব আহরণ সেভাবে বাড়ছে না। গত অর্থবছরে সরকার ৩ লাখ ২৭ হাজার ৬৮৪ কোটি টাকার কর রাজস্ব (এনবিআর ও এনবিআর-বহির্ভূত) আহরণ করতে পেরেছে। আগের অর্থবছরে আয় হয়েছিল ২ লাখ ৯৯ হাজার ৬২২ কোটি টাকার কর রাজস্ব। এক্ষেত্রে রাজস্ব আয়ের পরিমাণ বাড়লেও তা প্রত্যাশিত হারে হয়নি। পূরণ হয়নি আইএমএফের বেঁধে দেয়া রাজস্ব আহরণ লক্ষ্যমাত্রাও। চলতি (২০২৩-২৪) অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসেও (জুলাই-নভেম্বর) রাজস্ব আয় পরিস্থিতি সন্তোষজনক নয়। এ সময় এনবিআরের মাধ্যমে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য ছিল ১ লাখ ৪৮ হাজার ৭৯৪ কোটি টাকা। এর বিপরীতে আহরণ হয়েছে ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা। ঘাটতির পরিমাণ ১৬ হাজার ৪৫৯ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে এনবিআরের মাধ্যমে ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য রয়েছে সরকারের। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় চলতি অর্থবছরেও রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য পূরণ না হওয়ার আশঙ্কা করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। এ লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আয় করতে না পারলে সরকারের ওপর ঋণ পরিশোধের অর্থ জোগানের চাপ আরো বাড়বে বলে মনে করছেন তারা।
অনিয়ম-দুর্নীতি আর বড় বড় আর্থিক কেলেঙ্কারির সংবাদে ২০২৩ সালজুড়েই সমালোচিত ছিল দেশের ব্যাংক খাত। এর মধ্যে শরিয়াহভিত্তিক কয়েকটি ব্যাংকের তারল্য সংকট, সিআরআর, এসএলআর সংরক্ষণে ব্যর্থতাসহ নানা অনিয়মের সংবাদ গ্রাহকদের আস্থায় চিড় ধরিয়েছে। অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে বিতরণ করা ঋণ আদায় করতে পারছে না ব্যাংকগুলো। আবার অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে অনেক ভালো গ্রাহকও ব্যাংকে খেলাপি হয়ে যাচ্ছে। এ কারণে বিদায়ী বছরজুড়ে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে। গত সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৭ কোটি টাকা। তবে পুনঃতফসিল করা ঋণসহ বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে দুর্দশাগ্রস্ত ঋণের পরিমাণ প্রায় ৪ লাখ কোটি টাকা বলে আইএমএফের প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘২০২৩ সালজুড়ে দেশের ব্যাংক খাত নানামুখী চ্যালেঞ্জের মধ্যে ছিল। উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও ডলারের সংকট আগে থেকেই ছিল। এগুলো নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। এখন নতুন করে তারল্য সংকটও তৈরি হয়েছে। আমরা দেখেছি, সুশাসনের ঘাটতি তৈরি হওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটি বেসরকারি ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দিয়েছে। আবার শরিয়াহভিত্তিক কিছু ব্যাংকের অনিয়মের সংবাদ গ্রাহককে আতঙ্কিত করেছে। ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ও মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণের পরিমাণ বাড়ছে।’
২০২৪ সাল ব্যাংক খাতের জন্য আরো বেশি চ্যালেঞ্জিং হবে বলে মনে করেন সৈয়দ মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচন, শ্রম অধিকার ইস্যুসহ কিছু বিষয়ে পশ্চিমাদের সঙ্গে মতবিরোধ চলছে। এ বিরোধ আরো বাড়লে দেশের অর্থনীতি ও ব্যাংক খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমদানি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার সংকট কমানোর চেষ্টা করছে। দুই বছর ধরে আমদানি কমছে। এটি আরো দীর্ঘায়িত হলে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষতি অনেক বেড়ে যাবে। অনেক শিল্পের উৎপাদন থমকে যাবে। নতুন বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে না। আর ব্যাংক খাতে সুশাসন ফেরাতে সংস্কার অতিজরুরি হয়ে পড়েছে। সুশাসন না থাকলে কোনো প্রতিষ্ঠানই শক্তিশালী হতে পারবে না।
২০২৩ সালজুড়েই স্থবির ছিল দেশের পুঁজিবাজার। ২০২২ সাল শেষে দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সার্বিক সূচক ডিএসইএক্স ছিল ৬ হাজার ২০৭ পয়েন্টে। এ বছরের শেষ কার্যদিবসে সূচকটি দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ২৪৭ পয়েন্টে। অর্থাৎ পুরো এক বছরে এ সূচক বেড়েছে মাত্র ৪০ পয়েন্ট বা দশমিক ৬ শতাংশ। এ সময়ে বাজার মূলধন বেড়েছে মাত্র ২ দশমিক ৬ শতাংশ। সংকট সত্ত্বেও ২০২২ সালে দেশের ডিএসইতে দৈনিক গড় লেনদেন ছিল ৯৬০ কোটি টাকা। এ বছর গড় লেনদেন মাত্র ৫৭৮ কোটি টাকায় নেমে এসেছে। বছরজুড়ে লেনদেন কমেছে প্রায় ৪০ শতাংশ। আর আগের বছরের তুলনায় ২০২৩ সালে শেয়ার লেনদেনের পরিমাণ কমেছে ৪২ শতাংশ। দেশের আরেক পুঁজিবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সার্বিক সূচক সিএএসপিআই এ বছর মাত্র ১ শতাংশ বেড়েছে। অন্যদিকে এক্সচেঞ্জটির দৈনিক গড় লেনদেনের পরিমাণ ২৩ শতাংশ ও শেয়ার লেনদেনের পরিমাণ ৩৮ শতাংশ কমেছে।