জন্মভূমি ডেস্ক : সরকারকে অর্থনৈতিক নীতিসংক্রান্ত দিকনির্দেশনার সক্ষমতা বাড়াতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংস্কার চায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। বিশেষ করে অর্থ বিভাগের কর্মকর্তাদের দক্ষতার ঘাটতি কমানো এবং বদলির প্রবণতা হ্রাসের সুপারিশ করেছে সংস্থাটি। সম্প্রতি প্রকাশিত উচ্চপর্যায়ের কারিগরি সহায়তা প্রতিবেদনে তারা এ মতামত দিয়েছে।
অর্থ বিভাগের সক্ষমতা বাড়ানো ও মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক কাঠামোর (এমটিএমএফ) উন্নয়নে গত বছরের ২২ জানুয়ারি থেকে ১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আইএমএফের একটি কারিগরি মিশন বাংলাদেশ সফর করে। মিশনটি অর্থ বিভাগের বিদ্যমান সামষ্টিক অর্থনৈতিক পূর্বাভাব ও নীতি বিশ্লেষণ পদ্ধতির মূল্যায়ন করেছে। এ সময় তারা আর্থিক প্রোগ্রামিংয়ের ওপর একটি প্রশিক্ষণও দিয়েছে।
আইএমএফের কারিগরি মিশনের প্রতিবেদনে বেশকিছু বিষয় চিহ্নিত এবং কিছু বিষয়ে সুপারিশও করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, এমটিএমএফ তৈরি এবং সেটি নীতিনির্ধারকদের কাছে উপস্থাপনের ক্ষেত্রে অর্থ বিভাগের প্রতিষ্ঠিত একটি কাঠামো রয়েছে। অর্থ বিভাগের সামষ্টিক অর্থনীতি অনুবিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে একই মন্ত্রণালয়ের অন্যান্য কারিগরি দল ও অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে ভালো পেশাদারি সম্পর্ক রয়েছে।
সামষ্টিক অর্থনীতি অনুবিভাগের কর্মকর্তাদের দক্ষতা থাকলেও তাদের সংখ্যা তুলনামূলক কম এবং বদলি হয়ে যাওয়ার বিষয়টিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছে আইএমএফ। এ বিষয়ে সংস্থাটি বলছে এ অনুবিভাগের অধিকাংশ কর্মকর্তার অর্থনীতি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে স্নাতকোত্তর কিংবা পিএইচডি ডিগ্রি রয়েছে। এর ফলে তাদের অর্থনৈতিক বিষয়ে ভালো সাধারণ তাত্ত্বিক জ্ঞান ও বিশ্লেষণী দক্ষতা রয়েছে। বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের মধ্যে বদলির প্রথা থাকলেও টেকসই পূর্বাভাস ও নীতি বিশ্লেষণের দক্ষতার জন্য দীর্ঘমেয়াদে এ বিভাগের পদায়নের বিষয়টিকে উপেক্ষা করা উচিত হবে না। তাছাড়া অন্যান্য দেশের অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সংখ্যার তুলনায় বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের সংখ্যা কম বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। সামষ্টিক অর্থনীতি অনুবিভাগের কাছে বেশকিছু সামষ্টিক অর্থনৈতিক কাঠামো ও পূর্বাভাসের হাতিয়ার থাকলেও সেগুলোর বাস্তব প্রয়োগ বেশ সীমিত বলে মনে করছে আইএমএফ।
অর্থ বিভাগের একজন পদস্থ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘বিশ্বের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারীরা আমাদের এখানে কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করছেন। আমাদের প্রকল্পে কিছু পরামর্শক কাজ করছেন, তারাও বেশ ভালো। সব মিলিয়ে আমাদের পূর্বাভাসসংক্রান্ত মডেলটিকে আরো আদর্শ মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছি। এ বিষয়ে শুধু আইএমএফ না, বিশ্বব্যাংকও আমাদের সাহায্য করছে।’
আইএমএফের প্রতিবেদনে বেশকিছু সুপারিশ করা হয়েছে। ধারাবাহিকভাবে এমটিএমএফ পূর্বাভাস প্রস্তুত এবং নীতি ও ঝুঁকি পরিস্থিতির মূল্যায়নের ক্ষেত্রে অনুবিভাগটি সামষ্টিক অর্থনৈতিক কাঠামোর মাধ্যমে উপকৃত হতে পারে। অনুবিভাগটির বিদ্যমান সক্ষমতার দিকে মনোযোগ দেয়া, অন্যান্য অনুবিভাগের কর্মকর্তাদের অংশগ্রহণ বাড়ানো, নতুন কর্মকর্তাদের অন্তর্ভুক্তির ব্যবস্থা এবং নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে আরো কার্যকর আলোচনার সক্ষমতা থাকার সুপারিশ করা হয়েছে।
সাবেক অর্থ সচিব ও সাবেক মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক (সিএজি) মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী বলেন, ‘আমলাতন্ত্রে টার্নওভার সবসময় একটি ইস্যু ছিল এবং এটি বহু পুরনো সমস্যা। তবে আইএমএফের প্রতিবেদনে যে বলা হয়েছে অর্থ বিভাগ বিশেষ করে সামষ্টিক অর্থনীতি অনুবিভাগের কর্মকর্তাদের বেশির ভাগই অর্থনীতিসংশ্লিষ্ট বিষয়ে স্নাতকোত্তর ও পিএইচডিধারী সেটি সম্ভব হয়েছে সরকারের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক দরকষাকষির মাধ্যমে একটি মতৈক্যে পৌঁছানোর মাধ্যমে। এক্ষেত্রে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অর্থনীতিসংশ্লিষ্ট বিষয়ের ডিগ্রিধারী কর্মকর্তাদের অর্থ বিভাগে পদায়ন করা এবং তাদেরকে এ বিভাগে রাখার চেষ্টাও হয়েছে। পদোন্নতিজনিত কারণে কিংবা কেউ যদি স্বেচ্ছায় বদলি হতে চায় এ ধরনের কারণ ছাড়া এখানে কর্মকর্তাদের ধরে রাখার প্রবণতা ছিল। অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের তুলনায় অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের টার্নওভারের হার কম। এ প্রচেষ্টার সফলতার হার ৬০ থেকে ৭০ শতাংশের মতো হবে। তবে সিভিল সার্ভিসে কিছু টার্নওভার তো থাকবেই। যেহেতু ধীরে ধীরে জটিলতা বাড়ছে, অর্থনীতি সমস্যা বাড়ছে, সেহেতু টার্নওভার আরো কমানো সম্ভব হয় কিনা সেটির একটি বন্দোবস্ত দরকার। কিন্তু সিভিল সার্ভিসের বিদ্যমান কাঠামোতে টার্নওভার এর চেয়ে কীভাবে কমানো সম্ভব সেটি আমার জানা নেই।’
সক্ষমতার ঘাটতি ও কর্মকর্তাদের বদলির বিষয়ে নজর দেয়ার ক্ষেত্রে বেশকিছু ব্যবস্থা নেয়ার আছে বলে মনে করছে আইএমএফ। এক্ষেত্রে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, ব্যবহারবান্ধব ব্যবস্থার উন্নয়ন, ভবিষ্যতে যুক্ত হতে যাওয়া কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার সুপারিশ করা হয়েছে। এছাড়া অন্যান্য কারিগরি দলের বড় আকারের অংশগ্রহণের মাধ্যমে মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক কাঠামো তৈরির প্রক্রিয়াকে উন্নত করার সুযোগ রয়েছে বলে মনে করছে সংস্থাটি।
আইএমএফের কারিগরি মিশনের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে বেশকিছু কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে সম্মত হয়েছে অর্থ বিভাগ। এজন্য বিভিন্ন অনুবিভাগের ১৭ জন কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দিয়েছে অর্থ বিভাগ। মেয়াদ ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের জুলাই পর্যন্ত সক্ষমতা বাড়ানোর এ প্রকল্পের অধীনে ১০টি মিশনের পরিকল্পনা রয়েছে। এর মধ্যে প্রত্যক্ষ উপস্থিতির সমন্বয়ে হাইব্রিড মডেল ও ভার্চুয়াল মাধ্যমে এ মিশন সম্পন্ন হবে। চার ধাপে এ প্রকল্পকে ভাগ করা হয়েছে।