ইউরোপ আমেরিকার মার্কেট ভেনামীর দখলে
রফতানি কমে যাওয়ায় আগ্রহ হারাচ্ছেন প্রান্তিক চাষীরা
আগে মাসে শিপমেন্ট হতো ১২ কন্টেনাইর, এখন সর্বোচ্চ ৭ এ ঠেকেছে
জন্মভূমি ডেস্ক : কয়েক বছর আগেও ২০০ লাখ হেক্টর জমিতে দেশীয় সাদা সোনা হিসেবে খ্যাত বাগদা চিংড়ি ও ৭৫ হাজার জমিতে গলদা চিংড়ির চাষ হতো। কিন্তু চিংড়ি চাষ সংকুচিত হয়ে ১ লাখ হেক্টর জমি থেকে দেড়লাখ জমিতে নেমে এসেছে। রপ্তানীকারকরা বলছেন ক্রমাগত লোকসানের কারণে মৎস্য চাষীরা চিংড়ি চাষে আগ্রহ হারাচ্ছে।
রফতানিকারকদের মতে চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে প্রথম ৬ মাসে হিমায়িত চিংড়ি রফতানি করে আয় হয়েছে ১৪ কোটি ৫৯ লাখ ডলার। এর আগের অর্থ বছরের একই সময়ে রফতানি করে আয় হয়েছিল ১৮ কোটি ৩২ লাখ ডলার। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে আয় কমেছে ২০ ভাগের বেশি। কভিড, রাশিয়া-উইক্রেন যুদ্ধ এবং চলমান মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনার কারণে ইউরোপ ও আমেরিকাসহ অন্যান্য দেশে রফতানি অনেকটাই কমেগেছে। এছাড়া বিশ^বাজারে ভেনামি চিংড়ির চাহিদা বেশি থাকায় বাজার হারাচ্ছে দেশীয় বাগদা ও গলদা চিংড়ি।
খুলনা মৎস্য পরিদর্শন ও মান নিয়ন্ত্রণ কার্যালয়ের কোয়ালিটি কন্ট্রোল অফিসার লিপটন সরদার জানান, চলতি অর্থ বছরের প্রথম ছয় মাসে হিমায়িত চিংড়ি রফতানি হয়েছে প্রায় ৯ হাজার ৭১ মেট্রিক টন। যেটা গত ২০২২-২৩ অর্থ বছরে ছিল ১৩ হাজার ২৭১ মেট্রিক টন। অর্থাৎ পরিমাণের দিকে থেকে প্রায় ৩ হাজার মেট্রিক টন রফতানি কম হয়েছে। টাকার অংকে প্রথম ছয় মাসে রফতানির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ২১ কোটি টাকা। চিংড়ি খাতে এই মন্দা দশা চলছে গত কয়েক বছর ধরে।
রফতানিকারকরা বলছেন, হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানির অন্যতম বড় বাজার ইউরোপে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার কারণে চিংড়ি রপ্তানি কমেছে। তবে, এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে চিংড়ির মূল্য সংযোজিত পণ্য তৈরির পরামর্শ দিয়েছে মৎস্য বিভাগ। তারা বলছেন, হিমায়িত চিংড়ি থেকে বহুমুখী পণ্য উৎপাদন করা গেলে বৈদেশিক মুদ্রা আয় বাড়বে। এগিয়ে থাকা যাবে প্রতিযোগিতাতেও।
সি ফুড বায়িং এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব সুজন আহমেদ বলেন, ‘বড় দিন অথবা নতুন ইংরেজি বছরে আমরা ইউরোপের বাজারে ২০০ থেকে ২৫০ কন্টেইনার হিমায়িত চিংড়ি রফতানি করি। কিন্তু এবার ১০০ কন্টেইনারের মতো চিংড়ি রফতানি হয়েছে। যে কারণে রফতানিতে আমরা আরো পিছিয়ে গেছি। আবার আমরা অন্য দেশের উৎপাদিত ভেনামি চিংড়ির সঙ্গেও পেরে উঠছি না। এর কারণ হচ্ছে আমাদের উৎপাদিত বাগদা ও গলদা চিংড়ির দাম অনেক বেশি। সেখানে অন্য দেশ থেকে অর্ধেক দামে আমদানিকারকরা ভেনামি চিংড়ি কিনছে। ফলে আমরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি’।
বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএফইএ) ভাইস প্রেসিডেন্ট এস হুমায়ুন কবির বলেন, বাংলাদেশের চিংড়ি রফতানি আয় কমে যাওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে, গত কয়েক বছর ধরে বিশ^ অর্থনৈতিক মন্দার কারণে বাংলাদেশ থেকে যে চিংড়ি রফতানি হয়, তার যে মূল্য পাওয়া উচিত ছিল-সেটা আমরা পাচ্ছি না। ফলে আমাদের দেশের চিংড়ি চাষিরা তাদের উৎপাদন খরচ ওঠাতে পারছে না। এ কারণে বহু চাষি তাদের চিংড়ি উৎপাদন বন্ধ করে ব্যবসা সংকুচিত করেছে।
এছাড়া, বাংলাদেশ থেকে মূলত দু’ধরনের চিংড়ি বিদেশে রফতানি হয়। যার একটি হচ্ছে বাগদা। অন্যটি গলদা। বাগদা ও গলদা চিংড়ির উৎপাদন খরচ অনেক বেশি। অন্যদিকে ভেনামি চিংড়ির উৎপাদন খরচ অনেক কম। ফলে যে সমস্ত দেশ ভেনামি চিংড়ি উৎপাদন করে তারা অল্পমূল্যে বিদেশের বাজারে সেই চিংড়ি রফতানি করতে পারে। বিশ^ অর্থনীতির মন্দার কারণে ভেনামি চিংড়ির চাহিদা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের সে সুযোগ নেই।
এস হুমায়ুন কবির জানান, একটি জরিপে দেখা গেছে, বিশ^বাজারে ভেনামি চিংড়ির চাহিদা রয়েছে ৭৮ শতাংশ। সেখানে বাগদা চিংড়ির বাজার ১১ শতাংশে নেমে এসেছে। আর গলদা চিংড়ির বাজার মাত্র ৬ শতাংশ। ফলে বিশ^ বাজার ধরতে গেলে ভেনামি চিংড়ি চাষের বিকল্প নেই।
তিনি আরো বলেন, সরকার গত বছর ভেনামি চিংড়ি চাষের অনুমতি দিয়েছে। কিন্তু এখনো ভেনামির পোনা উৎপাদন বাংলাদেশে শুরু হয়নি। চাষিরাও নতুন প্রজাতির চিংড়ি উৎপাদনে ভীতির মধ্যে রয়েছে।
চিংড়ি চাষ কমে যাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, গত কয়েক বছর আগেও ২০০ লাখ হেক্টর জমিতে বাগদা চিংড়ি ও ৭৫ হাজার জমিতে গলদা চিংড়ির চাষ হতো। কিন্তু ক্রমাগত লোকসানের কারণে চিংড়ি চাষ সংকুচিত হয়ে ১ লাখ হেক্টর জমি থেকে দেড়লাখ জমিতে নেমে এসেছে। রফতানি আয় কমে যাওয়ার জন্য এটাও একটা কারণ।
এ ব্যাপারে খুলনা মৎস্য পরিদর্শন ও মান নিয়ন্ত্রণ কার্যালয়ের কোয়ালিটি কন্ট্রোল অফিসার লিপটন সরদার বলেন, চিংড়ির ক্রেডিট শ্রিম্প, ট্রাম্প শ্রিম্প, শ্রিম্প পপকর্ন, শ্রিম্প নাগেট, শ্রিম্প সামুসা, শ্রিম্প সিঙ্গাড়া- এরকম নানান ধরনের প্রোডাক্ট রফতানিকারকরা তৈরি করেছেন। ইতিমধ্যে এসব পণ্য যুক্তরাজ্যের (ইউকে) মার্কেটে কিছু রপ্তানি হয়েছে। আশা করা হচ্ছে, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের বাজারও আমরা ধরতে পারব। এতে করে আমাদের রফতানি আয় বাড়বে।
বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সূত্র জানায়, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দেশ থেকে হিমায়িত চিংড়ি রফতানি করা হয় ৪০ হাজার ৭০২ মেট্রিক টন। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে রফতানি করা হয় ৩৯ হাজার ৭০৬ মেট্রিক টন। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৩৬ হাজার ১৬৮ মেট্রিক টন। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৩৩ হাজার ৩০৬ মেট্রিক টন। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩০ হাজার ৩৬ মেট্রিক টন। ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩০ হাজার ৫৭১ মেট্রিক টন। গত ২০২২-২৩ অর্থ বছরে ছিল ১৩ হাজার ২৭১ মেট্রিক টন। বিগত কয়েক বছরের গড় রপ্তানির হার হ্রাস পেয়েছে প্রায় ১০ শতাংশ করে। এই অবস্থা চলতে থাকলে চিংড়ি রফতানি তলানিতে এসে ঠেকার আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা। একসময় দেশের দ্বিতীয় রপ্তানিযোগ্য পণ্য ছিল চিংড়ি। বর্তমানে তা ৭ নম্বরে এসে দাঁড়িয়েছে।
সূত্র জানায়, দেশে ভেনামি চিংড়ি চাষে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাব রয়েছে। এ মাছ চাষে খামারিদের আগ্রহ থাকলেও বিদেশি জাত হওয়ায় ব্যাপকভাবে চাষের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না। এর পোনা উৎপাদনে হ্যাচারি করারও অনুমতি নেই। আবার খাবারও আনতে হয় দেশের বাইরে থেকে। ফলে ভারতসহ অন্যান্য দেশ যখন ভেনামি দিয়ে বাজার ধরে ফেলছে, তখন আমাদের দেশ পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি কাজী বেলায়েত হোসেন বলেন, খুলনায় চিংড়ি রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৫৯টি। এর মধ্যে ২৩টি চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে।
সূত্র জানায়, ২০১৮ সালে প্রথম পরীক্ষামূলক ভেনামি চাষের অনুমতি দেওয়া হয়। পাইকগাছা উপজেলার নোনাপানি কেন্দ্রে পাইলট প্রকল্পে প্রথম দফায় প্রতি একরে উৎপাদন হয় ৪ হাজার ১০০ কেজি। দ্বিতীয় দফায় উৎপাদন হয় ৪ হাজার ৪৪৫ কেজি। এরপর ২৯ মার্চ বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ভেনামি চাষের অনুমোদন দেওয়া হয় তিনটি প্রতিষ্ঠানকে। এর মধ্যে বটিয়াঘাটায় দুটি ও কয়রায় একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
জানতে চাইলে রফতানিকারক মোঃ শাহীন হাওলাদার বলেন, বাংলাদেশের প্রতিযোগী ভারত, ইকুয়েডর ও ভিয়েতনামে ভেনামি জাতের চিংড়ির ব্যাপক চাষ হচ্ছে। ভেনামি চাষে উৎপাদন খরচ ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ কম হয়। ফলে কম মূল্যে সরবরাহ করার কারণে বাজার দখলে ভেনামির সঙ্গে পেরে উঠছেন না আমাদের দেশের গলদা ও বাগদা চিংড়ি চাষিরা। গলদা ও বাগদা চিংড়ি দিয়ে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা সম্ভব হচ্ছে না। বিশ্ববাজারে ভেনামি চিংড়ি সরবরাহ বৃদ্ধি বাংলাদেশের চিংড়ির দাম ও চাহিদা দুটোই কমিয়ে দিতে ভূমিকা রেখেছে।
খুলনা বিভাগীয় চিংড়ি পোনা ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও গালফ হ্যাচারী মালিক গোলাম কিবরিয়া রিপন বলেন, ভেনামী চিংড়ি চাষে প্রান্তিক চাষীরা ঝুঁকি নিতে চাচ্ছেন না।
খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার চকশৈলমারী গ্রামের আধা নিবিড় চিংড়ি চাষি বিপ্রদাস বৈরাগী বলেন, কোম্পানীগুলো আগেরমতো শিপমেন্ট করতে পারছেন না। ফলে এ অঞ্চলের মৎস্য চাষীরা আগ্রহ হারাচ্ছেন।
জানতে চাইলে রফতানিকারক জেমিনি সি ফুডের জেনারেল ম্যানেজার রিয়াদ বলেন, গতবছরও প্রতি মাসে ১০-১২ টি কন্টেনাইর চিংড়ি শিপমেন্ট করা গেছে। বর্তমানে ৩-৪ কন্টেনাইর শিপমেন্ট করা যাচ্ছেনা। শুধু জেমিনি সি ফুডই নয় অন্যান্য বড় বড় কোম্পানীগুলো ৬-৭টির বেশি কন্টেনাইর শিপমেন্ট করতে পারছেনা। সর্বনিম্ন ১-২ কন্টেনাইরও শিপমেন্ট করছেন কোন কোন কোম্পানী।
তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে আমাদের চিংড়ি ৫ ডলার। অথচ একই ওজন ও একই সাইজের ভেনামী চিংড়ি বিক্রি হচ্ছে ৪ থেকে সাড়ে চার ডলারে। ফলে আমরা বাজার হারাচ্ছি। তা ছাড়া যেখানে আমাদের খামারের এক একর জায়গায় যদি এক কেজি গলদা চিংড়ি উৎপদিত হয় সেখানে একই খামারে ভেনামী চিংড়ি উৎপাদিত হয় ৫ কেজি। সে কারণে আমরা ওদের সাথে টিকতে পারছি না।