জন্মভূমি ডেস্ক : বাংলাদেশ ব্যাংক দেড় বছরের বেশি সময় ধরে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধেও (জুলাই-ডিসেম্বর) আমদানি কমেছে প্রায় ২০ শতাংশ। এর আগে ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা ১৫ দশমিক ৭৬ শতাংশ কমিয়ে আনা হয়েছিল। তবে এবার আর কমানো নয়, বরং আমদানি প্রবৃদ্ধির প্রক্ষেপণ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। দেশের ব্যাংক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি মনে করছে, চলতি অর্থবছরের তৃতীয় প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) আমদানির নতুন ঋণপত্র (এলসি) ৭ দশমিক ৩৩ শতাংশ বাড়বে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরের তৃতীয় প্রান্তিকে ১ হাজার ২৮২ কোটি বা ১২ দশমিক ৮২ বিলিয়ন ডলার মূল্যের আমদানি এলসি খোলা হয়েছিল। চলতি অর্থবছরের একই প্রান্তিকে ১৩ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন ডলারের এলসি খোলার সম্ভাবনা রয়েছে। সেটি হলে চলতি প্রান্তিকে ৯৪ কোটি ডলারের এলসি বেশি খোলা হবে। এর মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে দীর্ঘদিন পর আমদানির এলসি খোলার প্রবৃদ্ধির প্রক্ষেপণ এল।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে এলসি খোলার দাবি জোরালো হচ্ছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতেও আমদানি বাড়ানো জরুরি। বাজারে আমদানিনির্ভর পণ্যের সরবরাহ অনেক কমে গেছে। এ কারণে সেসব পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে। আবার মূলধনি যন্ত্রপাতি ও শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কমে যাওয়ার প্রভাবে রফতানি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সব মিলিয়ে অর্থনীতির চাহিদার নিরিখেই আমদানি বাড়ানোর পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে আমদানি প্রবৃদ্ধির প্রক্ষেপণ জানানো হলেও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখনো স্থিতিশীল হয়নি। দেশের ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট বা আর্থিক হিসাব ও সামগ্রিক লেনদেন ভারসাম্য (বিওপি) এখনো বেশ ঋণাত্মক। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধ শেষে (ডিসেম্বর) আর্থিক হিসাবে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৫৩৯ কোটি ডলার। তীব্র ডলার সংকট সত্ত্বেও গত অর্থবছরের একই সময়ে আর্থিক হিসাবে ১৪ কোটি ডলার উদ্বৃত্ত ছিল। ডিসেম্বর শেষে দেশের বৈদেশিক বিওপি ঘাটতিও ছিল ৩৬৭ কোটি ডলার।
বৈদেশিক বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ এসব নির্দেশকে ঘাটতির কারণে দেশের রিজার্ভের ক্ষয় এখনো অব্যাহত রয়েছে। ২০২১ সালের আগস্টে দেশের গ্রস রিজার্ভ ছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলার। এরপর থেকে তা ধারাবাহিকভাবে কমেছে। সর্বশেষ গত ১৪ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী (বিপিএম৬) গ্রস রিজার্ভের পরিমাণ দেখানো হয়েছে ১৯ দশমিক ৯৩ বিলিয়ন ডলার। তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাবে ওইদিন নিট রিজার্ভ ছিল ১৬ বিলিয়ন ডলারের ঘরে। যদিও বহুজাতিক সংস্থাটির কাছ থেকে ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ প্রাপ্তির শর্ত হিসেবে মার্চের মধ্যে নিট রিজার্ভ ১৯ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার প্রতিশ্রুতি রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, মার্চের প্রথম সপ্তাহে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) মাধ্যমে নিষ্পত্তি হওয়া জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারির আমদানি দায় পরিশোধ করতে হবে। এক্ষেত্রে ১ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলারের বেশি ব্যয় হতে পারে। এ দায় সমন্বয় হলে দেশের গ্রস ও নিট রিজার্ভে আরো বড় ক্ষয় তৈরি হবে।
অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, ‘আমদানি আর কমানো সম্ভব নয়। অর্থনীতির চাহিদা পূরণ করতে হলে তা অবশ্যই বাড়াতে হবে। আমদানির চাহিদা দীর্ঘমেয়াদে চাপিয়ে রাখা যায় না। এতে অর্থনীতির লাভের চেয়ে ক্ষতিই হয় বেশি।’
ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টের ঘাটতি কমানোই এ মুহূর্তে দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, ‘এ হিসাবকে ইতিবাচক ধারায় ফিরিয়ে আনার জন্য পোর্টফোলিও ইনভেস্টমেন্ট ও এফডিআই বাড়ানোর উদ্যোগ জোরালো করা দরকার। একই সঙ্গে রফতানি ও রেমিট্যান্স বাড়াতে সম্ভাব্য সব বিকল্প খুঁজে বের করতে হবে। দেশ থেকে অর্থ পাচারের বিষয়ে সরকারকে কঠোর হতে হবে। ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট ইতিবাচক ধারায় ফিরলে তবেই দেশের রিজার্ভ বাড়বে।’
দেশে ডলারের সংকট ২০২১-২২ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধ থেকেই দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। এরপর সংকট আরো তীব্র হয়ে উঠলে ২০২২-২৩ অর্থবছরের শুরু থেকে আমদানি নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগ নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কঠোর করা হয় এলসি খোলার শর্ত। ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশের আমদানিতে রেকর্ড ৩৫ দশমিক ৯৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয় এবং তা ৮২ দশমিক ৪৯ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। রেকর্ড এ আমদানির চাপে দেশের বৈদেশিক লেনদেন ভারসাম্যে সৃষ্টি হয় বড় ধরনের অস্থিরতা। ব্যাংকগুলোয় তৈরি হয় তীব্র ডলার সংকট। এ পরিপ্রেক্ষিতে আমদানি এলসি মার্জিন শতভাগে উন্নীত করার পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে তদারকি জোরদার করা হয়। এতে গত অর্থবছরে আমদানি কমে যায় ১৫ দশমিক ৭৬ শতাংশ। ওই সময় মোট ৬৯ দশমিক ৪৯ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হয়। নিয়ন্ত্রণের কারণে চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধেও (জুলাই-ডিসেম্বর) আমদানি ১৯ দশমিক ৮০ শতাংশ কমেছে। এ সময়ে পণ্য আমদানি হয়েছে ৩০ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলারের।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে দেশে প্রায় সব পণ্যেরই আমদানি কমেছে। এ সময়ে ভোগ্যপণ্যের এলসি খোলা কমেছে ২১ দশমিক ৬৫ শতাংশ। একই সময়ে ভোগ্যপণ্যের নিষ্পত্তিও ২২ দশমিক ৫২ শতাংশ কমেছে। শিল্পের মধ্যবর্তী পণ্যের আমদানি এলসি খোলা ১২ দশমিক ৭৮ ও নিষ্পত্তি ১০ দশমিক ১৮ শতাংশ কমেছে। শিল্প খাতের কাঁচামাল আমদানির পরিস্থিতি আরো খারাপ। চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে কাঁচামাল আমদানির এলসি খোলা কমেছে ১০ দশমিক ১৯ শতাংশ। আর এ খাতের এলসি নিষ্পত্তি ৩১ শতাংশেরও বেশি কমে গেছে। চলতি অর্থবছরে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির এলসি ১ দশমিক ৩০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলেও নিষ্পত্তি কমেছে প্রায় ২৭ শতাংশ।
আমদানি কমিয়ে আনার প্রভাবে দেশের বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণও কিছুটা কমেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে ঘাটতির পরিমাণ ৪ দশমিক ৫৯ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। গত অর্থবছরের একই সময়ে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল ১২ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলার। দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান দুই উৎস রফতানি ও রেমিট্যান্স প্রবাহে বেশ স্থবিরতা চলছে। চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে রফতানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে দশমিক ৬৪ শতাংশ। একই সময়ে রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২ দশমিক ৯১ শতাংশ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বলেন, ‘অর্থনীতির কল্যাণেই আমদানি নিয়ন্ত্রণ জরুরি ছিল। আমদানি কমিয়ে আনা সত্ত্বেও বাজারে কোনো পণ্য পাওয়া যাচ্ছে না, এমনটি দেখা যায়নি। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, শিল্পের সম্প্রসারণ ও ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বার্থে যা করা দরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক সেটিই করেছে। অর্থনীতির চাহিদার নিরিখে প্রয়োজনে আমদানি আবারো বাড়ানো হবে।’
আমদানির নতুন ঋণপত্র ৭ দশমিক ৩৩ শতাংশ বাড়বে
Leave a comment