রিপনচন্দ্র মল্লিক, মাদারীপুর : অবৈধ ভাবে সমুদ্রপথে ইতালি যাওয়ার সময় ভূমধ্যসাগরে তিউনিশিয়ার জলসীমানায় ইঞ্জিন চালিত নৌকা ডুবে মাদারীপুরের তিন যুবক মারা গেছেন। এদের মধ্যে একজন সদর উপজেলার এবং অন্য দুজন রাজৈর উপজেলার বাসিন্দা। এছাড়া জেলার গোপালগঞ্জের মকসুদপুর উপজেলার আরেক যুবক এখন নিখোঁজ রয়েছেন। নিহতদের স্বজনরা এসব তথ্য জানিয়েছেন।
শুক্রবার (১৬ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে ওই ৩ যুবকের মৃত্যুর খবর আসলে এলাকা জুড়ে শোকের ছায়া নেমে আসে। আদরের সন্তানদের হারিয়ে দিশেহারা পরিবার। এ ঘটনায় দালালের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন স্বজন ও এলাকাবাসী।
নিহতরা হলেন- মাদারীপুর সদর উপজেলার পাঁচখোলা ইউনিয়নের পশ্চিম পাঁচখোলা গ্রামের আলী আকাব্বরের ছেলে সম্রাট (২৫), রাজৈর উপজেলার খালিয়া ইউনিয়নের পশ্চিম স্বরমঙ্গল গ্রামের ইউসুফ আলী শেখের ছেলে মামুন শেখ (২১) ও সেনদিয়া গ্রামের সুনীল বৈরাগীর ছেলে সজল বৈরাগী (২৫)। এছাড়া নিখোঁজ রয়েছেন গোাপলগঞ্জের মকসুদপুর উপজেলার গোহালা ইউনিয়নের পান্নু শেখের ছেলে আপন শেখ।
নিহত সম্রাটের স্বজনদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, প্রায় ৫ মাস আগে মাদারীপুরের রাশেদ খান নামে এক দালালের মাধ্যমে মো. সম্রাট ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে পাড়ি দিয়েছিল ইতালির পথে। অভিযুক্ত দালাল রাশেদ খান সম্রাটের পরিবারের কাছ থেকে ৭ লাখ টাকা নেয়। পরে ঢাকা থেকে তাকে নেওয়া হয় লিবিয়ায়। সেখানে একটি বন্দী শিবিরে আটকে রাখা হয়। চালানো হয় নির্যাতন। ঠিকমতো খাবারও দেওয়া হতো না। এরপর আজ হঠাৎ করেই খবর আসে সম্রাট মারা গেছেন।
সম্রাটের ভাই আজগর বলেন, ‘কতগুলো টাকা খরচ করে ভাইকে বিদেশ পাঠিয়েছি। এখন আমার ভাই নাই। সে মারা গেছে। এখন টাকাও গেলো, ভাইও গেলো। আমরা এর বিচার চাই, দালালরা আমার ভাইকে মেরে ফেলছে। এখন আমরা কী করবো কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না।’
জানা গেছে, মাদারীপুরে দালাল রাশেদ খান ও তার ভাই টুলু লোকজনকে প্রলোভন দেখিয়ে ইতালি নেওয়ার কথা বলে লিবিয়ায় নিয়ে নির্যাতন করে। তার বিরুদ্ধে মাদারীপুর ও শরীয়তপুরে একাধিক মামলা রয়েছে।
এদিকে রাজৈরে নিহত দুই যুবকের স্বজনদের কাছ থেকে জানা গেছে, গত ১৪ জানুয়ারি মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার খালিয়া ইউনিয়নের পশ্চিম স্বরমঙ্গল গ্রামের ইউসুফ আলী শেখের ছেলে মামুন শেখ ও সেনদিয়া গ্রামের সুনীল বৈরাগীর ছেলে সজল বৈরাগীসহ বেশ কয়েকজন যুবক ইতালীর উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বের হয়। পরে গত বুধবার লিবিয়া থেকে একটি ইঞ্জিনচালিত নৌকায় রওনা দেয় তারা। ৩২ জন ধারণ ক্ষমতার নৌকায় ৫২ জন অভিবাসন প্রত্যাশীকে নিয়ে রওয়ানা দেয় নৌকাটি। পরে ইঞ্চিন চালিত নৌকাটি তিউনিসিয়ার ভুমধ্যসাগরে নৌকার ইঞ্জিন ফেটে যায়। এতে মামুন ও সজলসহ বেশ কয়েকজন মারা যান। পরে খবর পেয়ে বেশ কয়েকজনকে জীবিত উদ্ধার করে স্থানীয় কোস্টগার্ড। এছাড়া এখনো নিখোঁজ পাশের গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার গোয়ালা ইউনিয়নের পান্নু শেখের ছেলে আপন শেখ। ব্যাংক ঋণ ও সুদে এনে দালালদের দেয়া টাকা পরিশোধ করা নিয়ে দুঃচিন্তায় স্বজনরা।
নিহত মামুন শেখের বড় ভাই সজীব শেখ বলেন, মানব পাচারকারী চক্রের সক্রিয় সদস্য গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার রাঘদী ইউনিয়নের সুন্দরদী গ্রামের বাদশা কাজীর ছেলে মোশারফ কাজী। তিনি প্রলোভন দেখিয়ে প্রত্যেকের কাছ থেকে ১৩-১৫ লাখ টাকা নেন। পরে ধারণ ক্ষমতার বেশি যাত্রী বোঝাই করে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় লিবিয়া থেকে ইতালির উদ্দেশ্যে পাঠালে এই দুর্ঘটনা ঘটে। আমি সরকারি ভাবে আমার ভাইয়ের মরদেহ দেশে ফিরিয়ে আনা এবং দালাল মোশারফ কাজীর শাস্তির দাবী করছি।
নিহত সজল বৈরাগীর বাবা সুনীল বৈরাগী বলেন, ‘নৌকা ডুবিতে প্রাণে বেঁচে যাওয়া একজন ফোন করে মামুন ও আমার ছেলে সজলের মারা যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।’
তিনি বলেন, ‘জমি, গরু বিক্রি করে, লোন করে ১৫ লাখ টাকা দিয়ে ছেলেকে ইতালি যাওয়ার জন্য পাঠাই। কিন্তু আমাদের সেই স্বপ্ন সত্যি হলো না। সব স্বপ্ন সাগরে শেষ হয়ে গেলো। আমরা একেবারে পথে বসে গেছি। এখন আমরা কী করবো? আমার ছেলে গেলো, সঙ্গে আমাদের সব শেষ হয়ে গেলো। এ ঘটনায় আমরা দালাল মোশারফ কাজীর কঠিন বিচার চাই।’
অভিযুক্ত দালাল মোশারফ কাজী লিবিয়ায় থাকায় তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। তার ছেলে যুবরাজ কাজীর ব্যবহৃত মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে। এছাড়া দালাল রাশেদ খান ও টুলু খানদের সাথেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তারা সব সময় আত্মগোপনে থাকেন বলে জানায় স্থানীয়রা।
মাদারীপুরের রাজৈর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আসাদুজ্জামান হাওলাদার আসাদ ও সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এএইচএম সালাউদ্দিন জানান, ‘ভুক্তভোগী পরিবারের কাছ থেকে লিখিত অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
ইতালী যাবার পথে মাদারীপুরের তিন যুবকের মৃত্যু
Leave a comment