জন্মভূমি ডেস্ক : চলতি রবি মৌসুমে (মধ্য অক্টোবর থেকে মধ্য মার্চ পর্যন্ত) অতিবৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড়, কুয়াশাসহ আবহাওয়ার অস্বাভাবিক আচরণের কারণে সবজির ক্ষতি হয়েছে, যার প্রভাব পড়েছে দেশের বিভিন্ন স্থানের বাজারে। চলতি বছর সরবরাহ কম থাকায় সবজির দাম ছিল অন্য যেকোনো বছরের তুলনায় বেশি।
আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা জানান, গত বছরের অক্টোবরে টানা বৃষ্টি, নভেম্বর ও ডিসেম্বরে ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে বৃষ্টিপাত হয়েছে। পাশাপাশি ডিসেম্বরে শীত ছিল স্বাভাবিকের তুলনায় কম। আবার জানুয়ারিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘন কুয়াশার কারণে টানা এক সপ্তাহেরও বেশি সময় সূর্যের আলো দেখা যায়নি। মূলত প্রশান্ত মহাসাগরে এল নিনোর প্রভাবে আবহাওয়া এমন অস্বাভাবিক আচরণ করেছে। এতে শীতকালীন সবজি ও বিভিন্ন ফসল উৎপাদনে কৃষক সমস্যর মুখে পড়েছেন।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের বিশেষজ্ঞ ড. এসএম কামরুল হাসান বলেন, ‘এল নিনোর প্রভাবে শীতের মৌসুমে তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে কিছু বেশি থাকে। আবার বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টিপাত কম হয়। গত বছর আমরা এ চিত্রই দেখেছি। তবে গত জানুয়ারিতে তাপমাত্রা আবার কমে গিয়েছিল। মূলত কুয়াশার কারণে দিনের বেলায়ও তাপমাত্রা রাতের চেয়ে খুব বেশি বাড়েনি।’
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, চলতি রবি মৌসুমে ৬ লাখ ২৯ হাজার হেক্টর জমিতে শাকসবজি আবাদের লক্ষ্যমাত্রা হাতে নেয়া হয়েছিল। এসব জমিতে ১ কোটি ৪৫ লাখ টন শাকসবজি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা হাতে নেয়া হয়। এছাড়া ২ লাখ ৬০ হাজার হেক্টর জমিতে ৩৬ লাখ ৭৩ হাজার টন পেঁয়াজ ও ৪ লাখ ৬২ হাজার হেক্টর জমিতে ১ কোটি ১৬ লাখ টন আলু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা হাতে নেয়া হয়।
রংপুর অঞ্চলের কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে দীর্ঘ সময় বিরূপ আবহাওয়া থাকায় সবজি আবাদে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। বিশেষ করে আলুর ফলন কম এবং শীতকালীন শাকসবজি চাষে দেরি হয়েছে।
রংপুর জেলার পীরগঞ্জ উপজেলার পার্বতীপুর গুজ্জিপাড়া গ্রামের কৃষক মো. তোছাদ্দেকুর রহমান বাদল জানান, ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে যখন খুব ঠাণ্ডা পড়ল। দীর্ঘদিন সূর্যের দেখা পাওয়া যায়নি। প্রায় এক মাস জমিতে থাকা ফসলের বাড়ন্ত ভাব থমকে গিয়েছিল। তিনি বলেন, ‘আমার টমেটো গাছ অতিরিক্ত ঠাণ্ডায় অনেক লম্বা হয়েছে এবং ফলন দেরিতে এসেছে। এছাড়া আলুর ফলন তুলনামূলক কম হয়েছে।’ এছাড়া তার এলাকায় শীতকালীন সবজি লাউ, মিষ্টিকুমড়া, জালিকুমড়া ও মরিচ গাছের বৃদ্ধি বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শীতকালীন শাকের অবস্থা আরো করুণ ছিল। তবে বর্তমানে আবহাওয়া স্বাভাবিক হওয়ায় গাছগুলোয় পরিবর্তন দেখা দিয়েছে।
এদিকে উল্লিখিত সময়ে উৎপাদন তুলনামূলক কম হওয়ায় সবজি সরবরাহে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে স্থানীয় বাজারগুলোয়। রংপুর কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মাঠ ও বাজার পরিদর্শক মো. বোরহানউদ্দিন বলেন, ‘দীর্ঘ সময় বিরূপ আবহাওয়া বিরাজ করায় সবজি উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে, এ কথা সত্য। তবে এর সঙ্গে আরো কিছু কারণ যোগ হয়েছে। আগের চেয়ে সবজিচাষীর সংখ্যা কমেছে, লিজ নেয়া জমির মূল্য বেড়েছে, সার, বীজ, কীটনাশক ও কৃষি শ্রমিকের মজুরি বেড়েছে।’
বগুড়ার ফতেহ আলী কাঁচাবাজারের সবজি বিক্রেতা মোখলেছুর রহমান জানান, কয়েক দিন আগে মোকামে সবজি সরবরাহ ছিল কম। শীত ও কুয়াশার কারণে চাষীরা সবজি জমি থেকে উত্তোলন কম করতেন। তাছাড়া শীতের তারণে সবজির ফলনও কম হতে থাকে। এ কারণে সবজির দাম বেড়ে যায়।
বগুড়া জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. মতলুবর রহমান জানান, এ জেলায় শীতকালে ২৮ প্রকার সবজি চাষ হয়। আর গ্রীষ্মকালে প্রায় ২০ প্রকার সবজি চাষ হয়। এ বছর বগুড়ায় শীত ছিল বেশি। কুয়াশা থাকায় কিছুটা সমস্যা হয়েছে। এখন সেটা নেই। এখন হাটবাজারে সরবরাহ বেড়েছে।
যশোর সদরের চূড়ামনকাটি গ্রামের মিজানুর রহমান বলেন, ‘আমি ৫০ শতাংশ জমিতে বেগুন আবাদ করেছি। অন্যান্য বছর ১০ মণ বা তার কিছু বেশি ফলন পাই। কিন্তু এবার পেয়েছি আট মণ। শুধু আমার নয়, এখানকার বেশির ভাগ কৃষকের ফলনে কমবেশি ক্ষতি হয়েছে।’
যশোর সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা হাসান আলী জানান, ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে দেশের আবহাওয়া অসম ছিল। এ কারণে বিভিন্ন ধরনের সবজির কিছুটা ক্ষতি হয়েছে, যার পরিমাণ তেমন না। আবার সবজির দাম ভালো হওয়ায় কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হননি।
ঢাকায় সবজি সরবরাহ করেন জয়পুরহাটের নতুনহাটের সুলতান আহমেদ। তিনি বলেন, ‘আগে আমি প্রতিদিন ১৫-১৬ টন সবজি ঢাকায় পাঠাতাম। বর্তমানে বাজারে সবজি আমদানি কম এবং দাম বেশি হওয়ায় পাঁচ-ছয় টন সবজি পাঠানো কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে।’
রাজধানীতে কয়েক মাস ধরে সবজির দাম ছিল অস্বাভাবিক। প্রতি কেজি সবজি ৬০ থেকে ১০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। যদিও দুই-তিনদিন ধরে বাজারে সবজি সরবরাহ বেড়েছে। এতে দাম কিছুটা কমতির দিকে।
এক সপ্তাহ আগে খুচরা বাজারে প্রতি কেজি মুলা ৩০-৪০ টাকা, বেগুন ৬০-১০০, করলা ৮০-১০০, টমেটো ৬০-৮০, কাঁচামরিচ ৬০-৭০, ফুলকপি ও বাঁধাকপি ৪০-৫০ ও লাউ ৬০-৯০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। বর্তমানে দাম কিছুটা কমেছে। গতকাল প্রতি কেজি মুলা ২০-৩০ টাকা, লাউ ৬০-৮০, আলু ৩৫, করলা ৮০, টমেটো ৪০-৫০, কাঁচামরিচ ৪০-৭০ এবং ফুলকপি ও বাঁধাকপি প্রতি পিস ৩৫-৪০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। যদিও গত বছরের এ সময়ে প্রতি কেজি টমেটো ২০-৪০ টাকা, ফুলকপি ও বাঁধাকপি ২০-৩০, আলু ২০-৩০ ও মিষ্টিকুমড়া ২৫-৪০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
বাংলাদেশ কাঁচামাল আড়ত মালিক সমিতির সভাপতি মো. ইমরান মাস্টার বলেন, ‘অন্যান্য বছর বাজারে সবজি সরবরাহ অনেক বেশি থাকত। ২০-৩০ শতাংশ সবজি বিক্রি করা যেত না। কিন্তু এবার সবজি যা ছিল প্রতিদিন বিক্রি হতো। অর্থাৎ চাহিদার চেয়ে সরবরাহ কম ছিল। সরবরাহ বেশি থাকলে দাম কমে যেত। এ কারণে সারা মৌসুমে দাম বেশি ছিল। দুদিন ধরে বাজারে সবজি সরবরাহ বেড়েছে। এ কারণে দাম কিছুটা কমতে শুরু করেছে।’
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্লান্ট প্যাথলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. আবু নোমান ফারুক আহমেদ বলেন, ‘শীতকালে ভারি বৃষ্টিপাত হয়েছে। এ কারণে অনেকের সবজি আবাদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আবার ঘন কুয়াশার কারণে সবজির বৃদ্ধি কম ছিল। গত কয়েক মাস আবহাওয়া খুব বিরূপ আচরণ করেছে। এ আবহাওয়া ফসলে রোগবালাই ছড়িয়ে পড়ার জন্য উপযোগী ছিল। বিভিন্ন স্থানে সবজি ও আলুতে পোকামাকড়ও ছড়িয়েছে, যার কারণে সবজি সরবরাহ কম থাকতে পারে।’
উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় বাজারে সবজির সরবরাহ কম
Leave a comment