শেখ সিরাজউদ্দৌলা লিংকন, কয়রা : কপোতাক্ষ নদটি যশোর হয়ে খুলনার কয়রা উপজেলার বুক চিরে শিবসা নদীতে গিয়ে মিশেছে। এই নদের স্রোত আর গভীরতা নিয়ে নানা গল্প প্রচলিত আছে কয়রার আমাদী এলাকার মানুষের মধ্যে। নদ দিয়ে চলাচল করা লঞ্চ আর মাছ ধরার স্মৃতি এখনো হাতড়ে বেড়ায় ওই এলাকার মানুষ। তবে এর সবই এখন অতীত।
কয়রার আমাদী এলাকা থেকে পাশের পাইকগাছা উপজেলার বোয়ালিয়া পর্যন্ত ৩০ কিলোমিটার খরস্রোতা কপোতাক্ষ নদের অংশটি প্রাণ হারিয়েছে আরও আগে। দুই বছর ধরে চলছে মুমূর্ষু অবস্থা। একসময়ের ১৫০ মিটার প্রশস্ত নদটি এখন পরিণত হয়েছে ৩-৪ মিটার সরু খালে। ভাটায় সেখানে নৌকা চালানো যায় না। হেঁটেই পার হয় মানুষ।
কপোতাক্ষের এমন মৃত্যু দেখে শঙ্কার কথা বলেছেন এলাকার মানুষ। তাঁরা বলছেন, নদটি বাঁচানো না গেলে ভবিষ্যতে আরও খারাপ দিন আসবে। কারণ, কয়রা উপজেলা ও পাইকগাছা উপজেলার অধিকাংশ এলাকার পানি কপোতাক্ষ নদ দিয়েই নিষ্কাশিত হয়। নদ না থাকলে ভবিষ্যতে ওই এলাকায় স্থায়ী জলাবদ্ধতার আশঙ্কা রয়েছে।
কয়রার আমাদী এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, বিশাল নদটি সরু খালের মতো প্রবাহিত হয়ে কোনোরকমে টিকে আছে। নদের দুই পাশে জেগেছে বিশাল চর। সেখানে চলছে দখলের উৎসব। চর দখল করে বাড়িঘর থেকে শুরু করে, চিংড়িঘেরসহ বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এ ছাড়া চরে তৈরি করা হচ্ছে নতুন তিনটি ইটের ভাটা।
কয়রার আমাদী এলাকার কপোতাক্ষের পাশেই রফিকুল ইসলাম গাজীর বাড়ি। পুরোনো স্মৃতি রোমন্থন করে তিনি বলেন, একসময় তাঁর বাড়ির পাশেই ছিল লঞ্চঘাট। ১০-১২ বছর আগেও এই নদে স্রোত ছিল, ছিল জোয়ার-ভাটার খেলা। কিন্তু কপোতাক্ষের দিকে তাকালে এখন সে কথা বিশ্বাস করাই কঠিন।
কপোতাক্ষপারের নাকশা গ্রামের বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব মতিয়ার রহমান বলেন, ‘আমার যৌবনে এই কপোতাক্ষ নদেরও যৌবন ছিল চোখে পড়ার মতো। দূর থেকেই এই নদের গর্জন শোনা যেত। এখন আমি বৃদ্ধ হয়ে গেছি আর কপোতাক্ষ নদও শুকিয়ে গেছে। আমি যেমন অর্ধেক মৃত, কপোতাক্ষ নদও তেমন। আগে নদে ১৫-২০ হাত পানি ছিল। দুই বছর ধরে ভাটির সময় নৌকাও চলে না।’
সুন্দরবন ও উপকূল সুরক্ষা আন্দোলনের সমন্বয়ক নিখিল চন্দ্র ভদ্র বলেন, উপকূলীয় উপজেলা কয়রা এমনিতেই দুর্যোগের ঝুঁকিতে আছে। এরপর কপিলমুনিতে সেতু নির্মাণের নামে পিলার স্থাপন করে ২০ বছর ধরে কপোতাক্ষের পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত করায় নদটি মৃতপ্রায়। অথচ এই কপোতাক্ষ নদের প্রবাহ স্বাভাবিক না রাখতে পারলে কয়রা উপজেলার কপোতাক্ষপারের মানুষের জীবন-জীবিকায় আরও বিপর্যয় নেমে আসবে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের খুলনার নির্বাহী প্রকৌশলী আশরাফুল ইসলাম বলেন, কপোতাক্ষ নদের জলাবদ্ধতা দূরীকরণ প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ে ২০২৪ সালের মধ্যে খুলনার পাইকগাছা বোয়ালিয়া থেকে কয়রা উপজেলার আমাদী পর্যন্ত ৩০ কিলোমিটার কপোতাক্ষ নদ পুনঃখনন করা হবে। এ খননকাজ শেষ হলে কয়রা ও পাইকগাছা উপজেলার জলাবদ্ধতা নিরসন হবে। সঙ্গে সঙ্গে নৌপথে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ যোগাযোগব্যবস্থা সুগম হবে।