করোনা মহামারি থেকে শিক্ষার্থীদের রক্ষা করতে সমগ্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। ধারণা ছিল তারা ঘরে থেকে লেখাপড়া করবে। ওয়ান লাইনে শিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থাও করা হয়। ফল দেখা দিয়েছে অনেকটা উল্টো। এ সুযোগে বহু শিক্ষাার্থী ঘরমুখি না হয়ে এখন বিভিন্ন স্থানে দল বেধে আড্ডায় বসছে। বইয়ের পাতায় চোখ না রেখে মোবাইল ফোনে ফেইস বুকের বিভিন্ন অ্যাপে নিজেদের ডুবিয়ে রাখছে। দেখা দিচ্ছে নৈতিক অবক্ষয়। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী এখন শিক্ষা থেকে অনেক দূরে সরে পড়েছে। অভিভাকদের মধ্যেও তাদের কোমলমতি সন্তান নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
গত আট মার্চ বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো করোনা ভাইরাস আক্রান্ত রোগী শনাক্তের ঘোষণা দেয়া হয়। পরে ৩১ মার্চ পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের নির্দেশ আসে। তখন ভাবা হয়নি ছোট-বড় সব স্কুল পড়–য়াকে ঘরে রাখা যে কত কঠিন হবে। বিশেষ করে গ্রামের শিক্ষার্থীদের ঘরে কী আছে? অবসর বিনোদনের জন্য টেলিভিশন খুব কম পড়–য়াদের ঘরে রয়েছে। কম্পিউটারের সামনে পড়ে থাকার ব্যবস্থাও নেই। তাছাড়াা লম্বা সময় ধরে কম্পিউটারের সামনে থাকাও তো স্বাস্থের জন্য, মনোনের জন্য ভালো নয়। ক্যারাম, দাবা, লুডু বা টেবিলটেনিসের মতো ঘরের ভেতরে খেলার উপযোগী সুযোগ এবং চর্চা কোনটাই প্রায় নেই বললেই চলে। ফলে তারা বেরিয়ে পড়ে ঘর থেকে এবং পাড়া-মহল্লায় অপর কিশোরদের সঙ্গে আড্ডায় মেতে ওঠে।
শিক্ষার্থীরা এখন সর্বনাশা বিভিন্ন ফোন আ্যাপ ব্যবহার করছে। এসব আ্যাপ ব্যবহারে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে নৈতিকতা, সামাজিক মূল্যবোধ ও পারস্পারিক শ্রদ্ধাবোধ। তরুণরা কিশোর গ্যাংয়ে জড়িয়ে অপরাধমূলক কাজে অংশ নিচ্ছে। তারা দিনের পর দিন হয়ে উঠছে সহিংস। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে, এসব অ্যাপ ব্যবহারকারীদের নজরদারী করা হলেও সরাসরি ফৌজদারী অপরাধ না হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না।
একটি সূত্র থেকে বলা হয়েছে, ইন্টারনেটে ছড়িয়ে থাকা ক্ষতিকর অ্যাপগুলোর একটি হচ্ছে ‘বিগো লাইভ’। এ অ্যাপের মাধ্যমে তরুণ ও যুবকদের আকৃষ্ট করে লাইভে এসে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি ও কুরুচিপূর্ণ প্রস্তাব দিয়ে বিকাশে টাকা পাঠানোর কথা বলে কিছু সুন্দরী নারী। সে ফাঁদে ধরা পড়ছে কোমলমতি উঠতি বয়সী শিক্ষার্থীরা। তাদেরকে দেখা যায় গ্রামের বিভিন্ন রাস্তার পাশে বসে ৪-৫ জনে মিলে মোবাইলের সামনে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। শুধুমাত্র খাওয়ার সময়ে ঘরে যায়। লেখা-পড়ার কোন চাপ না থাকায় গভীর রাত অবধি তারা ঘরের বাইরে সময় কাটায়। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কিছুটা সচেতন হলেও স্কুল পর্যায়ে রয়েছে অসচেতন। এর ফলে বহু মেধাবি শিক্ষার্থী তাদের মেধা অন্যদিকে ব্যবহার করছে।
বিষয়টি নিয়ে খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার প্রত্যন্ত ভান্ডারকোট গ্রামের অভিভাবক আব্দুস সবুর বলেন, তার দুটি ছেলের একজন নবম শ্রেণিতে অন্য জন কলেজে লেখাপড়া করে। তারা করোনাকালে ছুটি পেয়ে সম্পূর্ণ বই ছেড়ে দিয়েছে। মোবাইল ফোনে সমস্ত দিন কাটে। দিনের পর দিন অন্যদিকে মন থাকায় মূলদিক থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ নাগরিক নেতা অধ্যাপক জাফর ইমাম দৈনিক জন্মভূমিকে বলেন, করোনা শিক্ষার্থীদের চরম ক্ষতি করেছে। কিšুÍ বলার কিছুই নেই। সেই স্বাধিনতা যুদ্ধের সময়ে যেমন ক্ষতি হয়েছিল তার চেয়েও বেশী ক্ষতির শিকার হয়েছে শিক্ষার্থীরা। তবে আশার দিক হলো ওয়ানলাইনের মাধ্যমে অনেক শিক্ষার্থী পড়া লোখার কৌশল অর্জন করেছে। তবে গ্রামের দিকে এসবের তেমন একটা সুযোগ শিক্ষার্থীরা পায়নি। তাদের ক্ষতি হয়েছে আরও বেশী। নৈতিক অবক্ষয়ও বেড়েছে।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের প্রফেসর ড. এমডি আব্দুল জব্বার বলেন, করোনা গোটা ওয়ার্ল্ড সিসটেম চেইঞ্জ করে দিয়েছে। সে ক্ষেত্রে আমাদের দেশে শিক্ষার্থীদের একটা অংশ অন- লাইনের মাধ্যমে লেখা-পড়া করছে। অন্য অংশ কিছুটা সময় অন লাইনে দিলেও বাকী সময়টা ইন্টারনেটে ফেইসবুকে কাটছে। গ্রামের বাচ্চাদের ক্ষেত্রে লেখা-পড়ার অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে। বই থেকে তারা অনেক দূরে সরে গেছে। শিক্ষার্থীরা এখন যান্ত্রিক দিকে ঝুঁকে পড়েছে। এসব কারণে নৈতিক অবক্ষয় বেড়েছে। বাচ্চদের কিছু অংশ সারাদিন ঘরে আবদ্ধ থাকলেও অন্য অংশ বাইরে সময় দেয়। একারণে ঘরে থাকা বাচ্চদের মধ্যেও বিরুপ প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তিনি বলেন, বাচ্চাদের মধ্যে সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটছে। কিশের অপরাধ বাড়ছে, চারিত্রিক বিচ্যুতি ঘটছে। তাদের টেকস্ট বইয়ে মন নেই।