শেখ আব্দুল হামিদ
করোনার মহামারীতে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা এক প্রকার ভেঙ্গে পড়েছে। শিক্ষার্থীরা যেন ভুলেই গেছে স্কুলের গন্ডির কথা। নিত্যদিনের পড়া মুখস্ত করার কোন তাড়া এখন নেই। তাই সন্ধ্যায় আর পড়ার শব্দও শুনা যায়না। সব কিছুই যেন এলোমেলো করে দিয়েছে ভয়াবহ এই অদৃশ্য শক্তি করেনা।
শিক্ষাই জাতির মেরুদÐ। কথাটা যেন আজ অতি পুরাতন হয়ে গেছে। বর্তমানে বলা হয়ে থাকে কর্মমুখী শিক্ষা না হলে সবই মূল্যহীন। এর সাথে নৈতিকতা ও মানকেও সম্পৃক্ত করা হয়েছে। তাই এসব ক্ষেত্রে যারা যত অগ্রগামী হচ্ছে, তারা তত উন্নতি করছে। ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর চীনের উহানে করোনা সনাক্ত হওয়ার পর এর বিশ্বায়ন হয়েছে খুব দ্রæত। যা মোকাবেলার জন্য একে একে প্রায় সব দেশ লকডাউন করেছে। ফলে সব খাতের মতো স্বাস্থ্য খাতও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইউনিসেফের দেয়া তথ্যানুযায়ী করোনাভাইরাসের কারণে হাম, ডিপথেরিয়া, পোলিওসহ বিভিন্ন রোগের টিকাদান কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। আর এ কারণে লাখ লাখ শিশুর জীবন ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। অথচ প্রতি বছর দুই কোটির বেশি শিশুকে এসব টিকা দেওয়া হয়। কিন্তু ১ কোটি ৩০ লাখেরও বেশি শিশু এসব টিকা এখনো নেয়নি। ফলে যেসব শিশু বর্তমানে টিকা নিচ্ছে না; তাদের সারাটা জীবনই ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাচ্ছে।
লকডাউনের কারণে দীর্ঘদিন বাড়িতে বন্দি থাকার কারণে শিশুরা স্থূল হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া, দুরন্তপনা থেমে যাওয়ায় এবং বন্ধুদের সাথে দেখা ও খেলা করতে না পারায় তারা মানসিকভাবে পর্যুদস্ত হয়ে পড়ছে। খাওয়া-দাওয়া করছে না ঠিকভাবে। লক-ডাউনের কারণে শিক্ষাখাতও বন্ধ হয়ে গেছে প্রায় এক বছর। তাতে চরম ক্ষতির মুখে পড়েছে শিক্ষার্থীরা। আর্থিকভাবে সচ্ছলদের তুলনায় অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ধনীদের মতো অনলাইন ক্লাসে অংশ নেওয়ার কম্পিউটার, অন্যান্য ডিভাইস ও ইন্টারনেট সংযোগ এবং নিরাপদ ও পড়াশোনার উপযোগী পরিবেশ পাচ্ছে না তারা। আর্থিক অনিশ্চয়তার কারণে তারা মানসিকভাবেও ভালো নেই। সব মিলিয়ে করোনা মহামারীর পর ধনী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাদের ফলাফলের পার্থক্য অনেক বেড়ে যোত পারে। অসংখ্য শিক্ষার্থী পড়াশুনা এবং পিএইচডি ও গবেষণা করে। তাদের মধ্যে যারা অসচ্ছল, তারা খন্ডকালীন কাজ করে শিক্ষা এবং থাকা-খাওয়ার ব্যয় বহন করে। লকডাউনের কারণে তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তারা চরম সংকটে পড়েছে।
লকডাউনের কারণে প্রাইভেট এবং কোচিং বন্ধ হয়ে গেছে। ঘরেও শিক্ষার্থীদের শিক্ষার প্রতি মনোযোগ নেই তেমন। কারণ, করোনা আতংকে সকলেই ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে। ফলে শিক্ষা কার্যক্রম প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। অসংখ্য শিক্ষার্থী টিউশনি, কোচিং, পার্ট টাইম জব করে শিক্ষার ব্যয় বহন করতো। লকডাউনের কারণে এসব বন্ধ থাকায় তারাও বিপদে পড়েছে। বহু পরীক্ষা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সেশনজটও সৃষ্টি হচ্ছে। অন্যদিকে, অনলাইনে কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা কার্যক্রম চালু করা হয়েছে। কিন্তু সে সুযোগ-সামর্থ্য সকলের নেই।
\ অধ্যাপক জাফর ইমাম \
এ বিষয়ে খুলনার বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক জাফর ইমাম বলেন, করেনার এ অপূরণীয় ক্ষতি পুষিয়ে ওঠা সম্ভব নয়। সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ, পরীক্ষা নেই, অটোপাশ, ছাত্র জীবনটা বিপর্যয়ের মধ্যে পড়া সব মিলিয়ে বেশ কিছুটা পিছনে পড়েছে শিক্ষা খাত। দেশ থেকে করোনা উচ্ছেদ হবেকিনা জানিনা, তবে করোনা নিয়ন্ত্রণে এলেও শিক্ষার এ ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে বেশ কয়েক বছর সময় লেগে যাবে।
\ প্রফেসর সাধন রঞ্জন ঘোষ \
করোনার কারণে শিক্ষার্থীদের ক্ষতির বিষয়ে খুলনা বিশ^বিদ্যালয়ের ট্রেজারার বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ প্রফেসর সাধন রঞ্জন ঘোষ দৈনিক জন্মভূমিকে বলেন, করোনা শুধু শিক্ষা ক্ষেত্রে নয়, বিপর্যস্ত করেছে অর্থনৈতিক সামাজিক স্বাস্থ্যসহ সকল ক্ষেত্রে। একটি প্রজন্মের একটা অংশকে কঠিন ভাবে বিপর্যস্ত করেছে। যার ফল আগামী প্রজন্মকে ভোগ করতে হবে। তিনি বলেন করোনা সৃষ্ট ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার জন্য কৃষি খাতে, শিল্প খাতে, সেবা খাতে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হচ্ছে। লাকডাউন উঠে যাওয়ার সাথে সাথে এসব খাতে পুরোদমে কাজ শুরু হয়ে যাবে। শিক্ষার ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। আর এ দায়িত্ব মূলত শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের। তবে এক্ষেত্রে শিক্ষাবিদদের এগিয়ে আসতে হবে। করোনা সৃষ্ট শিক্ষার ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার জন্য ঐচ্ছিক ছুটি বন্ধ, অতিরিক্ত ক্লাস নিয়ে গ্যাপ পূরণ, শিক্ষকদের ভালো নোট দেওয়া ইত্যাদি আবশ্যক। করোনানার এই ভয়াবহ অবস্থার অবসান ঘটলে শিক্ষার ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে বলে আমি মনে করি।