জন্মভূমি রিপোর্ট
মহামারী করোনার হট স্পট হয়ে উঠছে খুলনা, যশোর, সাতক্ষীরাসহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল। ইতোমধ্যে শনাক্তের হার রেকর্ড ছাড়িয়ে যাচ্ছে প্রতিদিন। খুলনাতে শনাক্তের হার গত সোম ও মঙ্গলবার রেকর্ড হয়েছে। বাড়ছে মৃত্যু। সাতক্ষীরায় কঠোর বিধি-নিষিধের মধ্যে শনাক্ত কমছে না। যশোরেও বাড়ছে শনাক্তের হার। ইতোমধ্যে খুলনার পাইকগাছা পৌর এলাকায় লকডাউনের ঘোষণা করা হয়েছে। আগে থেকে সাতক্ষীরার সীমান্তবর্তী উপজেলাগুলো কঠোর বিধি-নিষেধ চালু রয়েছে। মঙ্গলবার যশোর শহর নওয়াপাড়া পৌরসভার ২টি ওয়ার্ডকে কঠোর বিধি-নিষেধের আওতায় আনা হয়েছে। এছাড়া বাগেরহাটের বন্দর শহর মোংলাতেও সংক্রমণের হার উর্ধমুখী। সেখানে শনাক্তের হার দু’দিন আগে ৭০ ছিল। এছাড়া সীমান্ত জেলা কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, মাগুরা, মেহেরপুর ও নড়াইলে প্রতিদিন শনাক্তের হার বাড়ছে। সব মিলে খুলনা বিভাগ এখন হট স্পাচে পরিণত হতে চলেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, খুলনা বিভাগের অধিকাংশ জেলাগুলো ভারতের সীমান্তবর্তী হওয়ায়, এ অঞ্চল এখন উচ্চ মাত্রার ঝুঁকিতে রয়েছে। দেশের সর্ববৃহত স্থল বন্দর বেনাপোল রয়েছে যশোরে। সাতক্ষীরা ভোমরা স্থল বন্দর। অপর দিকে দেশের দ্বিতীয় সমুদ্র বন্দর মোংলাতে বিদেশি নাবিক ওযাত্রীদের আধিক্য বেশি। এসব বন্দর সংশ্লিষ্ট যোগাযোগ হয় বিভাগীয় শহর খুলনা কেন্দ্রিক। যে কারণে খুলনাতে এর প্রভাব পড়ছে।
॥ পাইকগাছা পৌর এলাকা লকডাউন ঘোষণা ॥
করোনার প্রকোপ বৃদ্ধি পাওয়ায় খুলনার পাইকগাছা পৌর এলাকায় এক সপ্তাহের লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। মহামারি করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে আগামী ১০ জুন থেকে ১৬ জুন পর্যন্ত চলবে এই লকডাউন। মঙ্গলবার (৮ জুন) পাইকগাছা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এবিএম খালিদ হোসেন সিদ্দিকী এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
ইউএনও বলেন, ‘শুধু পৌরসভা এলাকায় এই লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। আর পাইকগাছার চারটি হাট-বাজার আগামী ১০ জুন থেকে এক সপ্তাহ বন্ধ থাকবে। সেগুলো হচ্ছে কপিলমুনি হাট, চাঁদখালী হাট, বাঁকা বাজার ও কাটিপাড়া বাজার। চারটি হাটে শুধু ওষুধ, নিত্যপ্রয়োজনীয় মুদি দোকান, কাঁচাবাজার ছাড়া সব ধরনের দোকান, শপিংমল বন্ধ থাকবে। আদেশ অমান্যকারীর বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এ ব্যাপারে মাইকিং চলছে।
উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, পৌরসভা এলাকায় ১০ জুন সকাল ৬টা থেকে ১৬ জুন রাত ১২টা পর্যন্ত কঠোর লকডাউন বহাল থাকবে। শুধু ওষুধ নিত্যপ্রয়োজনীয় মুদি দোকান, কাঁচা বাজার, কৃষি, নির্মাণ সামগ্রীর দোকান সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত খোলা থাকবে। অন্যান্য দোকান, কলকারখানা বন্ধ থাকবে। হোটেল রেস্টুরেন্ট শুধু টেকওয়ে বা অনলাইনে বিক্রি/সরবরাহ করতে পারবে, কিন্তু বসে কেউ খেতে পারবে না। পৌরসভার অভ্যন্তরে সব গণপরিবহন বন্ধ থাকবে। ক্রেতা ও বিক্রেতাদের বাধ্যতামূলক মাস্ক পরিধান, ন্যূনতম তিন ফুট শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখাসহ স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মানতে হবে।
॥ সাতক্ষীরায় একদিনে শনাক্ত ১০০ ছাড়ালো ॥
সাতক্ষীরায় লকডাউনের চতুর্থ দিনে করোনা সংক্রমণের হার আরও বেড়েছে। সর্বশেষ ফলাফলে গত ২৪ ঘণ্টায় (মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত) ১৮৭ জনের শরীরে নমুনা পরীক্ষায় ১০৩ জনের করোনা পজিটিভ এসেছে।
পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্তের হার ৫৫ দশমিক ৮ শতাংশ। এটিই জেলায় একদিনে সর্বোচ্চ হার রেকর্ড।
এদিকে সোমবার রাতে ও মঙ্গলবার সকালে করোনার উপসর্গ নিয়ে সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা গেছেন এক নারী ও আপন দুই সহোদরসহ আরও পাঁচজন।
মঙ্গলবার দুপুরে সাতক্ষীরার সিভিল সার্জন হুসাইন সাফায়াত এসব তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, সীমান্ত এলাকায় দ্রুত করোনা রোগী শনাক্তের জন্য সোমবার থেকে সীমান্তবর্তী সব উপজেলায় র্যাপিড টেস্ট চালু করা হয়েছে। জেলায় এখনো কোনো ভারতীয় ধরনের করোনা রোগী পাওয়া যায়নি। আইইডিসিআর ল্যাবে পাঠানো নমুনা পরীক্ষার রিপোর্ট পেলে এ বিষয়ে আরও নিশ্চিত হওয়া যাবে।
এদিকে করোনা ঠেকাতে প্রশাসনকে কিছুটা কঠোর হতে দেখা গেছে। পুলিশ শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে আরও বেশি সংখ্যক চেকপোস্ট বসিয়ে সাধারণ মানুষের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করছে। জেলায় বাড়ানো হয়েছে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানও।
গত শনিবার থেকে সোমবার পর্যন্ত তিনদিনে ৪১টি অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে, মামলা দায়ের করা হয়েছে ২১৭টি। এই সময়ে স্বাস্থ্যবিধি ও লকডাউনের বিধিনিষেধ না মানায় ১ লাখ ২৩ হাজার ৫৪৩ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে। এখনও জেলায় সব ধরনের গণপরিবহন বন্ধ রয়েছে। কিছু কিছু মোটরচালিত যান চলতে দেখা গেছে কিছু এলাকায়। এছাড়া সীমিত সময়ের জন্য সকাল ৮টা থেকে ২টা পর্যন্ত চলছে ভোমরা স্থলবন্দরের আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম।
সাতক্ষীরা সিভিল সার্জনের কার্যালয় সূত্র জানায়, দেশের ৬২তম জেলা হিসেবে ২৬ এপ্রিল ২০২০ তারিখে করোনা শনাক্তের পর সাতক্ষীরা এখন করোনার হটস্পট হয়ে উঠেছে। ঈদ পরবর্তী সংক্রমণ বৃদ্ধির যে শঙ্কা ছিল, সেটিই এখন সত্যি হয়েছে। ইতোমধ্যে সাতক্ষীরা জেলায় করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৪৯ জন। করোনা উপসর্গে মারা গেছেন আরো ২৩১ জন।
এদিকে বিজিবি’র কড়া নজরদারি মধ্যে সীমান্ত গলে ভারত থেকে বিপুল সংখ্যক মানুষ দেশে ফিরেছেন বলে জানা গেছে। ইতোমধ্যে সাতক্ষীরা ৩৩ বিজিবি গত ২৮ এপ্রিল থেকে তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন ৫৪ কিলোমিটার সীমান্ত থেকে দু’জন পাচারকারীসহ ৩৫ জনকে আটক করেছে।
সাতক্ষীরা সিভিল সার্জন হুসাইন শাফায়াত বলেন, জেলায় আশঙ্কাজনকভাবে করোনার রোগী বৃদ্ধি পাচ্ছে।
॥ যশোরে করোনা শনাক্তের হার ৪২ শতাংশ ॥
যশোরে বাড়ছে করোনা শনাক্তের হার। ২৪ ঘণ্টায় এ জেলায় নতুন করে ১২৫ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। মঙ্গলবার (৮ জুন) শনাক্তের হার ৪২ শতাংশ। সোমবার শনাক্তের হার ছিল ২৯ শতাংশ। এদিকে গত ২৪ ঘণ্টায় এ জেলায় ২৯৪ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ১২৫ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে।
সীমান্তবর্তী যশোর জেলায় মে মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে করোনা শনাক্তের হার বাড়তে শুরু করে। জুন মাসের শুরুতেও ঊর্ধ্বমুখীভাব দেখা যাচ্ছে। গত ৩ জুন শনাক্তের হার ছিল ২৫ শতাংশ। ৪ জুন কমে দাঁড়ায় ২৩ শতাংশ। ৫ জুন ছিল ২০ শতাংশ। ৬ জুন সেটা বেড়ে দাঁড়ায় ২৩ শতাংশে। ৭জুন তা আরও বেড়ে দাঁড়ায় ২৯ শতাংশে। আজ সেটা বেড়ে দাঁড়িয়ে ৪২ শতাংশে।
এ পর্যন্ত জেলায় সাত হাজার ৯৫৩ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। এরমধ্যে মারা গেছেন ৮৩ জন। এছাড়া যশোর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন ৫৭জন।
যশোরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কাজী মো. সায়েমুজ্জামান বলেন, করোনা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন প্রশাসন। ঊর্ধ্বমুখী এ হার রুখতে ও স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাসহ বিভিন্ন এলাকায় মানুষের চলাচল সীমাবদ্ধ করা হয়েছে। এছাড়া দুপুরে করোনা প্রতিরোধ কমিটির জরুরি বৈঠক রয়েছে। সেখানে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
॥ যশোর ও নওয়াপাড়া পৌরসভায় কঠোর বিধিনিষেধ ॥
করোনা সংক্রমণের হার বৃদ্ধি পাওয়ায় যশোর পৌরসভা ও অভয়নগরের নওয়াপড়া পৌরসভার চলমান বিধিনিষেধ সব ওয়ার্ডে সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। মঙ্গলবার (৮ জুন) বেলা ৩টায় যশোর জেলা করোনা প্রতিরোধ কমিটির সভায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত সভায় সভাপতিত্ব করেন জেলা প্রশাসক মো. তমিজুল ইসলাম খান।
সভায় যশোরের পুলিশ সুপার প্রলয় কুমার জোয়ারদার, সিভিল সার্জন ডা. শেখ আবু শাহীন, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শহিদুল ইসলাম মিলন, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সাইফুজ্জামান পিকুল, যশোরের পৌরমেয়র হায়দার গণী খান পলাশসহ জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কাজী মো. সায়েমুজ্জামান বলেন, সভায় যশোরের সার্বিক করোনা পরিস্থিতি নিয়ে পর্যালোচনা করা হয়েছে। প্রতিদিন যশোর পৌর এলাকা ও অভয়নগরের নওয়াপাড়া পৌর এলাকায় সংক্রমণের হার বেড়ে যাচ্ছে। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে যশোর পৌর এলাকার দুটি ওয়ার্ডের চলমান বিধিনিষেধ সব ওয়ার্ডে সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এছাড়াও নওয়াপাড়ার দুটি ওয়ার্ডের চলমান বিধিনিষেধও সব ওয়ার্ডে সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত হয়। শিগগিরই এ বিষয়ে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করা হবে। আজ বুধবার রাত থেকেই করোনা কমিটির সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হবে।
তিনি জানান, সভায় সবার মাস্ক ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও বাজারে স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনের ওপর জোর দেওয়া হয়। এছাড়াও গণসমাবেশ ও অনুষ্ঠান কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ, মোটরসাইকেলে একজন, রিকশায় একজন এবং অটোরিকশায় দুজনের বেশি চলাচল করতে পারবে না বলেও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
তবে গণপরিবহন এবং দোকানপাট-শপিংমলের বিষয়ে সরকারি সিদ্ধান্ত বলবৎ থাকবে বলে তিনি জানান।
করোনার হট স্পট খুলনা বিভাগ
Leave a comment