কুষ্টিয়া ও ফুলতলা প্রতিনিধি
কুষ্টিয়ায় প্রকাশ্যে দ্বিতীয় স্ত্রী, সৎপুত্রসহ স্ত্রীর প্রেমিককে গুলি করে হত্যা করেছে পুলিশের এএসআই। রবিবার বেলা ১১টার দিকে শহরের কাস্টমস মোড় এলাকার একটি মার্কেটের সামনে এ ঘটনা ঘটে। অস্ত্রসহ ঘাতক ওই এএসআই সৌমেনকে আটক করেছে পুলিশ।
নিহতরা হচ্ছেন আসমা খাতুন (৩৪), সৎপুত্র রবিন (৭), আসমার প্রেমিক শাকিল (৩৫)।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বেলা ১১টায় কাস্টমস মোড়ে ছেলে শিশুসহ এক নারী ও একজন পুরুষ দাঁড়িয়ে ছিল। এসময় হঠাৎ একজন প্রথমে ওই নারীর মাথায় গুলি করে। তারপর পুরুষটির মাথায় গুলি করে। এসময় বাচ্চা ছেলেটি ভয়ে পালিয়ে যাচ্ছিল তখন ছেলেটিকে ধরে মাথায় গুলি করে।
গুলিতে ঘটনাস্থলেই ওই নারী মারা যায়। গুরুতর আহত অবস্থায় শিশুটির পিতাকে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।
নিহত আসমা অভিযুক্ত সৌমেনের দ্বিতীয় স্ত্রী এবং শিশু রবিন আসমার আগের পক্ষের ছেলে। মারা যাওয়া আরেকজন হলেন শাকিল খান। তিনি কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার সাঁওতা গ্রামের বিকাশ কর্মী। আসমার বাড়িও সাওতা গ্রামে।
কুষ্টিয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ, প্রশাসন) মো. মোস্তাফিজুর রহমান জানান, বেলা ১১টার পর শহরের কাস্টম মোড় এলাকায় স্থানীয়রা গুলির শব্দ শুনতে পায়। এরপর মার্কেটের ব্যবসায়ীরা ধাওয়া দিয়ে ওই ঘাতককে একটি বাড়ির মধ্যে আটকে রাখে। পরে পুলিশ ওই বাড়ি থেকে এএসআই সৌমেন রায়কে উদ্ধার করে থানায় নিয়ে আসে। বর্তমানে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।
নিহত নারী সৌমেনের দ্বিতীয় স্ত্রী। দেড় বছর আগে তাহের বিয়ে করে। আসমা ও শাকিলের বাড়ি কুমারখালী উপজেলার চাপড়া ইউনিয়নের সাওতা গ্রামে। শিশুটি আসমার পুত্র।
জানা যায় নিহত আসমার আগের স্বামী রুবেল। পরে সে তার স্বামীকে তালাক দিয়ে পুত্র সন্তানকে নিয়ে এসএআই সৌমেনকে দ্বিতীয় বিয়ে করে।
বিয়ের পর থেকেই এএসআই সৌমেন তার স্ত্রী আসমাকে নির্মমভাবে নির্যাতন ও মারধর করতেন। কিছুদিন আগেও খুলনা থেকে কুষ্টিয়া এসে আসমাকে মারধর করে খুলনায় চলে যান। রোববার খুলনা থেকে কুষ্টিয়ায় এসে তিনজনকে হত্যা করেন এএসআই সৌমেন। এ ঘটনায় পুলিশ সৌমেনকে ঘটনাস্থল থেকে অস্ত্র, গুলি ও ম্যাগাজিনসহ আটক করেছে।
পুলিশ, হাসপাতাল ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বেলা সোয়া ১১টার দিকে শহরের কাস্টমস মোড় এলাকায় প্রকাশ্যে শাকিল, আসমা ও রবিনকে গুলি করেন সৌমেন। এ সময় স্থানীয় জনগণ ও ব্যবসায়ীরা সৌমেনকে আটক করেন। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে যায় এবং অভিযুক্ত সৌমেনকে অস্ত্র ও গুলিসহ আটক করে।
আসমা কুমারখালী উপজেলার পান্টি ইউনিয়নের নাতুড়িয়া গ্রামের মেজবাহ আলীর মেয়ে এবং নিহত রবিন আসমার দ্বিতীয় স্বামীর সন্তান। আর নিহত শাকিল বিকাশের ডিস্ট্রিবিউশন সেলস অফিসার পদে (ডিএসও) চাকরি করতেন। জেলার কুমারখালী উপজেলার চাপড়া ইউনিয়নের শাওতা গ্রামের মেসবাহ আলীর ছেলে তিনি। আসমার বাড়িও একই উপজেলায়।
আর সৌমেন খুলনার ফুলতলা থানায় সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) হিসেবে কর্মরত আছেন। তার গ্রামের বাড়ি মাগুরা জেলার আড়পাড়ায়।
নিহত আসমার ভাই হাসান আলী সাংবাদিকদের বলেন, আমার আপু আসমার আগে দুই জায়গায় বিয়ে হয়েছিল। নিহত রবিন তার দ্বিতীয় স্বামীর সন্তান। সৌমেন আমার আপুর তৃতীয় স্বামী। সৌমেনেরও একটি সংসার রয়েছে। সেই স্ত্রীর ঘরে এক ছেলে ও এক মেয়ে সন্তান রয়েছে। সৌমেন সংসার নিয়ে খুলনায় চাকরি করেন। আমার আপু আমাদের সঙ্গে কুষ্টিয়ার বাবরআলী গেট এলাকায় ভাড়া বাসায় বসবাস করেন।
তিনি বলেন, মাঝে মধ্যেই সৌমেন আমাদের বাসায় এসে থাকতেন। প্রায়ই আপুর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার ও মারধর করতেন সৌমেন। কিছুদিন আগেও সৌমেন এসেছিলেন। সেদিনও মারধর করে চলে গেছেন খুলনায়।
নিহত আসমার মা হাসিনা খাতুন বলেন, পাঁচ বছর আগে সৌমেন কুমারখালী থানায় কর্মরত ছিল। সেই সময় আমরা একটি মামলায় পড়েছিলাম। সেই সূত্রে আমার মেয়ের সঙ্গে সৌমেনের প্রেমের সম্পর্ক হয়। পাঁচ বছর আগে আমার মেয়ের সঙ্গে সৌমেনের বিয়ে হয়। এরপর কর্মস্থল চেঞ্জ করে চলে যায়। প্রথম থেকেই আমার মেয়ে আমার সঙ্গে থাকত। মাঝেমধ্যে সে আমাদের বাড়িতে আসত এবং আসমাকে তার দেশের বাড়ি মাগুরার নিয়ে যেত এবং খুলনার ফুলতলায়ও নিয়ে যেত।
তিনি বলেন, হঠাৎ খুলনা থেকে সকালে সৌমেন আমাদের শহরের বাড়িতে আসে। তখন আসমা গ্রামের বাড়িতে ছিল। সে ফোন দিয়ে আসমাকে শহরে নিয়ে আসে এবং তাকে মাগুরায় যেতে হবে, রেডি হতে বলে। সকাল ১০টার দিকে আমাদের বাড়ি থেকে বের হয়। পরে জানতে পারি আমার মেয়ে ও নাতিকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। সৌমেন প্রথম থেকেই আমার মেয়েকে নির্মমভাবে নির্যাতন ও মারধর করত। আমি এই হত্যাকা-ের সঠিক বিচার চাই। সৌমেনের ফাঁসি চাই।
ফুলতলা থানা সূত্রে জানা গেছে, সৌমেন খুলনা ফুলতলা থানার এসআই পদে কর্মরত আছেন। তবে ছুটি না নিয়েই তিনি কুষ্টিয়ায় গেছেন।
জাফর নামে শাকিলের এক সহকর্মী বলেন, সকালে অফিস থেকে বের হয়ে আমরা মার্কেটে যাই। তারপর জানতে পারি শাকিল খুন হয়েছেন।
শাকিলের সঙ্গে আসমার অনৈতিক সম্পর্ক ছিল বলেও পুলিশের একটি সূত্রে খবর পাওয়া গেছে। সূত্রটি বলছে, অনৈতিক এ সম্পর্কের কথা জেনে যাওয়ায় সৌমেন এ হত্যাকা- ঘটান।
এ বিষয়ে কুষ্টিয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আমরা বিষয়টি তদন্ত করে দেখছি। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। অভিযুক্তের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, সৌমেন পুলিশের এএসআই। বর্তমানে খুলনার ফুলতলা থানায় কর্মরত। এর আগে তিনি কুষ্টিয়ায় চাকরি করেছেন। পরকীয়ার জেরে এ ঘটনা ঘটেছে বলে জানা গেছে। এ ঘটনায় পুরো এলাকা পুলিশ মোতায়েন রয়েছে।
দীর্ঘদিন পর এলাকায় এমন একটি হৃদয়বিদারক ঘটনা দেখে সকলে হতবিহবল হয়ে যায়। এ ঘটনায় দোষী পুলিশের ওই এএসআইর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন এলাকাবাসী।
আমাদের ফুলতলা প্রতিনিধি জানান, ফুলতলা থানার অফিসার ইনচার্জ মাহাতাব উদ্দিন জানান, মাগুরা সদর থানার আসবা গ্রামের সুনীল রায়ের পুত্র এএসআই সৌমেন রায় ২০২০ সালের ডিসেম্বরে ফুলতলা থানায় যোগদান করে। সে ফুলতলায় প্রথম স্ত্রী লাকি রায়সহ এক পুত্র ও এক কন্যা নিয়ে বসবাস করত। গতকাল ভোর সাড়ে ৫ টায় কাউকে কিছু না জানিয়ে সে ঘটনাস্থলে চলে যায়।
কুষ্টিয়ায় তিনজনকে প্রকাশ্যে হত্যা করলেন এএসআই
Leave a comment