জন্মভূমি রিপোর্ট : রূপসা আজগড়া ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডের সদস্য অপূর্ব কুমার মল্লিক এলাকাবাসীদের সাথে নিয়ে নিজেদের উদ্দ্যোগে স্বতন্ত্র প্রার্থী এস এম মোর্ত্তজা রশিদী দারার পক্ষে নির্বাচনী অফিস করেছেন। হিন্দু অধ্যাষূত এ এলাকার ৮০ ভাগ মানুষ এবারের নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে ভোট দেওয়ার অভিব্যক্তির কথা বলেছেন। তারা বলেছেন ‘নৌকা’ নয় নৌকার মাঝি পরিবর্তন করতে চান। শুধু খুলনা-৪ আসনই নয়, খুলনা-৫ ও ৬ আসনের চিত্র এমনই। এবারের নির্বাচনে খুলনার তিনটি আসন যথাক্রমে খুলনা -৪, ৫ ও ৬ আসনে নৌকার মাঝি পরিবর্তনের পক্ষে রয়েছেন অধিকাংশ ভোটার। তাদের দাবি-ভোট দেওয়ার উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টিহলে তারা ভোট কেন্দ্রে যাবেন এবং পরিবর্তনের পক্ষে রায় দেবেন।
এদিকে নির্বাচনের মাত্র একদিন বাকী। এ তিনটি আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের উদ্বেগ উৎকন্ঠা বাড়ছে। তারা প্রতিপক্ষ প্রার্থীর বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, বিভিন্ন অপপ্রচার, পেশীশক্তি প্রয়োগ, নির্বাচনে দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারী কর্মকর্তাদের তাদের পক্ষে কাজ করার অভিযোগ আনছেন। এসব আসনে পাল্টাপাল্টি অভিযোগের ফাইল ভারী হচ্ছে। তবে সাধারণ ভোটাররা অবাধ, সুষ্টু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য পরিবেশ সৃষ্টি করার দাবি জানিয়েছেন।
খুলনা-৪ ঃ খুলনা-৪ (রূপসা, তেরখাদা ও দিঘলিয়া) আসনে ভোটার রয়েছে ৩ লাখ ৫৫ হাজার ১৫৩ জন। রূপসা, তেরখাদা ও দিঘলিয়া উপজেলা নিয়ে গঠিত এই আসনে ভোট কেন্দ্র রয়েছে ১৩৩টি ও ভোট কক্ষ রয়েছে ৮০৫টি।
এ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বর্তমান সংসদ সদস্য আব্দুস সালাম মূর্শেদী ‘নৌকা‘ প্রতীক এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী এস এম মোর্ত্তজা রশিদী দারার মধ্যে তুমুল প্রতিদ্বন্দিতা হবে এটা নিশ্চিত করে বলা যায়। তবে ভোট জরিপে দারা অনেকটাই এগিয়ে আছেন। সংসদ সদস্য হয়েও এলাকায় না আসা, উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা না রাখাসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে বর্তমান সংসদ সদস্য সালাম মূর্শেদীর বিরুদ্ধে।
ইউপি সদস্য অপূর্ব কুমার মল্লিক বলেন, আজগড়ার ৮০ ভাগ ভোটই স্বতন্ত্র প্রার্থী দারার ‘ঈগল‘ প্রতীকেই পরবে। তিনি বলেন, গত পাঁচ বছর সালাম মূর্শেদী এলাকায় একটিবারের জন্যও আসেন নি। রাস্তাঘাটের উন্নয়নে তার নজর ছিলনা। এ কারণে এবার তারা নৌকার মাঝি পরির্বতন চাচ্ছেন।
রূপসার আইচগাতী ওয়ার্ড আওয়ামীলীগের সহ-সভাপতি মল্লিক বজলার রহমান বলেন, এ এলাকায় একাধিকবার নির্বাচিত প্রয়াত এস এম মোস্তফা রশিদী সুজা এলাকায় অনেক উন্নয়ন করেছেন। তারই ভাই এস এম মোর্ত্তজা রশিদী দারা এবার স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। আমরা এবার তাকে ভোট দেব। তিনি বলেন, এলাকায় মাদকে ছেয়ে গেছে। কিন্তু বর্তমান সংসদ সদস্য তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। এলাকার মানুষ তার উপর বিরক্ত। ভোটের পরিবেশ সৃষ্টি হলে এস এম মোর্ত্তজা রশিদী দারা বিপুল ভোটে জয়লাভ করবে।
আওয়ামীলীগের তৃণমুল পর্যায়ের নেতা মাসুদ মল্লিক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, তার বাবা মল্লিক মাহবুবার রহমান দীর্ঘদিন রূপসা থানা আওয়ামীলীগের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। আমরাই আওয়ামীলীগের পরিক্ষীত কর্মী। কিন্তু সালাম মূর্শেদী আমাদের মূল্যায়ণ করেনি। তিনি এলাকায় তেমন আসেন না, এখন হাইব্রীডদের নিয়ে চলাফেরা করছেন। তিনি অতিথি পাখি। খুলনায় হেলিকপ্টারে মাঝে মাঝে এসে শহরের বাসভবনে বৈঠক করে ঢাকায় ফিরে গেছেন। ৫ বছরে এলাকার উন্নয়ন করেন নি। বরং সুজা ভাই অনেক উন্নয়ন করেছেন।
দিঘলিয়া উপজেলার মাঝরিগাতী গ্রামের কৃষক ইলিয়াস শেখ বলেন, আমার নামে ৭টি মিথ্যা মামলা হয়েছে অথচ এমপি সাহেবের কাছে গিয়ে প্রতিকার পাইনি। একই এলাকার তফসির উদ্দিন বলেন, আমার দোকান দখল করে নিয়েছে হাইব্রীড নেতারা। কিন্তু তারাই এমপি সাহেবের পেছনে ঘোরে।
জোয়ার বাধাঁল গ্রামের হুমায়ূন মল্লিক বলেন, নির্বাচনে কেউ তাদের উপর চাপ প্রয়োগ করছে না। তবে নির্বাচন পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ অবস্থা বিরাজ করলে ভোটাররা ভোট কেন্দ্রে যাবে। কাকে এবং কেন ভোট দেবেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা এবার পরিবর্তন চাই। কারণ, এলাকার সংসদ সদস্যকে পাওয়া যায়না। এলাকার চাইতে তিনি ঢাকায় তার ব্যবসার কাজে সময় বেশি দেন।
আইচগাতী গ্রামের পপুলার জুট মিলের ম্যাকানিক মিস্ত্রী খোকন শেখ নির্বিঘ্নে ভোট দেওয়ার পরিবেশ সৃষ্টি করার নিশ্চিয়তা চেয়ে বলেন, নিরপেক্ষ ভোট হলে দারা বিপুল ভোটে জয়লাভ করবে।
৯২ বছর বয়সী প্রবীণ ভ্যান চালক মোক্তার হোসেন বলেন, বর্তমান সংসদ সদস্য সালাম মূর্শেদী গত নির্বাচনের আগে গলা জড়িয়ে ধরে সব সময় পাশে থাকার কথা বলেছিলেন। কিন্তু জয়লাভ করার পর ৫ বছরেও তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। করনা মহামারির সময়েও তাকে পাওয়া যায়নি। ফেয়ার ইলেকশন হলে আমরা ভোট দিয়ে নেতা পরিবর্তন করবো।
তেরখাদা উপজেলা আওয়ামীলীগের স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক বিপুল মল্লিক বলেন, আমরা নৌকার পক্ষে কাজ করছি কিন্তু সাধারণ ভোটারদের চিন্তা আলাদা। কেন জানি ভোটাররা বর্তমান সংসদ সদস্যের প্রতি মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। তারপরেও আমরা চেষ্টা করছি জনপ্রিয়তা ফিরিয়ে আনার।
খুলনা-৫ আসন ঃ খুলনা-৫ আসন (ডুমুরিয়া ও ফুলতলা উপজেলা) এই আসনে এবার ভোটার ৩ লাখ ৮৩ হাজার ২১৯ জন। ভোট কেন্দ্র ১৩৫টি এবং বুথ থাকবে ৮৪৫টি। এ আসনে আওয়ামীলীগের প্রার্থী ও বর্তমান সংসদ সদস্য এবং সাবেক মৎস্য ও পশুসম্পদ মন্ত্রী নারায়ণচন্দ্র চন্দ ‘নৌকা‘ প্রতীকের সঙ্গে প্রতিপক্ষ স্বতন্ত্র প্রার্থী শেখ আকরাম হোসেনের লড়াই হবে হাড্ডাহাড্ডি। এখানকার ভোটারদের একটি বড় অংশ পরিবর্তনের আভাস দিয়েছেন। তারা নৌকার মাঝি পরিবর্তন চান।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন প্রভাবশালী আওয়ামীলীগ নেতা বলেছেন, সংসদ সদস্য নারায়ন চন্দ্র চন্দ বিগত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের বিপক্ষে কাজ করেন। ফলে ১৪টি ইউনিয়নের মধ্যে ১২টিতেই পরাজিত হয় নৌকা সমর্থিত চেয়ারম্যান প্রার্থীরা। সংসদ সদস্যের আর্শিবাদপুষ্ট স্বতন্ত্র নির্বাচিত দশজন চেয়ারম্যান নারায়ন চন্দ্র চন্দের পক্ষে কাজ করছেন। অপরদিকে পরাজিত নৌকার ৯ জন প্রার্থী সরাসরি আকরাম হোসেনের পক্ষে রয়েছেন।
খুলনা জেলা আওয়ামীলীগের সহসভাপতি মোস্তফা কামাল খোকন রুদাঘড়া ইউনিয়ন পরিষদে চেয়ারম্যান পদে নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করে তৃতীয়স্থান লাভ করেন। এটিকে তিনি ভালোভাবে নেননি। তিনি আকরাম হোসেনের পক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছেন।
স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতা কাজী আলমগীর গুটুদিয়া ইউনিয়ন পরিষদে চেয়ারম্যান পদে নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করে চতুর্থস্থান লাভ করেন। তার এভাবে শোচনীয় পরাজয়ের পেছনে নারায়ন বাবুর হাত রয়েছে বলে তিনি মনে করেন। তাকেও ঈগল প্রতীকের পক্ষে কাজ করতে দেখা গেছে।
এলাকা ঘুরে সাধারণ ভোটারদের সাথে কথা বলে জানাগেছে, ফুলতলা উপজেলার ৪টি ইউনিয়নে স্বতন্ত্র প্রার্থী শেখ আকরাম হোসেনের অবস্থা খুবই ভালো। ধামালিয়া ও সাহস ইউনিয়নে তার জনপ্রিয়তা বেড়েছে। এছাড়া ডুমুরিয়ার ১২টি ইউনিয়নেও জনসমর্থন বেড়েছে আকরামের। নারায়ণ চন্দ্র চন্দও কাজ করছেন।
ডুমুরিয়ার খর্ণিয়া ইউনিয়নের ভোটার আব্দুস সাত্তার গাজী বলেন, নারায়ণ চনন্দ্র চন্দ টানা ১৫ বছর ধরে সংসদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার কারণে তার জনপ্রিয়তা কমেছে। এলাকার মানুষ এখন পরিবর্তন চায়। নতুন মূখ চান।
আটলিয়া ইউনিয়নের ভোটার কারিমুল ইসলাম সুষ্টু নির্বাচন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে বলেছেন, এবার নির্বাচন বাঁধাগ্রস্ত হলে দুই পক্ষের মধ্যে মারামারি হবে। তিনি বলেন, নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে ততই দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা বাড়ছে।
রুদাঘরা ইউনিয়নের ভোটার আবু তালেব শেখ বলেন, বর্তমান সংসদ সদস্য নারায়ন চন্দ্র চন্দ এলাকার পাশ দিয়ে গেলে হাত মেলান না। হাত নেড়ে চলে যান। তাছাড়া বিগত ইউপি নির্বাচনে তার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কাজেই আমরা এবার পরিবর্তনের পক্ষে।
খুলনা-৬ আসন ঃ খুলনা-৬ (কয়রা ও পাইকগাছা) সবচেয়ে বড় সংসদীয় আসন। এ আসনে এবার ভোটার সংখ্যা ৪ লাখ ৫ হাজার ৩১৬ জন। এ আসনে ১৪২টি ভোট কেন্দ্র ও ৯২২টি ভোট কক্ষ রয়েছে ।
এ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মো. রশীদুজ্জামান ‘নৌকা‘ প্রতীক এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী জি এম মাহবুবুল আলম ‘ঈগল‘ প্রতীকের লড়াই জমে উঠেছে।
কয়রার আমাদী, বাগালী, মহেশ্বরীপুর, মহারাজপুর, কয়রা, উত্তর বেদকাশি ও দক্ষিণে বেদকাশি ইউনিয়নের ভোটারদের সাথে কথা বলে জানাগেছে স্বতন্ত্র প্রার্থী জি এম মাহবুবুল আলমের জনপ্রিয়তা অনেক বেড়েছে।
আমাদী ইউনিয়নের সাত্তার গাজী, বাগালীর সোয়েব ঢালী, মহেশ্বরীপুরে পরমেশশ^র ঢালিসহ একাধিক ভোটাররা জানান, সুষ্ঠু ভোট হলে স্বতন্ত্র প্রার্থী জি এম মাহবুবুল আলমের ঈগল প্রতীক জয়লাভ করবে। তবে পাইকগাছা উপজেলায় ভোট ব্যাংক রয়েছে মো. রশীদুজ্জামানের।
কপিলমূনীর মৎস্য ব্যবসায়ী খলিুলুর রহমান বলেছেন, নির্বাচন সুষ্ঠু হবে কিনা এখনই বলা মুশকিল। নির্বাচন সুষ্ঠু হলে স্বতন্ত্র প্রার্থী বিপুল ভোটে জয়লাভ করবে। তিনি বলেন, ভোট দেওয়ার পরিবেশ সৃষ্টি হলে পরিবার পরিজন নিয়ে কেন্দ্রে যাবেন। না হলে তারা ভোট দিতে যাবেন না।
খুলনা-৬ আসনে তৃণমূল বিএনপি সমর্থিত নাদির উদ্দিন বলেছেন, পরিস্থিতি দিন দিন ঘোলাটে হচ্ছে। এখনই সংঘাত, সংর্ঘর্ষ নিয়ে আশংকা করা যাচ্ছে না।
আওয়ামী লীগের প্রার্থী মো. রশীদুজ্জামান বলেন, ভোটারদের কেন্দ্রমূখী করতে তিনি কাজ করছেন। বিপুল ভোটে জয়লাভ করার আশা প্রকাশ করেছেন তিনি।
এদিকে শেষ মূহুত্যে এসে খুলনা-৪ আসনে প্রতিদ্বন্দি প্রার্থী সালাম মূর্শেদী এবং এস এম মোর্ত্তজা রশিদী দারা একে অপরের বিরুদ্ধে অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগ দিয়েই চলেছেন। সংবাদ সম্মেলন করে তারা একে অপরের বিরুদ্ধে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ করার অভিযোগ তুলছেন। অপরদিকে খুলনা-৫ আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য ও সংসদ সদস্য প্রার্থী নারায়ণ চন্দ্র চন্দের বিরুদ্ধে নির্বাচন আচরণবিধি লংঘনের অভিযোগ তুলেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী শেখ আকরাম হোসেন। সংবাদ সম্মেলন করে তিনি প্রতিবাদ করছেন। তবে নারায়ণ চন্দ্র চন্দ এখোনো আন্ঠুানিক প্রতিক্রিয়া দেখাননি।
খুলনা- ৪, ৫ ও ৬ আসন: ‘নৌকা’ নয় ‘মাঝি’ পরিবর্তন চান ভোটাররা
Leave a comment