জন্মভূমি ডেস্ক : ‘চারদিক থেকে গোলাগুলির শব্দ। ভয়ে ছোট বাচ্চাকে নিয়ে প্রথমে খাটের নিচে অবস্থান নিই। বেশ কিছুক্ষণ চলে গোলাগুলি। বাইরে হইচই আওয়াজ। সবাই পাশের জঙ্গলে চলে যাচ্ছে। এরই মধ্যে বাচ্চাকে নিয়ে বের হয়ে পড়ি। গোলাগুলি থেকে বাঁচতে গ্রামের অন্য মানুষের সঙ্গে জঙ্গলে আশ্রয় নিই।’
বান্দরবানের থানচি উপজেলার ফজল পাড়া বাজার সংলগ্ন বাড়ির বাসিন্দা নুরবানু বেগম বলছিলেন এসব কথা। এমন আতঙ্কের মধ্যে গতকাল বৃহস্পতিবার রাত পার করেন তাঁর মতো ওই পাড়ার আরও দেড়শ পরিবার। সবাই পাশের জঙ্গলে অবস্থান নিয়ে নিজেদের বাঁচানোর চেষ্টা করে।
থানচি উপজেলাটি বান্দরবান সদর থেকে প্রায় ৭৮ কিলোমিটার দূরে। থানচির পাশ্ববর্তী উপজেলা রুমা ৩০ কিলোমিটার দূরে। এই দুটি উপজেলায় সন্ত্রাসী সংগঠন কেএনএফ গত মঙ্গলবার থেকে চার দফা হামলা করেছে। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার রাত ৮টা ২০ মিনিটের দিকে থানচি থানা ঘেরাও করে হামলা করার চেষ্টা করে। তবে, এই হামলা ঠেকিয়ে দেয় আইনশৃঙ্খলাবাহিনী।
স্থানীয়রা জানান, থানচি থানার পাশে ফজল পাড়া, হেডমেন পাড়া ও বাঙালি পাড়া। এই তিন পাড়া মিলে প্রায় ৫০০ পরিবারের বাস। কেএনএফ যখন গোলাগুলি শুরু করে তখন আতঙ্কে দিকবেদিক ছুটতে থাকে থানচি থানার আশেপাশে পুরো এলাকার মানুষ। এরইমধ্যে ফজল পাড়া, হেডমেন পাড়া ও বাঙালি পাড়ার ৫০০ পরিবার পাশের জঙ্গলে আশ্রয় নেন। রাত সাড়ে ৮টা থেকে প্রায় ১০টা পর্যন্ত আশ্রয় নেন তারা। পরে, যখন শুনে কেএনএফ চলে গেছে তখন বাড়িতে ফিরে আসে। কিন্তু বাড়িতে আসলেও কারও রাতে ঘুম হয়নি। আতঙ্কে রাত কেটেছে সবার।
থানচির ফজল পাড়ার বাসিন্দা আরিফ ওরফে কানাইয়া বলেন, ‘৮টা ২০ মিনিটে আমরা গোলাগুলির শব্দ শুনতে পাই। হেডমেন, ফজল ও বাঙালি পাড়ার মানুষজন ভয়ে জঙ্গলে পালিয়ে যায়। দুই ঘণ্টা আমরা সবাই জঙ্গলেই অবস্থান করি। ছোট বাচ্চা বৃদ্ধকেও নিয়ে গেছে জঙ্গলে।’
থানচি হেডমেন পাড়ার বাজার সংলগ্ন বাসিন্দা চাই হুং প্রো মাস্টার বলেন, ‘গুলি থেকে বাঁচতে আমরা প্রায় পরিবারের ৮জন জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছি। এরকম পরিস্থিতি তিনি আর কোনোদিন দেখেননি।’
এদিকে ওইদিন রাতে যারা ব্যবসা পরিচালনা করছিলেন, তারা গুলির শব্দে ভয়ে কেউ খাদ্য গুদামে আর কেউ দোকান বন্ধ করে ভেতরে অবস্থান নেন।
থানচির জান্নাত রেস্টুরেন্টের কর্মচারী মো. মহসীন বলেন, ‘এমন গোলাগুলি মুভিতেও দেখিনি। টানা দুই ঘণ্টা গোলাগুলির শব্দ। ভয়ে আমরা রেস্টুরেন্ট বন্ধ করে খাদ্য গুদামে আশ্রয় নিয়েছি।’
থানচি সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান অংপ্রু ম্রো বলেন, পুরো রাত এলাকার মানুষ আতঙ্কে কেটেছে। কেউ কেউ নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য জঙ্গলেও অবস্থান নেয়। চারিদিকে শুধু গোলাগুলি চলে।
পুলিশ জানায়, বৃহস্পতিবার রাতে থানচি থানা আক্রমণ চেষ্টার আগে কেএনএফের একটি দল রেকি করে চলে যায়। তারপর থানচি উপজেলার নাইক্ষ্যান পাড়া থেকে থানার দিকে আসার চেষ্টা করে ৮০-৯০ জনের সশস্ত্র দল। উপজেলার হাসপাতাল রোড দিয়ে আরও ৩০ জনের একটি দল থানা আক্রমণ করার চেষ্টা করে। তখন আত্মরক্ষার্থে পুলিশ গুলি করে আক্রমণ ঠেকিয়ে দেয়।
ওইদিনের থানা আক্রমণ করার বর্ণনা দেন থানচি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. জসিম উদ্দিন। নিজেরা এখনো আতঙ্ক ও ঝুঁকির মধ্যে আছেন বলে জানান তিনি। কারণ এখনো সশস্ত্র ওই গোষ্ঠি থানার এক কিলোমিটার এলাকায় অবস্থান করছে বলে জানতে পেরেছে পুলিশ।
সশস্ত্র ওই দলটির সঙ্গে পুলিশের এক ঘণ্টা গুলিবিনিময় হয়। ৪০০-৫০০ রাউন্ড গুলি ছোঁড়া হয় বলে থানা সূত্রে জানা গেছে। করে। থানচির সোনালি ব্যাংক শাখায় নিরাপত্তায় নিয়োজিত পুলিশ সদস্যের ওপরও গুলি করে ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টির পাঁয়তারা করে তারা।
আজ শুক্রবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে থানার সামনে ওসি জসিম উদ্দিন বলেন, এখনো এক কিলোমিটারের মধ্যে ওই সশস্ত্র দল অবস্থান করছে।
এদিকে থানচিতে কেএনএফের আক্রমণের ঘটনায় বেশিরভাগ দোকানপাট বন্ধ রেখেছে ব্যবসায়ীরা। ব্যবসায়ীদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
সরেজমিন থানচি সদর উপজেলার বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বেশিরভাগ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। যারা খোলা রেখেছেন, তারা আতঙ্কের মধ্যে আছেন।
মুদির দোকানদার আরমান হোসেন বলেন, ‘আমরা পরিস্থিতি শান্তি চাই। আমাদের নিরাপত্তা চাই।