জন্মভূমি ডেস্ক : শর্ত পরিপালন সাপেক্ষে আগামী দুই অর্থবছরের জন্য করপোরেট কর কমানো হচ্ছে। আড়াই শতাংশ হারে চার খাতে এই কর কমানো হচ্ছে। আগামী ২০২৪-২৫ এবং ২০২৫-২৬ অর্থবছরে করদাতারা করপোরেট করছাড়ের এই সুবিধা পাবেন। তবে সমবায় সমিতির করহার পাঁচ শতাংশ বাড়ানো হচ্ছে। এই খাতেও দুই বছর বর্ধিত হারে করপোরেট কর দিতে হবে। ছাড়ের সুবিধা পেতে হলে সব ধরনের আয় প্রাপ্তি এবং প্রত্যেক একক লেনদেনে পাঁচ লাখ টাকার অধিক ও বার্ষিক মোট ৩৬ লাখ টাকার বেশি সব ধরনের ব্যয় ও বিনিয়োগ ব্যাংক ট্রান্সফারের মাধ্যমে করতে হবে। আগামীকাল ৬ জুন বাজেটে এই ঘোষণা দেয়া হতে পারে। তবে শর্তের কারণে ছাড়ের সুবিধা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ভোগ করতে পারে না বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
এনবিআর সূত্রমতে, বর্তমানে কোম্পানি করদাতার জন্য খাতভিত্তিক অনেক করপোরেট করহার কার্যকর রয়েছে। এর মধ্যে চারটি খাতে শর্তসাপেক্ষে করপোরেট কর কমানো হচ্ছে, যার মধ্যে রয়েছেÑতালিকাভুক্ত কোম্পানি, যাদের মূলধনের ১০ শতাংশের অধিক শেয়ার আইপিওর মাধ্যমে হস্তান্তর করা হয়, তাদের করহার বর্তমানে ২০ শতাংশ। তবে শর্ত পরিপালনে ব্যর্থতার জন্য এসব কোম্পানিকে চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছর সাড়ে ২২ শতাংশ হারে কর দিতে হচ্ছে। আগামী ২০২৪-২৪ ও ২০২৫-২৬ অর্থবছর ২০ শতাংশ হারে দিতে পারবে। একইভাবে তালিকাভুক্ত কোম্পানি, যাদের মূলধনের ১০ শতাংশ বা ১০ শতাংশের কম শেয়ার আইপিও’র মাধ্যমে হস্তান্তর করা হয়, তাদের করহার বর্তমানে সাড়ে ২২ শতাংশ। শর্ত পরিপালন না করলে ২৫ শতাংশ। তবে শর্ত পরিপালনে ব্যর্থতার জন্য এসব কোম্পানিকে চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছর সাড়ে ২২ শতাংশ হারে কর দিতে হচ্ছে। আগামী ২০২৪-২৪ ও ২০২৫-২৬ অর্থবছর ২০ শতাংশ হারে দিতে পারবে।
আয়কর আইনে সংজ্ঞায়িত কোম্পানিগুলোর মধ্যে যারা তালিকাভুক্ত নয়, সেসব কোম্পানির ক্ষেত্রে করহার শর্তসাপেক্ষে সাড়ে ২৭ শতাংশ। শর্ত পরিপালন না করলে ৩০ শতাংশ। তবে আগামী দুই অর্থবছর ২৫ শতাংশ করা হচ্ছে। অর্থনীতিকে অধিকতর আনুষ্ঠানিক করা এবং এক ব্যক্তি কোম্পানির প্রতিষ্ঠা উৎসাহিত করার লক্ষ্যে নন-লিস্টেড কোম্পানিগুলোর মতোই শর্ত পরিপালন সাপেক্ষে এক ব্যক্তি কোম্পানির করহার সাড়ে ২২ থেকে ২০ শতাংশ করা হচ্ছে। কর-জিডিপি হার বৃদ্ধির প্রচেষ্টা হিসেবে সার্বিক বিবেচনায় সমবায় সমিতির জন্য করহার ১৫ থেকে বাড়িয়ে ২০ শতাংশ করা হচ্ছে। আগামী দুই অর্থবছর সমবায় সমিতিকে এই বর্ধিত হারে কর দিতে হবে। বাকি সব খাতের করপোরেট করহার অপরিবর্তিত রাখা হচ্ছে। বাজেটে করমুক্ত আয়সীমা, ন্যূনতম কর ও সম্পদ কর অপরিবর্তিত রাখা হচ্ছে।
এনবিআর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কালোটাকা সাদা করার সুযোগ রাখা হচ্ছে। এর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, ডেটা ভেরিফিকেশন সিস্টেম (ডিভিএস) চালু হওয়ার ফলে বিভিন্ন কোম্পানির অপ্রদর্শিত আয় ও পরিসম্পদ প্রদর্শনে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া রিটার্ন দাখিলে করদাতার অজ্ঞতাসহ অনিবার্য কিছু কারণে অর্জিত সম্পদ প্রদর্শনে ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকতে পারে। এতে করদাতাদের আয়কর রিটার্নে এই ত্রুটি সংশোধনের সুযোগ দেয়া এবং অর্থনীতির মূল স্রোতে অর্থপ্রবাহ বৃদ্ধির লক্ষ্যে কালোটাকা সাদা করতে আয়কর আইনে কর প্রণোদনা-সংক্রান্ত একটি অনুচ্ছেদ সংযোজন করা হচ্ছে। প্রস্তাবিত বিধান অনুযায়ী, দেশের প্রচলিত আইনে যাই থাকুক না কেন, কোনো করদাতা স্থাবর সম্পত্তি, যেমন ফ্ল্যাট, অ্যাপার্টমেন্ট ও ভূমির জন্য নির্দিষ্ট করহার এবং নগদসহ অন্যান্য পরিসম্পদের ওপর ১৫ শতাংশ কর পরিশোধ করলে কোনো কর্তৃপক্ষ কোনো প্রকারের প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারবে না।
সূত্রমতে, কয়েকটি খাতে রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র, করহার যৌক্তিককরণ ও কর কমানো হচ্ছে। রাজস্ব আদায়ের নতুন ক্ষেত্র সৃষ্টি ও ব্যবসায় সমতামূলক প্রতিযোগিতা আনতে বাজেটে এই পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। যার মধ্যে রয়েছেÑউৎসে কর কর্তন বা সংগ্রহের জন্য রিসোর্ট, মোটেল, রেস্টুরেন্ট, কনভেনশন সেন্টারকে নির্দিষ্ট ব্যক্তির সংজ্ঞায় অন্তর্ভুক্ত করা, যাদের রিটার্ন দাখিলের আইনানুগ বাধ্যবাধকতা রয়েছে, সেসব ব্যক্তির স্বনির্ধারণী পদ্ধতিতে রিটার্ন দাখিল করার বিধান করা; হোটেল, রেস্টুরেন্ট, মোটেল, হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর লাইসেন্স প্রাপ্তি ও নবায়নকালে এবং কমিউনিটি সেন্টার, কনভেনশন হল বা সমজাতীয় কোনো সেবা গ্রহণকালে রিটার্ন দাখিলের প্রমাণ উপস্থাপনের বাধ্যবাধকতা আরোপ করা; ব্যবসা স্থানে রিটার্ন দাখিলের প্রমাণ প্রদর্শনের ব্যর্থতায় অন্যূন ২০ হাজার টাকা এবং অনধিক ৫০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান করা; রিটার্ন দাখিলে বাধ্য নয়, এরূপ কোনো কোম্পানি কর্তৃক প্রাপ্ত যেকোনো প্রকারের গ্রস আয় যা করমুক্ত নয় বা দান-অনুদান নয় বা কোনো প্রকারের কর, খাজনা ও শুল্ক নয়, এর ওপর করারোপ করা; ধান, গম, গোল আলু, পেঁয়াজ, রসুন, মটরশুঁটি, ছোলা, মশুর ডাল, আদা, হলুদ, শুকনো মরিচ, ডাল, ভুট্টা, মোটা আটা, আটা, লবণ, ভোজ্যতেল, চিনি, কালো গোলমরিচ, দারুচিনি, বাদাম, লবঙ্গ, ক্যাসিয়া পাতা, পাট, তুলা এবং সুতা কেনার জন্য খোলা স্থানীয় ঋণপত্র খোলা বা অন্য কোনো অর্থায়ন চুক্তির ক্ষেত্রে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক পরিশোধিত বা ঋণকৃত পরিমাণের ওপর ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক কর কর্তনের হার যৌক্তিকীকরণ; শ্রমিক অংশগ্রহণ তহবিল, শ্রমিক কল্যাণ তহবিল এবং শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনে প্রদেয় অর্থের বিপরীতে উৎসে কর কর্তনের বিদ্যমান বিধান অধিকতর সুস্পষ্টভাবে প্রতিস্থাপন; কোনো সেলুলার মোবাইল ফোন অপারেটর কর্তৃক পরিশোধিত আয় বণ্টন বা কোনো লাইসেন্স ফি বা অন্য কোনো ফি বা চার্জ হতে কর কর্তন করার হার বৃদ্ধি করা; ট্রাস্ট, ব্যক্তিসংঘ, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানের সুদ আয় হতে ২০ শতাংশ হারে এবং বিভিন্ন ফান্ড ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সুদ আয় হতে ১০ শতাংশ হারে কর কর্তন করা; ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী হতে বিদ্যুৎ ক্রয়ের বিপরীতে কর কর্তন করার হার যৌক্তিকীকরণ; দলিল হস্তান্তরের ক্ষেত্রে উৎসে কর সংগ্রহের প্রযোজ্যতার বিধান করা; ইট প্রস্তুত বা উৎপাদনের লাইসেন্স প্রদান বা নবায়নের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তি কর্তৃক লাইসেন্স প্রদান বা নবায়নের ক্ষেত্রে কর সংগ্রহের বিধান যৌক্তিকীকরণ।
অন্যদিকে বর্তমানে ২৬টি ডিজিটাল সেবার ওপর অব্যাহতি রয়েছে। সেখান থেকে বেশ কিছু সেবার ওপর অব্যাহতি তুলে দেয়া হয়েছে। নতুন করে কিছু সংযোজন করে মোট ১৯টি সেবার ওপর অব্যাহতি রাখা হয়েছে। কর্মকর্তারা বলছেন, স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের সহায়ক হিসাবে এসব অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। তবে এসব সেবা বা ব্যবসা থেকে উদ্ভূত আয় ও সব ব্যবসায়িক কার্যক্রম ক্যাশলেস হওয়ার শর্তে তিন বছর করমুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। ১৯টি সেবা হলোÑএআই বেজড সলিউশন ডেভেলপমেন্ট; ব্লকচেইন বেজড সলিউশন ডেভেলপমেন্ট; রোবোটিকস প্রসেস আউটসোর্সিং; সফটওয়্যার অ্যাজ আ সার্ভিস; সাইবার সিকিউরিটি সার্ভিস; ডিজিটাল ডেটা অ্যানালাইটিকস ও ডেটা সায়েন্স; মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন ডেভেলপমেন্ট সার্ভিস; সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট ও কাস্টমাইজেশন; সফটওয়্যার টেস্ট ল্যাব সার্ভিস; ওয়েব লিস্টিং, ওয়েবসাইট ডেভেলপমেন্ট ও সার্ভিস; আইটি সহায়তা ও সফটওয়্যার মেইনটেন্যান্স সার্ভিস; জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিস; ডিজিটাল এনিমেশন ডেভেলপমেন্ট; ডিজিটাল গ্রাফিকস ডিজাইন; ডিজিটাল ডেটা এন্ট্রি ও প্রসেসিং; ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্ম ও ই-পাব্লিকেশন; আইটি ফ্রিল্যান্সিং; কল সেন্টার সার্ভিস; ডকুমেন্ট কনভারশন, ইমেজিং ও ডিজিটাল আর্কাইভিং।
অন্যদিকে বাজেটে আয়কর খাতে আর কয়েকটি পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছেÑগ্যাস ও পেট্রোলিয়াম তেল সরবরাহের বিপরীতে উৎসে কর কর্তন; গুঁড়োদুধ, অ্যালুমিনিয়াম পণ্য, সিরামিক পণ্য হতে উৎসে করহার যৌক্তিককরণ করে কর্তিত কর ন্যূনতম কর হিসেবে পরিগণিত করা। এছাড়া স্বাস্থ্য ব্যয় হ্রাস করতে মিষ্টি পানীয় উৎপাদন থেকে আয়ের ওপর বিদ্যমান হার দশমিক শূন্য ৬ শতাংশের পরিবর্তে কার্বোনেটেড বেভারেজের মতো তিন শতাংশ হারে টার্নওভার কর আরোপ করা হচ্ছে।
সূত্রমতে, বেশ কয়েকটি খাতে কর অব্যাহতি সংকুচিত ও যৌক্তিককরণ করা হচ্ছে, যার মধ্যে রয়েছেÑকর অব্যাহতিপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তি তার কর অব্যাহতি পূর্ণাঙ্গ বা আংশিকভাবে সমর্পণপূর্বক নিয়মিত হারে কর পরিশোধ করতে পারবেন; হাইটেক পার্কের সুবিধা কেবল সরকারি হাইটেক পার্কে সীমাবদ্ধ করা এবং অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর ক্ষেত্রেও একই ব্যবস্থা গ্রহণ করা; কোনো ব্যক্তি কোনো একটি উৎসের আয়ের বিপরীতে কোনো নির্দিষ্ট মেয়াদে কর অব্যাহতিপ্রাপ্ত হলে সেই উৎসের আয়ের বিপরীতে আবার অন্য কোনোভাবে অন্য কোনো মেয়াদে কর অব্যাহতিপ্রাপ্ত হবেন না এবং কোনো ব্যক্তি কোনো প্রকারের মার্জার, ডিমার্জার ও অধিগ্রহণের মাধ্যমে পুনর্গঠিত হলেও একইরূপে কর অব্যাহতি প্রাপ্ত হবে না; পেট্রোলিয়াম ও মিনারেল উত্তোলনে নিয়োজিত কোম্পানিগুলোর নিঃশেষ ভাতা অননুমোদন করা; কোনো স্বাভাবিক ব্যক্তি করদাতার কর্তৃক গৃহীত ৫০ লাখ টাকার অধিক কোনো মূলধনি আয় যা তালিকাভুক্ত কোনো কোম্পানি বা তহবিলের শেয়ার বা ইউনিট হস্তান্তর হতে অর্জিত হয়েছে, তা করের আওতাভুক্ত করা।
রিটার্ন দাখিলের বিষয়েও বাজেটে নির্দেশনা আসছে। করদাতাদের রিটার্ন দাখিল এবং কর প্রদানের বিষয়কে জনপ্রিয় করার জন্য স্বাভাবিক ব্যক্তি, কোম্পানি নির্বিশেষে সব রিটার্ন সংশ্লিষ্ট করবছরের জন্য স্বনির্ধারণী ব্যবস্থায় দাখিলের বিধান আনা হচ্ছে বাজেটে। এছাড়া এনবিআর এক মাসের বেশি রিটার্ন দাখিলের সময়সীমা বৃদ্ধি করতে পারবে না বলে নির্দেশনা বাজেটে আনা হচ্ছে।