ইয়াসীন আরাফাত রুমী
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও বৃষ্টিপাতের তারতম্য দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকায় প্রভাব ফেলছে। ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, লবণাক্ততা ও সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ার ঝুঁকিতে রয়েছে দেশের উপকূলীয় অঞ্চল খুলনা।
বাংলাদেশের নিচু আর সমতল উপকূলীয় অঞ্চল এই অযাচিত ভবিষ্যতের সবচেয়ে বড় ভোগান্তির শিকারে পরিণত হবে। বাস্তুচ্যুত হবে লাখো মানুষ। আর ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও লবণাক্ততার অনিবার্য শিকারে পরিণত হবে মানুষ।
মানুষের জীবিকাই অভিবাসনের মূল কারণ। জীবিকা ও অর্থনীতি এর একটি বড় কারণ। জলবায়ু পরিবর্তনের কোন বর্ডার নেই। মানুষ বাস্তুচ্যুত হওয়ার পর অভিবাসী হওয়ার মাঝে অনেকগুলো ধাপ অতিক্রম করে। তারপর ধীরে ধীরে একটি বড় অংশ অভিবাসনের দিকে যায়।
২০০৯ সালে ৬ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি নিয়ে সোচ্চার হন। ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেন জলবায়ু সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতির দিকটি বিশ্ববাসীর কাছে সফলভাবে তুলে ধরেন। তারা বুঝতে পারেন বাংলাদেশই জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। প্রধানমন্ত্রীর বিচক্ষনতায় জলবায়ু সম্মেলনে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হয়। যা একটি বড় অর্জন। কোপেনহেগেন সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি পোষাতে ৩০ বিলিয়ন ডলারের তহবিলের প্রস্তাব করা হয়। বাংলাদেশ তা থেকে ১৫ শতাংশ দাবি করে।
উপকূলীয় এই অংশে দারিদ্রের হানা এরই মধ্যে ঘটে গেছে। বিশেষ করে সুন্দরবন ঘিরে এই দারিদ্র প্রকট। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কর্মশক্তির বয়ঃসীমায় পড়ে এমন মানুষগুলো কাজের খোঁজে অন্যত্র চলে যাচ্ছেন। বিশ্বব্যাংক ব্লগে সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে সমুদ্র তীর থেকে ৪ কিলোমিটার দূর পর্যন্ত অংশটি এধরনের আউট-মাইগ্রেশনের (জীবিকার খোজে অভিবাসন) প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। সাম্প্রতিক ঘূর্ণিঝড়ে এই অঞ্চলগুলো ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত এবং লবণাক্ত পানিতে নিমজ্জিত।
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, এই অভিবাসনে বাইরে যাওয়া মানুষগুলো স্বল্প কর্মদক্ষতার কারণে বেশি আয়ের কাজ করতে পারছে না, কিংবা পাচ্ছে না। ফলে বাড়িতে তারা পর্যাপ্ত অর্থ পাঠাতে পারছে না। আর তাদের দারিদ্র চরম রূপ নিচ্ছে।
জলবায়ু অভিবাসন কিছু অর্থনৈতিক সুবিধা সৃষ্টি করছে বটে, কিন্তু যথেষ্ট চ্যালেঞ্জও রয়েছে। আর বিষয়গুলো যথাযথ ব্যবস্থাপনার আওতায় নিয়ে আসা না হলে, দারিদ্র ভয়াবহ রূপ নিতে পারে, বলা হয়েছে রিপোর্টটিতে।
বিশ্বে প্রতি সাত জনে একজন ব্যক্তি অভিবাসী। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ায় জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পরিবেশগত বিপর্যয় অভিবাসনকে প্রভাবিত করছে। এই সব প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ অভিবাসনের প্রধান কারণ। এর প্রভাবে দেশের বিশাল একটি অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গ্রাম থেকে শহরে ছুটছে।
অভ্যন্তরীণ অভিবাসন ঠেকাতে জেলা পর্যায়ে কর্মসংস্থান বাড়ানো এবং উন্নয়ন কার্যক্রম বিকেন্দ্রীকরণের পরামর্শ দিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অন্তত এ দুটি উদ্যোগ শহরের দিকে ছুটে আসা মানুষের স্রোত কমাতে পারে।
সম্প্রতি বাংলাদেশের খুলনা, রাজশাহী, সুনামগঞ্জ ও পটুয়াখালীতে এই সমীক্ষা চালায় আইওএম। প্রতি জেলায় ৮০টি করে ৩২০টি পরিবারের ওপর জরিপ করা হয়।
ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস ও নদী ভাঙনের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ অভিবাসন বাড়ায় মানুষের জীবন-জীবিকা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) এক সমীক্ষায় উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, খুলনায় ৪৭ শতাংশ ঘূর্ণিঝড়ের কারণে, মাটিতে লবণাক্ততায় ৪৪ শতাংশ, পানিতে লবণাক্ততায় ৪৩ শতাংশ, নদীর ভাঙনে ১০ শতাংশ; পটুয়াখালীতে ঘূর্ণিঝড়ে ৪৪ শতাংশ, পানিতে লবণাক্ততায় ১৮ শতাংশ ও মাটিতে লবণাক্ততায় ১৫ শতাংশ মানুষ অভিবাসনে বাধ্য হয়ে এলাকা ছেড়েছে। ২৪% মানুষের সামাজিক নিরাপত্তায় ‘চাই দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা’।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় অভিযোজনের জন্য অভিবাসন কোনো সমাধান হতে পারে না। এক্ষেত্রে গ্রাম থেকে শহরে ছুটে যাওয়ার (অভিবাসন) প্রবণতাকে নিরুৎসাহিত করে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে অর্থনৈতিক উন্নয়ন কর্মকা- নিয়ে যেতে হবে।
কয়রা-পাইকগাছার সংসদ সদস্য মো. আক্তারুজ্জামান বাবু বলেন, জলবায়ু অভিবাসন ঠেকাতে উপকূলীয় এলাকায় টেকসই বাঁধের কোন বিকল্প নেই। আমি সংসদে এই বিষয়ে কথা বলবো।
উল্লেখ্য, সমুদ্রের পানির স্তরে ১ মিটার উচ্চতা বেড়ে গেলে ১৫ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হবে। আর ২মিটার উচ্চতায় এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ২৮ লাখে। সমুদ্রের উচ্চতা ৩ মিটার পর্যন্ত বাড়লে বাস্তুচ্যুত হবে ৫৪ লাখ বাংলাদেশি। আর তার সাথে সাথে এই উপকূলীয় অংশে বেড়ে যাবে ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস।
জলবায়ু উদ্বাস্তু ঝুঁকিতে খুলনা
Leave a comment