জন্মভূমি ডেস্ক : উন্নত নাগরিক সেবা ও শোভন কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে গ্রাম থেকে শহরে মানুষের স্থানান্তর শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলে আসছে। মানুষের স্থানান্তর হওয়া একটি স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে ব্যাপক মাত্রায় গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর শহরে স্থানান্তর বেড়ে গেছে। এর ফলে বর্ধিত হচ্ছে অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং নিম্নগামী হচ্ছে নাগরিক সেবার মান।
সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) থেকে প্রকাশিত স্যাম্পল ভাইটাল রেজিস্ট্রেশন সিস্টেম (এসভিআরএস) প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০২২ সালে ব্যাপকহারে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর শহরে স্থানান্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। গ্রাম থেকে শহরে মানুষের স্থানান্তর একটি স্বাভাবিক বিষয় হলেও সাধারণত যে হারে এ স্থানান্তর সংঘটিত হয়, ২০২২ সালে তার চেয়ে অনেক বেশি হারে তা সংঘটিত হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, এক জেলার পল্লি এলাকা থেকে অন্য জেলার শহরে প্রতি হাজার জনগোষ্ঠীর বিপরীতে স্থানান্তরিত হয়েছেন ২৬ দশমিক চারজন। ২০২১ সালে এ সংখ্যা ছিল প্রতি হাজারে ১৮ দশমিক চারজন। ২০২০ সালে এ সংখ্যা ছিল হাজারে ১২ দশমিক চারজন। অবশ্য ওই বছর সারাদেশে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছিল। এর আগের বছর ২০১৯ সালে এক জেলার পল্লি এলাকা থেকে অন্য জেলার শহরে স্থানান্তরের সংখ্যা ছিল ১৫ জন এবং এর আগের বছর এটি ছিল ১৬ দশমিক সাত জন। এক জেলার পল্লি থেকে আরেক জেলার শহরে স্থানান্তরের ক্ষেত্রে সাধারণত দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের গ্রাম থেকে রাজধানী ঢাকায় আগমনের হার বেশি ঘটে থাকে। এর বাইরে অন্য বড় শহরেও মানুষের গমন ঘটে। এমন শহরের তালিকায় রয়েছে গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামের মতো শহর, যেখানে শিল্পকারখানার আধিক্য বেশি।
এর বাইরে একই জেলার অভ্যন্তরে সেখানকার গ্রাম থেকে জেলার অভ্যন্তরীণ শহরে স্থানান্তর সংঘটিত হয়। এক্ষেত্রে জেলার গ্রামাঞ্চল থেকে জেলা শহর, উপজেলা শহর ও পৌরসভা শহরে স্থানান্তর ঘটে। জেলার অভ্যন্তরীণ নগরে স্থানান্তরও ২০২২ সালে বেড়েছে। প্রতিবেদনের তথ্যমতে, জেলার অভ্যন্তরীণ পল্লি থেকে শহরে স্থানান্তরিত হয়েছেন প্রতি হাজার জনগোষ্ঠীর বিপরীতে ৫৭ দশমিক তিনজন। এর আগের বছর এ সংখ্যা ছিল ৩০ দশমিক আটজন। ২০২০ সালে এটি ছিল ৩১ দশমিক তিনজন। ২০১৯ সালে এ স্থানান্তরের সংখ্যা ছিল ২৯ দশমিক সাতজন এবং তার আগের বছর এটি ছিল ৩০ দশমিক ছয়জন। পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, ২০২২ সালে হঠাৎ করেই গ্রাম থেকে শহরে মানুষের স্থানান্তর হওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালে দেশের মোট জনসংখ্যার মাত্র আট শতাংশ শহরে বসবাস করতেন। সংখ্যার দিক দিয়ে সেটি ছিল এক কোটিরও নিচে। সে সময়ে নগরকেন্দ্রের সংখ্যাও ছিল অনেক কম। ধীরে ধীরে উন্নয়নের হাত ধরে বাড়তে থাকে নগরকেন্দ্রের সংখ্যা। পাশাপাশি বড় নগরগুলোয় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়ার সুযোগ বেশি থাকায় হু-হু করে মানুষ শহরমুখী হতে থাকে। ১৯৯১ সালে শহরে বসবাসকারীর মানুষের অনুপাত ২০ দশমিক ১৫ শতাংশে উন্নীত হয়। ২০১৪ সালে এটি উঠে আসে ২৯ শতাংশে। ২০২৫ সালে মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ শহরে বাস করবে বলে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় প্রক্ষেপণ করা হয়েছে। অন্যদিকে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যে ২০২১-৪১ প্রেক্ষিত পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে, তাতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ওই সময় দেশের মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশই হবেন শহরের অধিবাসী। কিন্তু শহরে যে হারে মানুষ বাড়ছে, সে হারে শহরের নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না বর্ধিত নগরে। এর ফলে নানা ধরনের নগরকেন্দ্রিক জটিলতা তৈরি হচ্ছে।
বেসরকারি পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) দীর্ঘদিন ধরে নগর দারিদ্র্য ও নগরের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনযাপনের নানা সমস্যা নিয়ে গবেষণা পরিচালনা করে আসছে। নগরে মানুষের চাপ বৃদ্ধি পাওয়ায় কী ধরনের জটিলতা ও সমস্যার উদ্ভব হতে পারে।
জানতে চাইলে সংগঠনটির নির্বাহী চেয়ারম্যান ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ‘শহরে যে হারে গ্রাম থেকে মানুষ স্থানান্তরিত হচ্ছে, তাদের নাগরিক সেবা প্রদানের বিষয়ে শহরগুলোর সক্ষমতা সেই মাত্রায় বৃদ্ধি পাচ্ছে কি না, সেটা দেখার বিষয়। আর শহরে কোন শ্রেণি ও বংশের মানুষের আসার মাত্রা বেশি, সে বিষয়টিও বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। সার্বিকভাবে নগরে গ্রাম থেকে আসা মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে কী কী ধরনের প্রভাব নগরের ওপর পতিত হচ্ছে, তা অনুসন্ধানের জন্য ভালো মানের গবেষণা প্রয়োজন। এ ধরনের গবেষণায় সরকার সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘শহরের সক্ষমতার তুলনায় মানুষ বেশি হলে সাধারণত যেসব সমস্যা দেখা দেয়, তা হচ্ছে অপরিকল্পিত নগরায়ণ বৃদ্ধি পায়, নগরে বস্তিবাসীর সংখ্যা বেড়ে যায় এবং স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পানি সরবরাহসহ বিভিন্ন পরিষেবার সরবরাহে বিঘ্ন ঘটে। কাজেই নগরে আসা মানুষের জন্য যাতে বসবাসের উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা যায়, সে লক্ষ্যে কার্যকর পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে।’
দেশে তিন ধরনের নগরকেন্দ্রে এই জরিপ পরিচালনা করে বিবিএস। এসব শহরের মধ্যে রয়েছে সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও পৌরসভা নেই এমন উপজেলা শহর। বর্তমানে দেশে এই তিন ধরনের নগরকেন্দ্রের সংখ্যা ৬০০টি। সব কেন্দ্রেই কমবেশি গ্রামীণ মানুষের স্থানান্তর সংঘটিত হচ্ছে। তবে রাজধানী ও অন্যান্য বড় শহরে এ স্থানান্তরের মাত্রা অনেক বেশি।