মোঃ আঃ হালিম : সালটা ১৯৯২। সম্ভবত এপ্রিল মাস তখন। সহকর্মী সাংবাদিক (পরবর্তীতে সাতক্ষীরার আশাশুনীর আতরজান মহিলা মহাবিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ বর্তমানে অবসর জীবন যাপন করছেন) আশেক ই এলাহী ভাইয়ের ব্যবস্থাপনায় গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র পরিদর্শনে গিয়েছিলাম। নির্ধারিত সময়ে দ্রুতি পরিবহনের বাসে উঠতে গিয়ে দেখি সেখানে আমাদের শ্রদ্ধাভাজন শহীদ সাংবাদিক হুমায়ুন কবীর বালু ভাই (দৈনিক জন্মভূমি সম্পাদক, যার কাগজে কাজ করে এবং তাঁরই প্রশ্রয়ে {১৯৮৩-১৯৯১} আমি সাংবাদিকতায় নিজেকে প্রস্তুত করতে পেরেছিলাম), সিনিয়র সহকর্মী সানোয়ার পারভেজ, বন্ধু সাংবাদিক আশরাফ বাচ্চু (এখন পুরো দস্তুর আইনজীবী) আর বিভিন্ন এনজিও’র কয়েকজন নারী কর্মী। যশোর থেকে সঙ্গী হলেন ইত্তেফাকের যশোর প্রতিনিধি ফারাজী আজমল হোসেন। সব মিলিয়ে প্রায় ২০ জনের একটা কন্টিনজেন্ট।
যখন রওয়ানা হই তখন আকাশে ভারি মেঘ। থেমে থেমে টিপ টিপ ছিটেফোঁটা বৃষ্টি। কয়েকটা ফেরি পাড়ি দিয়ে পৌঁছালাম দৌলুদিয়া ঘাটে। তখন সকাল সাড়ে ১০টা বাজে। বাস থেকে নেমে লঞ্চে উঠতে হবে। সবাই লঞ্চে উঠলাম। লঞ্চ ছাড়লো সোয়া ১১টা দিকে। লঞ্চের গন্তব্য আরিচা ঘাট (তখন পাটুরিয়াতে ঘাট হয়নি)। সে সময় কমবেশী আড়াই ঘন্টার মত লাগতো দৌলতদিয়া থেকে লঞ্চে আরিচায় পৌঁছাতে।
লঞ্চ যাত্রার প্রথম ঘন্টাটি নির্বিঘ্নই ছিল। এরপর শুরু হলো তীব্র বৃষ্টি আর বিশাল বিশাল ঢেউ। যাত্রীদের একজন রেডিও’র খবরে জানতে পারলেন যে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে। ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেখানো হচ্ছে। সকাল আটটা থেকে সব ধরণের নৌযান চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে!! এ খবর ও বিশেষ আবহাওয়া বুলেটিন শুনে সবার আত্মারাম খাঁচাছাড়া। আমাদের লঞ্চটি প্রচণ্ড ঢেউয়ের মাথায় চড়ছে একবার, একটু বাদে পানির নীচে!!
এই অবস্থায় বালুভাই সবাইকে লঞ্চের নীচে নিয়ে এলেন। সুকানিকে বললেন লঞ্চ চালিয়ে রাখতে। হঠাৎ কড়্ড়াৎ করে একটা শব্দ হলো। সবাই ভাবলাম লঞ্চের তলা ফেটে গেছে। যাত্রীরা কান্নাকাটি করতে লাগলেন। জানা গেল তলা ফাটেনি। ঢেউয়ের ঝাপটায় ডেকের একটা জানালার ঝাপ উড়ে গেছে। বালুভাই সারেংকে বললেন, যে কোন জায়গায় পাড়ে লঞ্চ ঠেকিয়ে দিতে। কিন্তু কোন দিকে কূল দেখা যায় না। তীব্র বাতাসে লঞ্চ কোনদিকে চলছে তা’ স্বয়ং সারেংও বলতে পারলো না। দুর্যোগ এবং লঞ্চ দু’টোই চলছিল। বিকেল চারটে নাগাদ দেখা গেলো দূরে নদীর পাড়। পাড় লক্ষ্য করে লঞ্চ এগিয়ে চলছে। কাছাকাছি যেতেই দেখা গেল পাড় ভেঙে ভেঙে পড়ছে। ফলে পাড়ে লঞ্চ ভেড়ানো বিপজ্জনক। লঞ্চটি পাড় থেকে একশ’ গজের মত দূর দিয়ে সমান্তরাল চলতে থাকলো। সন্ধ্যা নাগাদ ঝড়ের বেগ কিছুটা কমলো। লঞ্চ চলার পথে অসংখ্য নৌযানকে নদীতে অর্ধডুবন্ত, কাঁত হয়ে থাকতে দেখলাম।
রাত আটটার দিকে আমরা আরিচা ঘাটে পৌঁছালাম। ভিজে ভিজে দ্রুতি পরিবহনের কাউন্টারে গিয়ে শুনি আমাদের কানেক্টিং বাস ফিরে ঢাকায় চলে গেছে। কোন পরিবহনের বাসই নেই। এই অবস্থার মধ্যে লঞ্চে করে আমরা আসতে পেরেছি জেনে অবাক সবাই। রাত ১২টার দিকে একটা লোকাল বাস নিয়ে আমরা নবীনগরের পথে যাত্রা শুরু করতে পারলাম আরিচা থেকে।
পথে ভেঙে পড়া গাছের ডাল, গাছ সরিয়ে রাত আড়াইটার দিকে আমরা গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের গেটে পৌঁছালাম। কিন্তু হা হতোষ্মি!! গার্ড আমাদের ঢুকতে দিচ্ছে না। এতগুলো ভেজা মানুষ ঠাণ্ডায় ঠকঠক করে কাঁপছি। এ সময় খেপে গেলেন ফারাজী আজমল ভাই। তিনি দায়িত্বশীল কাউকে এখুনি ডেকে আনার জন্যে গার্ডদের বললেন। একজন গার্ড হয়তো দয়াপরবশ হয়ে ঘুম থেকে জাগিয়ে ডেকে নিয়ে এলেন একজনকে। তিনি আমাদের আসার কথা শুনে অবাক হলেন। এ বিষয়ে তার কোন জানা নেই। পরে আশেক ভাই খোলাসা করলেন যে আমাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিল মূলত গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের সিস্টার অর্গানাইজেশন “সবার জন্য স্বাস্থ্য” কর্তৃপক্ষ।
গণস্বাস্থ্যের সেই কর্মকর্তার দয়া হলো। তিনি আমাদের থাকার জন্যে ডরমেটরি খুলে দিলেন, আমাদের জন্য খাবার রান্নার ব্যবস্থা করলেন। ভোর চারটার দিকে গরম ভাত, আলু ভর্তা, ডাল আর ডিম ভাজিকে অমৃত মনে হলো।
পরদিন সকালেই আমাদের সাথে সাক্ষাৎ হলো ডাঃ জাফরুল্লাহ’র। পরম মমতায় তিনি দুঃখ প্রকাশ করলেন আগের রাতে ঘটে যাওয়া অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্যে। তিনি নিজে আমাদের নিয়ে গেলেন তাঁর ল্যাবরেটরিতে। যে পাত্রটিতে আলকজান্ডার ফ্লেমিং পেনিসিলিন আবিষ্কার করেছিলেন সেই পাত্রটি দেখালেন। এটি পুরষ্কার হিসেবে তাঁকে দেয়া হয়েছিল। আরো যা’ যা’ দেখিয়েছিলেন তা’ এতদিন বাদে আর মনে করতে পারলাম না। এরপর তিনি প্রতিষ্ঠানের গণসংযোগ কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দিলেন গণস্বাস্থ্যের সব কিছু আমাদের দেখানোর জন্য।
আমরা দু’-তিনদিন ধরে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র্’র আতিথ্যে প্রতিষ্ঠানের সব কিছু দেখলাম। এটিকে তখন আমার কাছে নারীস্থান মনে হয়েছিল। অধিকাংশ কর্মী ছিলেন নারী। ওখুধ কোম্পানীতে মেশিন চালানো থেকে শুরু করে ওখুধের বিভিন্ন উপকরণ মিশ্রণের কাজ নারীরা করছেন, গ্লাস ফাইবার কারখানায় উৎপাদন করছেন নারী, ট্রাক, ট্রাক্টর চালাচ্ছেন নারীরা, নাইট গার্ড হিসেবে টহল দিচ্ছেন নারী। ভোরবেলা শত শত সাইকেলে করে গ্রামে গ্রামে ছুটে যাচ্ছেন যে সব স্বাস্থ্যকর্মী তারাও নারী।
আমাদের জানানো হয়েছিল, তখন ওখানে প্রায় ১২ হাজার মানুষ কাজ করতেন তার মধ্যে ১০ হাজারের বেশী-ই নারী। সবাই এখানে থাকেন আর একই খাবার খান ক্যান্টিনে। সবাইকে সকাল সাতটা থেকে আটটা পর্যন্ত ক্ষেতে কাজ করতে হয় তা’ তিনি যে স্তরের কর্মকর্তাই হোন না কেন। জ্বালানী তেল আর লবণ ছাড়া বাকি সব কিছু নিজেরা উৎপাদন করেন।
ফেরার দিন ডাঃ জাফরুল্লাহ আমাদের বিদায় জানিয়েছিলেন। মাত্র দু’-তিনদিনের সেই স্মৃতি আজও অম্লান। তিনি আমাদের সাথে যতটুকু কথা বলেছিলেন তার বেশীরভাগই ছিল সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যসেবা আরও সহজতর কিভাবে করা যায়, ওখুধের দাম কিভাবে আরও কমানো যায় তা’ নিয়ে। তিনি অনেক বড় স্বপ্ন দেখতেন। এই স্বপ্ন দেখা মানুষদের মাধ্যমেই সমাজ বদলায়। তিনিও অনেক ইতিবাচক পরিবর্তনের সম্মুখ সারির যোদ্ধা। অন্তরের গভীর থেকে শ্রদ্ধা জানাই তাঁকে।