জীবনের শুরুর গল্পটা মোটেই সুখকর ছিল না মিনহাজের। জন্মের আগে পরিবারের সবার মধ্যে যে সীমাহীন আনন্দ আর আকাক্সক্ষা জাগিয়েছিল, জন্মের পরপরই যেন তা তারচেয়ে দ্রæতবেগে বিলীন হয়ে যায়। কারণ তার জন্মটা স্বাভাবিক ছিল না। জন্মের পর দেখা গেল তার ডান পায়ের হাঁটুর নিচের অংশটি নেই। এই অস্বাভাবিকতাকে মেনে নিতে পারল না মিনহাজের যৌথ পরিবার। অনেকেই ভ্রæকুচকে তাকাল মিনহাজ এর মায়ের দিকে।পাড়া-প্রতিবেশীরা বলাবলি করতে লাগল বাবা মায়ের কোন পাপের ফল এটি।
যশোরের শার্শা উপজেলার খামারপাড়া নামে এক প্রত্যন্ত গ্রামে জন্ম হয়েছিল মিনহাজের। কিন্তু পরিবার আর প্রতিবেশীদের সামাজিক ও মানসিক নিপীড়ন সহ্য করতে না পেরে একসময় তার বাবা-মা খুলনাতে এসে বসবাস শুরু করেন। এই সমাজ আর এই সমাজের অধিবাসীরা আড়চোখে তাকালেও বাবা-মা তো আর ফেলে দিতে পারেন না নিজেদের জন্ম দেওয়া সন্তানকে। তারা মিনহাজকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার প্রত্যয় গ্রহণ করলেন।
আশপাশের সমস্ত প্রতিক‚লতাকে মোকাবিলা করে মিনহাজ উচ্চশিক্ষায় নিজের জায়গা করে নিলেন। ভর্তি হলেন খুলনার সরকারি আযম খান কমার্স কলেজে। কিন্তু আশংকা যেন তার পিছু ছাড়েনা। সারাক্ষণ ভাবেন লেখাপড়া শেষ করে কোন চাকরির ব্যবস্থা কি হবে! প্রতিবন্ধীদের প্রতি সমাজের যে দৃষ্টিভঙ্গি তাতে তার কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা কী? মিনহাজ তখন অনার্স চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। একদিন লাঠিতে ভর করে কলেজ গেট দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে মিনহাজ দেখলেন কলেজের মাঠের এক কোনায় অনেক ছেলে-মেয়ের জটলা। পেছনে একটি ব্যানার টানানো। একজন পুরুষ আর এক মহিলা ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশ্যে কি যেন বলছেন। কৌতুহলবশত মিনহাজ এগিয়ে গেলেন। দেখলেন ব্যানারে লেখা ‘তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে এনডিডিসহ সব ধরনের প্রতিবন্ধী ব্যক্তির ক্ষমতায়ন’। প্রতিবন্ধীদের ক্ষমতায়ন বিষয়টা দেখে তার আগ্রহ বেড়ে গেল। ভিড় ঠেলে সামনে এগোতে এগোতে জানতে পারলেন যিনি কথা বলছেন তার নাম সোহেল রানা। তিনিও একজন প্রতিবন্ধী। মিনহাজের কানে ভেসে আসলো সোহেল রানা বলছেন, ২০৩০ সালের মধ্যে জাতিসংঘ ঘোষিত ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা’ (এসডিজি) বাস্তবায়ন করতে চায় বাংলাদেশ সরকার। এই এসডিজির ম‚ল প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘কাউকে পেছনে ফেলে নয়’। এজন্য সরকার তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীকে দক্ষ জনশক্তি হিসেবে তৈরি করা ও কর্মসংস্থানে সহায়তার মাধ্যমে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ক্ষমতায়ন করতে চায়। সে লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের আওতাধীন বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল (বিসিসি) এর মাধ্যমে ‘তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে এনডিডিসহ সব ধরনের প্রতিবন্ধী ব্যক্তির ক্ষমতায়ন’ শীর্ষক প্রকল্প গ্রহণ করেছে। প্রাথমিক পর্যায়ে এই প্রকল্পের আওতায় ২৮০ জন এনডিডিসহ মোট ২৮০০ জন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। এনডিডি কী সেটা বুঝতে পারছিলেন না মিনহাজ। জিজ্ঞেস করবেন কিনা ভাবতে ভাবতেই দেখলেন একজন ছাত্রী সোহেল রানার কাছে এনডিডি বিষয়ে জানতে চাইলেন। সহজ ভাষায় সংক্ষেপে বিষয়টা বুঝিয়ে বললেন সোহেল। এনডিডি হচ্ছে নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ডিজঅর্ডার। সাধারণভাবে যাকে আমরা অটিজম বলে জানি। তবে এই এনডিডি আরো কয়েক প্রকার হতে পারে, যেমন সেরিব্রাল পালসি, ইন্টেলেকচুয়াল ডিজএবিলিটি, ডাউন সিনড্রোম ইত্যাদি।
অতঃপর সোহেল রানা প্রকল্পের নানাদিক বিস্তারিত তুলে ধরলেন। তার আলোচনা থেকে মিনহাজ ও অন্যান্য ছাত্র-ছাত্রীরা জানতে পারলেন, এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে ভিশন ২০২১ ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অংশগ্রহণকারী নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা এবং দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে উন্নয়নের মূলধারায় সম্পৃক্ত করা। সে লক্ষ্যে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থানে সহায়তা করার জন্য বিসিসির সাতটি আঞ্চলিক কার্যালয়ে সাতটি রিসোর্স সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এই রিসোর্ট সেন্টারগুলোতে ২০ দিন মেয়াদে ৩ ধরনের কোর্স পরিচালিত হচ্ছে। ইন্ট্রোডাকশন টু কম্পিউটার অ্যান্ড অ্যাপ্লিকেশন প্যাকেজেস, গ্রাফিক্স ডিজাইন এন্ড মাল্টিমিডিয়া এবং ওয়েব এন্ড মোবাইল অ্যাপ্লিকেশননামক প্রতিটি কোর্সে ২০ জন প্রশিক্ষণার্থীর অংশ নেয়ার সুযোগ রয়েছে। এসএসসি পাস যে কোন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি িি.িবঢ়ফরপঃ.পড়স ওয়েবসাইটের মাধ্যমে অনলাইনে আবেদন করতে পারেন। আগে আসলে আগে পাবেন ভিত্তিতে এই কোর্সগুলোতে আসন পূরণ করা হয় এই প্রশিক্ষণ কোর্সের বিশেষ সুবিধা হচ্ছে কোন কোর্স ফি নাই। বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ উপকরণসহ দুপুরে খাবারের ব্যবস্থা আছে। এছাড়া যাতায়াত এবং আবাসনভাতা বাবদ প্রত্যেক প্রশিক্ষণার্থীকে বারো হাজার টাকা প্রদান করা হয়। এই প্রকল্পের মাধ্যমে ইতোমধ্যে ১৫৬০ জনের ইন্ট্রোডাকশন টু কম্পিউটার অ্যান্ড অ্যাপ্লিকেশন প্যাকেজেস কোর্সে এবং ১০০ জনের গ্রাফিক্স ডিজাইন এন্ড মাল্টিমিডিয়া কোর্সে প্রশিক্ষণ সম্পন্ন হয়েছে।
রিসোর্স সেন্টার স্থাপনের পাশাপাশি এই প্রকল্পের আওতায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য বিশেষায়িত ও অভিগম্য একটি জাতীয় ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্ম তৈরির কাজ চলমান রয়েছে যেখানে আইসিটি প্রশিক্ষণের জন্য কণ্ঠ ও ইশারা ভাষার নির্দেশনাসহ অডিও ভিডিও টিউটোরিয়াল থাকছে। ইতোমধ্যে ইন্ট্রোডাকশন টু কম্পিউটার অ্যাপ্লিকেশন প্যাকেজেস কোর্সের ৩৯টি এবং গ্রাফিক্স ডিজাইন এন্ড মাল্টিমিডিয়া কোর্সের ৮৯ টি এ ধরনের টিউটোরিয়াল উন্নয়ন করা হয়েছে।
কেবল প্রশিক্ষণ প্রদান নয়, প্রকল্পের মাধ্যমে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা যেন আইটি এবং অন্যান্য সেক্টরে চাকরি পায় সেজন্য এই প্লাটফর্মে চাকরিদাতা ও গ্রহীতাদের জন্য একটি জব পোর্টাল অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। চাকরির বাইরে ফ্রিল্যান্সার হিসেবে আউটসোর্সিংয়ের কাজও করছেন প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের অনেকেই। সোহেল রানা আরও জানালেন, বিভিন্ন চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ, সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর এবং চাকরি মেলা আয়োজনের মাধ্যমে ২০১৮ থেকে ২০২০ সালে মোট ২৭১ জন প্রতিবন্ধী ব্যক্তির চাকরি নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে।
সব শুনে মিনহাজ যেন এক নতুন আশার আলো দেখতে পেলেন। পরদিনই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে অনলাইনে আবেদন করলেন ইন্ট্রোডাকশন টু কম্পিউটার অ্যাপ্লিকেশন প্যাকেজেস কোর্সে। সেই কোর্স সফলতার সাথে শেষ করে ভর্তি হলেন গ্রাফিক্স ডিজাইন এন্ড মাল্টিমিডিয়া কোর্সে। এই কোর্স চলমান থাকা অবস্থাতেই চাকরি মেলার মাধ্যমে বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের আইটি সেক্টরে তার চাকরি হল।
একদিন যে সমাজ তার দিকে ভ্রæ কুঁচকে তাকাত, এখন সেই সমাজে তার একটা সম্মানজনক অবস্থান তৈরি হয়েছে। তার অনিশ্চিত জীবনটা যে তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে এমনভাবে বদলে যাবে তা সে ভাবতেও পারেনি। সুযোগ পেলে তারাও যে সমাজে অবদান রাখতে পারেন এটা ভেবে গর্বে তার বুকটা ভরে যায় । একই সাথে বাংলাদেশ সরকারের এমন উদ্যোগের প্রতি কীভাবে তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবেন তা ভেবে পাননা। তার স্বপ্ন তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে একদিন এদেশের সব প্রতিবন্ধী মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে।
(পিআইডি ফিচার)
লেখকঃ তথ্য অফিসার, আঞ্চলিক তথ্য অফিস, খুলনা।