তালা প্রতিনিধি
সাতক্ষীরার তালা উপজেলার পাটকেলঘাটায় নৌকা তৈরীতে ব্যস্ত সময় পার করছে কারিগররা। সারাদিন খটখট শব্দ, হাতুড়ি দিয়ে পেরেক ঠোকানো, দড়ি দিয়ে বেঁধে গোন টানা, আলকাদরা টানা, করাত দিয়ে কাঠ কাটা, বিক্রির জন্য নছিমন-করিমনে নৌকা টেনে তুলতে ব্যস্ত এমনই চিত্র দেখা গেছে খুলনা-সাতক্ষীরা মহাসড়কের কোলঘেঁষে পাটকেলঘাটা বলফিল্ড মোড় হতে পেট্রোলপাম্প পর্যন্ত নৌকা পল্লীতে।
পাটকেলঘাটা সুমি ফার্নিচারের মালিক মোঃ নূর ইসলাম বলেন, ‘আমার কারখানায় ৪-৫ জন শ্রমিক রাতদিন পরিশ্রম করে দিনে ১ টি করে নৌকা তৈরী করে। একটি নৌকা বিক্রি করলে সকল খরচা বাদে তার ৫ থেকে ৬ শত টাকা আয় হয়। কর্মচারীদের মুজুরি, তিন বেলা খাওয়া ও থাকা আমাকে ম্যানেজ করতে হয়।’ কর্মচারীদের অধিকাংশের বাড়ি খুলনার কয়রা উপজেলার মহারাজপুর এলাকায় বলে জানান তিনি।
করাখানার প্রধান কারিগর হাফিজুর রহমান জানান, তিনি কয়রা থেকে প্রায় ১১ বছর আগে অত্র এলাকায় এসে নৌকা তৈরী কাজ শুরু করে। খৈ কাঠ, চাম্বুল কাঠ, লম্বু কাঠ, পুঁই কাঠ, মেহগনী কাঠ নৌকা তৈরী কাজে ব্যবহার করা হয়। ১২ হাতের একটি নৌকা তেরী করতে ২ হাজার টাকা, ১৪ হাতের একটি নৌকা তৈরী করতে ৩ হাজার টাকা, ১৬ হাতের একটি নৌকা তৈরী করতে ৬ হাজার টাকা পর্যন্ত তারা মুজুরী পান বলে জানান।
তিনি আরও বলেন, কারখানার মালিক ১২ হাতের নৌকা ৭ হাজার টাকা বিক্রি করলে ৫০০ টাকা লাভ পায়। ১৪ হাতের নৌকা ১১ হাজার টাকা বিক্রি করলে ১ হাজার টাকা মত, ১৮ হাতের নৌকা ২০ হাজার বিক্রি করলে ২ হাজার ৫ শত টাকা লাভ পায়। বৈশাখ মাস থেকে শুরু করে শ্রাবণ মাস পর্যন্ত এ ব্যবসা জমজমাট চলে।
নৌকা ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম জানান, এ বছর বর্ষা কম হওয়ায় নৌকা ব্যবসায় কিছুটা বিপাকে পড়েছি। বেচাকেনা কম হওয়ায় কর্মচারীদের বেতন দিতে আমরা হিমশিম পোহাতে হচ্ছে।’
কারখানার মালিক নূর ইসলাম আরো জানান, কিছুদিন তেমন বেচাকেনা না হলেও বর্তমান নৌকার চাহিদা হঠাৎ বেড়ে গেছে। নৌকা তৈরী করে ডেলিভারী দিতে হিমশিম পোহাতে হচ্ছে। চারিদিকে ঘেরভেড়ির সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং হঠাৎ বৃষ্টিসহ জলাবদ্ধতার কারণে এ চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে।
তিনি বলেন, এ নৌকাগুলো তালার পাটকেলঘাটা থেকে শুরু করে খুলনা, বাগেরহাট, রুপসা, পাইকগাছা, কয়রা, আমাদী, শ্যামনগর, মুন্সিগঞ্জ, ঝিনাইদহ, মাদারীপুর, শরিয়তপুরসহ সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে এ নৌকা চলে যায়।
পেট্রলপাম্পের পাশে তৈয়াবা ফার্ণিচার এন্ড নৌকা কারখানার আরাকা মালিক আক্তারুজ্জামান বিশ্বাস বলেন, এ কারখানায় ৯ জন কর্মচারী চুক্তিভিত্তক কাজ করেন। প্রত্যেক কর্মচারী প্রতিদিন ৭-৮ শত টাকা আয় করেন। প্রতি মাসে প্রায় ৩৫-৪০ টি নৌকা বিক্রি করেন তিনি। এতে তার মাসিক ২৫-৩০ হাজার টাকা আয় হয়।
এদিকে নৌকা কিনতে আসা বিশ^জিৎ, রফিকুল, আরমানসহ কয়েকজন জানান, তালা উপজেলার পাটকেলঘাটা বাজারে তারা নৌকা কিনতে এসেছেন। এখানকার নৌকা বেশ মজবুত এবং দামও অন্য বাজারের তুলনায় কিছুটা কম। এজন্য তারা বিভিন্ন এলঅকা থেকে নৌকা কিনতে এসেছেন।
তালা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের প্রাক্তন কমান্ডার ও সাবেক নৌ কমান্ডো মোঃ মফিজ উদ্দীন বলেন, নদী মাতৃক বাংলাদেশে আবহমান কাল থেকে নৌকা শিল্প আমাদের লোক শিল্পের সাথে মিশে আছে। এটির মাধ্যমে ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, জারি-সারি, মাঝি মাল্লার গানগুলো এখনো আমাদের শিকড়ের সন্ধান এনে দেয়। কিন্তু নব্বই এর দশকের পর যান্ত্রিক সুবিধা বেড়ে যাওয়া ও অধিকাংশ নদীগুলো মৃতপ্রায় হওয়ায় নৌকার কদর অনেকটা কমে যায়। কিন্তু বর্তমানে বৈশ্বিক জলবায়ু চ্যালেঞ্জের মোকাবেলাই আবারো যেন নৌকা শিল্পের কদর পেতে শুরু করেছে।
তালা সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা স্নিগ্ধা খাঁ বাবলী বলেন, অত্র উপজেলা হতে জেলেরা অনেক ইঞ্জিনচালিত নৌকা নিয়ে সুন্দরবনের দুবলারচরসহ বিভিন্ন স্থানে মাছ ধরতে যায়। এরমধ্যে ৬৮টি ইঞ্জিনচালিত নৌকার তথ্য তাদের দপ্তরে রয়েছে।