জন্মভূমি ডেস্ক : রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুর চাপ রয়েছে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুর। এর মধ্যেই আরাকান আর্মির সঙ্গে বর্মি সামরিক বাহিনীর সংঘাতের তীব্রতা বাড়ছে মিয়ানমারের রাখাইনে। এতে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন নিয়ে তৈরি হয়েছে নতুন উদ্বেগ। চলমান সংঘাতে রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি অন্যান্য জনগোষ্ঠী, এমনকি মিয়ানমার সরকারের সামরিক-আধাসামরিক বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে বাংলাদেশে পালিয়ে আসার প্রয়াস নেয়ার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) শতাধিক সদস্য। এ চাপ আরো বাড়বে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
তাদের ভাষ্যমতে, প্রতিবেশী মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের বর্তমান পরিস্থিতি বাংলাদেশের জন্য বড় ধরনের নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করছে। সীমান্তের ওপারের সংঘাতে মর্টারের শেল-হেলিকপ্টার গানশিপের গুলিতে হতাহতের ঘটনা ঘটছে বাংলাদেশেও। সব মিলিয়ে পরিস্থিতিই এখন রাখাইনকে বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক কৌশলের অগ্রাধিকারের জায়গায় তুলে এনেছে।
রাখাইনে সংঘাত উদ্বিগ্ন করে তুলেছে দুই আঞ্চলিক প্রতিবেশী ভারত ও চীনকেও। মিয়ানমারের বঙ্গোপসাগর-তীরবর্তী প্রদেশটিতে কানেক্টিভিটি ও জ্বালানি খাতে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ রয়েছে চীনের। সংঘাতে এ বিনিয়োগ নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে বেইজিংয়ের। যদিও কারো কারো দাবি, আরাকান আর্মির সাম্প্রতিক বিজয় অভিযান বেইজিংয়ের জন্য আঞ্চলিক ভূরাজনীতিতে নতুন সম্ভাবনা তৈরি করেছে।
এ সংঘাতকে বড় নিরাপত্তা ঝুঁকি হিসেবে দেখছে ভারতও। এরই মধ্যে দেশটির কেন্দ্রীয় সরকারের নীতিনির্ধারকরা জানিয়েছেন, মিয়ানমারের সঙ্গে সীমান্ত বেড়া নির্মাণের কথা ভাবছেন তারা। একই সঙ্গে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে সীমান্ত এলাকায় মিয়ানমারের নাগরিকদের অবাধ চলাচলের সুবিধা প্রত্যাহারেরও। রাখাইনে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগের মাধ্যমে উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলোকে বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে যুক্ত করতে এরই মধ্যে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করেছে ভারত। আরাকান আর্মির সাম্প্রতিক বিজয় এরই মধ্যে ভারতীয় বিনিয়োগের ভবিষ্যৎকেও ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছে।
বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও অর্থনীতিতে বড় সংকটগুলোর অন্যতম হিসেবে দেখা হয় রোহিঙ্গা সমস্যাকে। দেশে উদ্বাস্তু হয়ে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সদস্য সংখ্যা অনেক আগেই ১১ লাখ ছাড়িয়েছে। বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশে আশ্রয়দানের বিষয়টি আন্তর্জাতিক মহল শুরুতে ব্যাপক মাত্রায় সাধুবাদ জানিয়েছিল। যদিও তাদের ভরণপোষণের জন্য প্রয়োজনীয় ও দাতা দেশগুলোর প্রতিশ্রুতির বিপরীতে অর্থ এসেছে সামান্যই। জাতিসংঘের সহযোগী সংস্থাগুলোও এক্ষেত্রে খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি। শুরুতে উদ্বাস্তুদের আগমনকে আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীগুলো যে গুরুত্ব দিয়ে দেখেছিল এখন আর তা দেখা হচ্ছে না। বরং রোহিঙ্গাদের জন্য দেয়া অনুদানের পরিমাণ কমেছে। চাপে পড়েছে কক্সবাজারের স্থানীয় পর্যায়ে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও আর্থসামাজিক অবস্থাও।
তাতমাদো রাখাইনের নিয়ন্ত্রণ হারালে নেপিদোর পক্ষে বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিশ্রুত ও নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সম্পন্ন করা কঠিন হয়ে পড়বে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এছাড়া গৃহযুদ্ধ উপদ্রুত এলাকায় জনগোষ্ঠীটির উদ্বাস্তুদের ফিরিয়ে নেয়ার পথেও আন্তর্জাতিক মহল বাধা তৈরি করার বড় আশঙ্কা রয়েছে বলে অভিমত তাদের।
যদিও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত কোনো কোনো পর্যবেক্ষণে আবার দাবি করা হয়েছে, আরাকান আর্মি রাখাইনে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়টি হয়তো সহজ হয়ে আসবে। সংগঠনটি এরই মধ্যে মিয়ানমারের মুসলিম বাসিন্দাদের (রোহিঙ্গা) নাগরিকত্বের স্বীকৃতি দেয়ার পাশাপাশি তাদের যেসব সদস্য রাখাইনে থেকে গেছে, তাদের ভবিষ্যৎ প্রশাসনের অংশ করার ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের অনেকেই এ ঘোষণায় ভরসা করতে পারছেন না। তাদের ভাষ্যমতে, রোহিঙ্গাদের প্রতি রাখাইনের আরাকানি জাতিগোষ্ঠীর দৃষ্টিভঙ্গি খুব একটা ভালো নয়।
অস্ট্রেলিয়ার সিডনিভিত্তিক লোয়ি ইনস্টিটিউটের এক সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণপত্রে বলা হয়, রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ায় তাতমাদোর অনীহা এবং সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় ঢাকায় কারো কারো মনে হতে পারে, আরাকান আর্মি রাখাইনের নিয়ন্ত্রণ নিলে তা কিছু মাত্রায় হলেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সহায়ক হবে। যদিও সংগঠনটির হাতে রাখাইনের নিয়ন্ত্রণ চলে যাওয়ার অনেক ঝুঁকিও রয়েছে। বিশেষ করে এর ধারাবাহিকতায় এ অঞ্চলে স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা কতটা টেকসই হবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির বলেন, ‘চলমান সংঘাত আমাদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি। চলমান অস্থিরতায় সীমান্ত বাণিজ্য বন্ধ থাকায় সেখানকার স্থানীয় অর্থনীতিতে নেতিবাচক চাপ আসছে। গত ডিসেম্বরে রোহিঙ্গাদের একটি পাইলট গ্রুপের প্রত্যাবাসন নিয়ে বাংলাদেশ কাজ করেছিল। সে সময় পশ্চিমারা যারা রোহিঙ্গাদের আর্থিক সহায়তা দেয়, তারা মনঃক্ষুণ্ন হয়েছিল। বর্তমান পরিস্থিতিতে এটি আরো অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে গেল। এ পরিস্থিতি যতদিন পর্যন্ত ঠিক না হয়, ততদিন আমরা যে ধরনের পরিকল্পনা নিয়ে এগোই না কেন, সেটি পালন করা বেশ চ্যালেঞ্জিং একটি বিষয় হবে বলে আমি মনে করি।’
রাখাইনে চীন ও ভারতের স্বার্থ নিয়ে তিনি বলেন, ‘চীনের গ্যাস ও জ্বালানি তেলের দুটি পাইপলাইন গেছে এ অঞ্চল দিয়ে। এছাড়া চীনের লাগোয়া শান ও কাচিন প্রদেশে এরই মধ্যে গোলমাল শুরু হয়েছে। এ প্রদেশগুলোয় চীনা ব্যবসায়ীদের যাতায়াত আছে। ফলে এরই মধ্যে চীনও একধরনের ভূকৌশলগত ও অর্থনৈতিকভাবে অসুবিধায় পড়েছে। আবার ভারত পালেতওয়া শহর থেকে মিজোরামের রাস্তায় পণ্য পরিবহনের জন্য বিনিয়োগ করেছিল। কিন্তু পালেতওয়া এরই মধ্যে বিদ্রোহীদের দখলে চলে গেছে। ফলে জায়গাটি এখন ভারতেরও নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তার কারণ হয়েছে।’
এলাকাটি নিয়ে তুলনামূলক কম উদ্বেগে ভুগছে চীন। রাখাইনের কানেক্টিভিটি ও জ্বালানি খাতে বিপুল বিনিয়োগ রয়েছে চীনেরও। চীনের দক্ষিণাঞ্চল ও বঙ্গোপসাগরের মধ্যে কানেক্টিভিটি তৈরিতে নির্মাণ হচ্ছে রেল ও সড়কপথ এবং বন্দর। উচ্চাভিলাষী বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগের অংশ হিসেবে নেয়া এ প্রকল্পের আওতায় রাখাইনে বঙ্গোপসাগরের তীরে নির্মাণ করা হচ্ছে কিয়াকফিউ বন্দর। বন্দরটিকে চীনের দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে যুক্ত করা হচ্ছে রেল ও সড়কপথে। বন্দরটি নির্মাণের মধ্য দিয়ে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো প্রবেশাধিকার পেতে যাচ্ছে চীন। একই সঙ্গে আঞ্চলিক শক্তির ভারসাম্যেও প্রকল্পটি বড় ভূমিকা রাখবে বলে প্রত্যাশা চীনা বিশেষজ্ঞদের।
পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, রাখাইনে সংঘাতের তীব্রতা বাড়ায় এখন করিডোরটির নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে চীন। এরই অংশ হিসেবে রাখাইনে আরাকান আর্মিকে ব্যাপক মাত্রায় অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে সহায়তা করা হচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে দরকষাকষিতে এগিয়ে থাকার সুযোগ বাড়ছে চীনের।
এতদিন পর্যন্ত মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোর বাসিন্দারা ভারতের অভ্যন্তরে ১৬ কিলোমিটার পর্যন্ত ভিসামুক্ত চলাচলের সুবিধা পেয়েছে। বর্তমান সংঘাতের কারণে এ সুবিধা বাতিলের পাশাপাশি মিয়ানমারের সঙ্গে ১ হাজার ৬৪৩ কিলোমিটার সীমান্তকে কাঁটাতার দিয়ে সুরক্ষিত করার কথা ভাবছে নরেন্দ্র মোদি সরকার।
মিয়ানমারের রাখাইন ও চিন প্রদেশে আরাকান আর্মি ও এর মিত্রদের সাম্প্রতিক সামরিক সাফল্য ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের নতুন করে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। সংগঠনটির সাম্প্রতিক সাফল্যকে ভারতের জন্য বড় ধরনের নিরাপত্তা হুমকি হিসেবে দেখছেন তারা। তাদের ভাষ্যমতে, আরাকান আর্মি গড়ে তোলার সময় একে প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করেছে কাচিন ইনডিপেনডেন্স আর্মি। এ কাচিন ইনডিপেনডেন্স আর্মি গত শতকের আশি ও নব্বইয়ের দশকে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সশস্ত্র সংগঠনগুলোর বড় একটি অংশকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে আরাকান আর্মি নিয়ে ভারতের উদ্বেগকে আরো বাড়িয়ে তুলেছে সংগঠনটির পালেতওয়া ও বন্দরনগরী সিত্তের নিকটবর্তী পাউকতাও দখলের খবর। গত মাসে বাংলাদেশ সীমান্তের ২০ কিলোমিটার দূরে চিন প্রদেশের পালেতওয়া পূর্ণরূপে দখল করে নেয়ার কথা জানায় আরাকান আর্মি। কিছুদিন আগে রাখাইনের রাজধানী সিত্তের নিকটবর্তী পাউকতাওয়ে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার খবর প্রকাশ হয়। পর্যবেক্ষকদের ভাষ্যমতে, ভারতের অ্যাক্ট ইস্ট (পুবে চলো) নীতিমালায় পালেতওয়া ও সিত্তের অবস্থান কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মূলত এ দুই শহরকে কেন্দ্র করে ভারতের অর্থায়নে বাস্তবায়ন হচ্ছে উচ্চাভিলাষী কালাদান মাল্টি-মোডাল ট্রানজিট ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্ট। প্রায় ৩ হাজার ২০০ কোটি রুপিতে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পটির লক্ষ্য হলো মিয়ানমারের সিত্তে বন্দরকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হুগলি বন্দরের সঙ্গে সংযুক্ত করা। একই সঙ্গে কলকাতার সঙ্গে ভারতের মিজোরামের দূরত্বও অনেক কমিয়ে আনবে প্রকল্পটি। ব্লুপ্রিন্ট অনুযায়ী, এটি বাস্তবায়ন হলে কলকাতা থেকে রাখাইনের সিত্তে বন্দরে পাঠানো পণ্য কালাদান নদী হয়ে খালাস হবে চিনের পালেতওয়া বন্দরে। এরপর সেখান থেকে তা সড়কপথে পরিবাহিত হবে মিজোরামে। সেক্ষেত্রে শিলিগুড়ি করিডোর বা চিকেনস নেকের ওপর ভারতের নির্ভরতাও অনেকখানি কমে আসবে।