১৫ বছরে ১৪১, ৯ মাসে ১০০ ও দুই মাসে ৩৪টি ভূমিকম্প
জন্মভূমি ডেস্ক : ক্রমশ ভূমিকম্পপ্রবণ হয়ে উঠছে বাংলাদেশ। মাঝে মধ্যেই ছোট ও মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পে গোটা দেশ কেঁপে উঠছে। গত দুই মাসে বাংলাদেশ ও এর আশেপাশে মৃদু মাত্রার প্রায় ৩৪টি ভূমিকম্প হয়েছে। গত ১৫ বছরে ছোট-বড় ভূমিকম্প হয়েছে ১৪১টি, যা আশঙ্কাজনক।
বিশেষজ্ঞদের মতে, মৃদু মাত্রার এসব ভূমিকম্প ইঙ্গিত দেয়, সামনে বড় মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানতে পারে। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে যার ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ।
॥ দফায় দফায় ভূমিকম্পে তীব্র ঝুঁকিতে বাংলাদেশ ॥
২০১৬ সালের ৪ জানুয়ারি ৬ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে কেঁপে উঠেছিল বাংলাদেশ। সেবার আতঙ্কেই মারা যান ছয়জন। বিশেষজ্ঞদের দাবি, বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে যাওয়া ভারত ও মিয়ানমার টেকটোনিক প্লেটে গত শত বছরেও বড় কোনো ভূমিকম্প হয়নি। তাই এই প্লেটে সঞ্চিত হয়েছে দীর্ঘদিনের শক্তি। এটি যে কোনো মুহূর্তে ৮ থেকে ৯ মাত্রার ভূমিকম্পের মধ্য দিয়ে হাজির হওয়ার আশঙ্কা আছে। এমন মাত্রার ভূমিকম্প হলে সেই ধাক্কা সামলাতে পারবে না ঢাকা। মৃত্যু হবে কমপক্ষে দুই থেকে তিন লাখ মানুষের।
গত সেপ্টেম্বরে দেশে তিনবার ভূমিকম্প হয়। এর মধ্যে ১৭ সেপ্টেম্বর ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ভূমিকম্প অনুভূত হয়। এর উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকা থেকে ৫৯ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে টাঙ্গাইলে। এর আগে ৯ ও ১১ সেপ্টেম্বর ভূমিকম্প অনুভূত হয়। আগস্ট মাসে ১৪ ও ২৯ আগস্ট দুই দফায় বাংলাদেশে ভূমিকম্প অনুভূত হয়। এর উৎপত্তিস্থল ছিল সিলেট। গত ৫ জুন ৩ দশমিক ৯ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানে বঙ্গোপসাগরে। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারে মাঝারি মাত্রার জোড়া ভূমিকম্প আঘাত হানে।
॥ হতে পারে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প ॥
বিশেষজ্ঞদের দাবি, বাংলাদেশে সিলেট থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত পার্বত্য এলাকায় শক্তিশালী ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের মণিপুর, মিজোরাম, মিয়ানমারের পার্বত্য এলাকাও ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এছাড়া কিশোরগঞ্জের হাওর দিয়ে মেঘনা নদী হয়ে বঙ্গোপসাগর ও আন্দামানের পাশ দিয়ে দক্ষিণে যদি একটি রেখা কল্পনা করা যায়, এলাকাটি হচ্ছে দুটি টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থল।
এ দুটি প্লেটের মধ্যে পূর্বে অবস্থিত মিয়ানমার প্লেট, পশ্চিমে অবস্থিত ইন্ডিয়ান প্লেট। এর সংযোগস্থলের ওপরের ভাগটি অর্থাৎ সুনামগঞ্জ থেকে শুরু হয়ে পূর্বে মণিপুর, মিজোরাম পর্যন্ত অঞ্চলটি লকড হয়ে আছে। বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে যাওয়া ভারত ও মিয়ানমার টেকটোনিক প্লেটে গত শত বছরেও বড় কোনো ভূমিকম্প হয়নি। তাই এই প্লেটে জমেছে দীর্ঘদিনের সঞ্চিত শক্তি। এটি যে কোনো মুহূর্তে আট থেকে ৯ মাত্রার ভূমিকম্পের মধ্য দিয়ে হাজির হওয়ার আশঙ্কা আছে।
ভারত ও মিয়ানমারের প্লেট এবং বাংলাদেশের ভূ-তাত্ত্বিক অবস্থান বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা বলছেন, যে কোনো সময় বড় ধরনের ভূমিকম্প আঘাত হানবে। রিখটার স্কেলে ৭ মাত্রার বেশি ভূমিকম্প হলে আর তার কেন্দ্র ঢাকার চারপাশের এলাকা হলে রাজধানীর প্রায় দুই লাখ ভবন পুরোপুরি ধসে পড়বে। উচ্চমাত্রার ভূমিকম্প হলে মৃত্যুকূপে পরিণত হতে পারে পুরো ঢাকা শহর।
॥ সক্রিয় তিনটি টেকটোনিক প্লেট ॥
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেন, ‘বাংলাদেশের আশপাশ দিয়ে তিনটি টেকটোনিক প্লেট গেছে। এর সংযোগস্থল সীমান্তের আশপাশে। যেমন আমাদের উত্তরে হিমালয় পড়েছে ইউরেশিয়ান প্লেটে। আমাদের অবস্থান ইন্দো-অস্ট্রেলিয়ান প্লেটে। আর আমাদের পূর্বে হচ্ছে মিয়ানমার মাইক্রো প্লেট। এ তিনটি প্লেটই আমাদের কানেক্টেড এবং সক্রিয়। প্লেটগুলোর মুভমেন্ট আছে। এগুলো প্রতি বছর পাঁচ সেন্টিমিটার বা ৫০ মিলিমিটার মুভমেন্ট করে। তার মানে, প্রতি বছর আমরা পাঁচ সেন্টিমিটার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে মুভমেন্ট করছি। একইভাবে পুরো পৃথিবীও মুভ করছে।’
॥ যা বলছে জরিপ ॥
বুয়েটের বিভিন্ন সময়ে করা জরিপে দেখা যায়, গত ১৫ বছরে বাংলাদেশে ছোট-বড় ১৪১টি ভূমিকম্প হয়েছে। এছাড়া গত দুই মাসে ৩৪টি ও ৯ মাসে ১০০টি ভূমিকম্প হয়েছে দেশে। ঢাকায় ১৩ লাখ, চট্টগ্রামে তিন লাখ ও সিলেটে এক লাখ বহুতল ভবন রয়েছে। এসব ভবনের ৭৫ শতাংশ হচ্ছে ছয়তলা বা তার চেয়েও উঁচু। ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলে এই ভবনগুলো ও এর বাসিন্দারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
বুয়েট ও সরকারের একটি যৌথ সমীক্ষায় দেখা গেছে, সাড়ে সাত মাত্রার ভূমিকম্পে ঢাকার ৭২ হাজার ভবন ধসে পড়বে। যেখানে তৈরি হবে সাত কোটি টন কংক্রিটের স্তূপ।
॥ মানা হয় না বিল্ডিং কোড ॥
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেস অনুষদের ডিন ও ডিজাস্টার সায়েন্স অ্যান্ড ক্লাইমেন্ট রেজিলিয়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. জিল্লুর রহমান বলেন, পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে বড় ভূমিকম্পে যে ধরনের ক্ষতি হয়েছে আমাদের দেশেও একই ক্ষতি হবে। ‘রেসকিউ করার চেয়ে ইনফ্রাস্ট্রাকচার ঠিক করাই বেশি জরুরি। এখন জাপানে সব ভবন ৭ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্প সহ্য করার মতো। চিলি-পেরুর মতো স্বল্পোন্নত দেশও বিল্ডিং কোড মেনে বিল্ডিং নির্মাণ করছে।’ আমাদেও দেশে ভবন নির্মাণের সময় বিল্ডিং কোড মেনে করা হয় না। মালিকপক্ষ যেমন সচেতন নয়, দেশের ইঞ্জিনিয়াররাও এ ব্যাপারে সচেতন নন। আমরা আতঙ্কিত হচ্ছি কিন্তু সচেতন হচ্ছি না।’
॥ আতঙ্কই ক্ষতির কারণ হবে ॥
পরিবেশবাদী সংগঠন ‘বেলা’র নির্বাহী প্রধান সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট অঞ্চল হচ্ছে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা। টাঙ্গাইলের যে ফল্টটা আছে, সেখানে যদি ৭ দশমিক ৫ মাত্রার কম্পন সৃষ্টি হয় তাহলে ৭২ হাজারের মতো ভবন ধসে পড়বে এবং ৫৬ হাজার ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আর ঢাকায় ৮ দশমিক ৫ মাত্রার কম্পন হলে দুই লাখ ঘরবাড়ি ধসে পড়বে।’