জন্মভূমি ডেস্ক
বর্তমান সংসদকে ‘অবৈধ’ আখ্যা দিয়ে চার বছর সেই সংসদের সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন বিএনপির সংসদ সদস্যরা। দলের এই দ্বিচারিতা মানতে পারেননি নেতাকর্মীরা। জোটের শরিকরাও প্রথম থেকে বিরোধিতা করে আসছে। ঘটেছে জোট ত্যাগ করার ঘটনাও। মাঝে-মধ্যেই পদত্যাগের ধোঁয়া তুললেও বাস্তবে সেটা হয়নি। সবশেষ আগামী ১০ ডিসেম্বর ঢাকা সমাবেশে পদত্যাগের ঘোষণা আসতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন দলের একাধিক সিনিয়র নেতা। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, দলের অভ্যন্তরীণ চাপ সামলানো ও আন্দোলনমুখী নেতাকর্মীদের চাঙা রাখতে এমনটা বলা হচ্ছে। মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে পদত্যাগের সম্ভাবনা নেই।
তথ্য বলছে, ২০১৮ সালে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয় বিএনপি। ফলাফল হয় হতাশাজনক। ফলে নির্বাচনের দিনই ফলাফল বর্জন করে দলটি। গঠিত সংসদকে ‘অবৈধ’ আখ্যা দেয়। পরে আবার সেই সংসদের এমপি হিসেবে শপথগ্রহণ করে। এতে বিএনপির দুই জোটের শরিকরা ক্ষুদ্ধ হয়। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শরিক বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী নেতৃত্বাধীন কৃষক-শ্রমিক জনতা লীগ ও ২০ দলীয় জোট শরিক ব্যারিস্টার আন্দালিভ রহমান পার্থ নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি-বিজেপি জোট ত্যাগ করে। পাশাপাশি বিএনপির ‘বন্ধু’ রাজনৈতিক দলগুলো কঠোর সমালোচনা করে সংসদ থেকে পদত্যাগ করার আহŸান জানাতে থাকে।
এরপর কেটে গেছে প্রায় চার বছর। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন আসন্ন। এখন পর্যন্ত বিএনপি সংসদ থেকে পদত্যাগের কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। বরং সমালোচনার মুখে বিএনপি বারবার বলছে নির্বাচনে অংশ নেওয়া ও সংসদে যাওয়া বিএনপির আন্দোলনের একটা অংশ।
দলটির ছয়জন এমপি (সংরক্ষিতসহ) এখনো সংসদে দলের প্রতিনিধিত্ব করছেন। তাহলে দলীয়ভাবে কোন মুখে সরকারকে অবৈধ বলছেন- এমন প্রশ্ন আসছে ঘুরেফিরে। দলীয় সংসদ সদস্যরা কেন পদত্যাগ করছেন না সে প্রশ্নের উত্তরও খুঁজছে বিএনপির তৃণমূল।
বিএনপির একটি সূত্র বলছে, আন্দোলনের চূড়ান্ত অংশ হিসেবে বিএনপির সংসদ সদস্যরা পদত্যাগ করতে পারেন। আগামী ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় মহাসমাবেশের আগে-পরে গুরুত্বপূর্ণ এ সিদ্ধান্তটি নিতে চায় বিএনপি। যুগপৎ আন্দোলনের রূপরেখা চূড়ান্ত করা এবং নির্দলীয় সরকারের রূপরেখা তৈরি করে তা জাতির সামনে তুলে ধরার সময় অবৈধ সংসদ থেকে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সবশেষ বৈঠকে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির সাবেক এক সংসদ সদস্য বলেন, কীসের পদত্যাগ? যে সংসদ ভাঙার দাবিতে তৃণমূল নেতাকর্মীরা আন্দোলনমুখী, সেই সংসদ থেকে দলীয় প্রতিনিধিরা সুযোগ-সুবিধা নিচ্ছেন। ক্ষুব্ধ নেতাকর্মীদের সান্ত¡না দিতে সংসদ সদস্যদের পদত্যাগের ধোঁয়া তোলা হচ্ছে মাত্র।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, নির্বাচনকে বৈধতা দেওয়া একেবারেই উচিত হয়নি। সংসদে যাওয়াও উচিত হয়নি। বিএনপি ছয়টি আসন নিয়ে সংসদে আছে এটা অত্যন্ত লজ্জার। এটা বর্তমান সরকারকে বৈধ দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি বিএনপি।
সংরক্ষিত আসনের এমপি রুমিন ফারহানা বলেন, আমরা সংসদে যা বলেছি তা দলের সিদ্ধান্তে। যে মুহূর্তে আমাদের সংসদ ছেড়ে দিতে বলবে আমরা ছেড়ে দেবো। এ বিষয়ে আমাদের বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি এই আন্দোলনের মধ্যে এমপিদের পদত্যাগ করতে হবে। স্বাভাবিকভাবেই পদত্যাগ করতে হবে। বিএনপি করলে বিএনপির নির্দেশ মানবে না এটা তো হতে পারে না। বিএনপি করলে বিএনপির সিদ্ধান্ত মানতে বাধ্য।
কবে নাগাদ পদত্যাগ করবেন- এমন প্রশ্নে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, আলোচনায় আছে, সময়ই বলে দেবে।
রাজনীতি বিশ্লেষক মহিউদ্দিন খান মোহন বলেন, সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে আমি বিএনপির কোনো এমপির পদত্যাগের সম্ভাবনা দেখি না। বিএনপি যখন নির্বাচন অবৈধ ঘোষণা করে ফলাফল প্রত্যাখ্যান করলো, তখন সিদ্ধান্ত হলো বিএনপি শপথ নেবে না। কিন্তু যেদিন সংসদ সদস্যদের শপথ নেওয়ার দিন শেষ, হঠাৎ করে সেদিন শপথ নিয়ে ফেললো। এরা শপথ নেওয়ার পরে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সংবাদ সম্মেলন করে বললেন, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নির্দেশে তারা শপথ নিচ্ছে। তাদের ভাষায় সংসদ অবৈধ। কিন্তু তারা বেতন-ভাতা নিচ্ছেন, কেউ শুল্কমুক্ত গাড়ি আনার পাঁয়তারা করছেন, ওটা হলো তাদের কাছে বৈধ। রাজনীতির অস্পষ্টতা থেকে বিএনপি বের হতে পারেনি।
‘এখন আন্দোলনমুখী নেতাকর্মীরা চাপ দিচ্ছে যে এমপিদের পদত্যাগ করতে হবে। কিন্তু তারা পদত্যাগ করতে রাজি না। একটাই কথা যে আন্দোলন তুঙ্গে উঠুক তারপর দেখা যাবে। এখন পদত্যাগ করলো, কিন্তু আন্দোলন স্তিমিত হয়ে গেলো- তাহলে কী হবে। আগামীতে এমপি হবে কী হবে না, যে কারণে তারা মেয়াদ পূর্ণ করবেন বলে আমার ধারণা।’
তিনি আরও বলেন, আন্দোলনমুখী তৃণমূল নেতাকর্মীদের এই চাপ সামাল দেওয়ার মলম হিসেবে এমপিদের পদত্যাগের সুর তোলা হচ্ছে।